শিবু সোরেন।
তিনি জরাগ্রস্ত। শয্যাশায়ী। প্রকাশ্যে আসা বন্ধ করেছেন বহু দিন। তবু ‘গুরুজি’ নামটি উচ্চারণেই এখনও আদিবাসী মানুষজনের যে শ্রদ্ধা ঝরে পড়ে, তাতে কৃত্রিমতার মালিন্য মেলে না। ঝাড়খণ্ডের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সেই শিবু সোরেনের দিন গিয়েছে, তবু তিনিই সভাপতি রাজ্যের শাসক জোটের প্রধান দল ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা (জেএমএম)-র।
বোকারোর অতিথি নিবাসে ২০০৯-এ শিবুর জ্যেষ্ঠ পুত্র, জামা-র বিধায়ক ও দলের দাপুটে নেতা দুর্গা সোরেন যখন ঘুমের মধ্যে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে মারা গেলেন, সবে ৪০ পেরিয়েছেন। শিবুর উত্তরাধিকার ও দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব তুলে নেন মধ্যম পুত্র হেমন্ত সোরেন। এখন তিনি জেএমএমের কার্যনির্বাহী সভাপতি। পাঁচ বছর আগে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির কাছে চূড়ান্ত পর্যুদস্ত হওয়ার ৮-৯ মাসের মধ্যে যাঁর নেতৃত্বে জেএমএম ঝাড়খণ্ডের বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে, সেই হেমন্ত এখন জমি কেলেঙ্কারির অভিযোগে ফেঁসে মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে কারাগারে। কুর্সি সামলাচ্ছেন বৃদ্ধ চম্পাই সোরেন, প্রচারের মুখ হেমন্ত-জায়া কল্পনা।
কার্যত মাথাহীন অবস্থায় পরাক্রমশালী বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই, প্রচারে কোনটা গুরুত্ব পাচ্ছে— হেমন্তকে জেলে পোরা না রাজ্য সরকারের উন্নয়ন? জেএমএম-এর কেন্দ্রীয় মুখপাত্র সুপ্রিয় ভট্টাচার্যের ছোট্ট জবাব— “অবশ্যই হেমন্তকে জেলে পোরা...”
সে বিষয়টি বলতে গেলে কি হেমন্তের বিরুদ্ধে জমি কেলেঙ্কারি, দুর্নীতির অভিযোগও উস্কে উঠছে না?মুখের কথা কেড়ে রসিক সুপ্রিয় বলে ওঠেন, “আরে, আরে, আরে... কী ভাষায় কথা বলছেন আপনি! দুর্নীতি, কেলেঙ্কারি! ও সব তো কলকাতার ভাষা, পালিশ করা লোকেদের ভাষা। কীসের কেলেঙ্কারি? আদিবাসী মানুষ মানেন, এই রাজ্যের সব জমির মালিক তাঁরা। হেমন্ত ভোটে জিতে রাজা হয়েছেন, রাজা। সাঁওতাল পরগনা, ছোট নাগপুর, সিংভূম, তামাড় জুড়ে উষর জমি গড়াগড়ি খাচ্ছে। রাজ্যে কি জমির অভাব পড়েছে, যে ওই সামান্য ৮ একর জমি গুরুজি-কা-বেটা চুরি করতে যাবে?” জেএমএম-এর প্রাক্তন সচিব সুপ্রিয়ের কথায়, “বড় সভা নয়, সমাবেশ নয়, শো-ডাউন নয়। গ্রামে গ্রামে পৌঁছে দাওয়ায় বসে আমাদের নেতাকর্মীরা সমবেত জোয়ান মদ্দ থেকে মহিলা-বৃদ্ধদের একটাই প্রশ্ন করছেন— ‘জবাব দিবেক না এই অবিচারের?’ শুনে আদিবাসী মানুষের চোয়াল শক্ত হচ্ছে, মুখে সর্বদা লেগে থাকা সরল হাসির লেশ মুছে যাচ্ছে। দেখুন না, সাঁওতাল, মুন্ডা, ওঁরাও, হো, কুরমি মাহাতোরা কেমন জবাবটা এ বার বিজেপিকে দেয়।”
বিজেপি আর আজসু মিলে ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে ঝাড়খণ্ডের ১৪টি আসনের ১২টিতেই জয়ী হয়েছিল। বিজেপি একা পেয়েছিল ১১টি। বিপক্ষে মহাজোটের একটি জেএমএম, একটি কংগ্রেস। তৃতীয় শরিক আরজেডি আসনই পায়নি। রাজ্যের ১৪টি আসনের মধ্যে পালামৌ এক মাত্র ‘এসসি’ আসন। ৮টি সাধারণ। এই ৯টি আসনের সবেতেই ধারে, ভারে, প্রচারে, চটকে কয়েক কদম এগিয়ে বিজেপি।
রাজনৈতিক ভাষ্যকার ব্রজেশ রায়ের মতে, হেমন্তের গ্রেফতারের প্রভাব যা পড়বে ৫টি আদিবাসী অধ্যুষিত ‘এসটি’ আসন— খুঁটি, সিংভূম, লোহারডাগা, রাজমহল এবং দুমকায়। এমন নয় যে সেই প্রভাবে জেএমএম জিতে যাবে। প্রতিটি আসনেই রয়েছে নিজস্ব অঙ্ক। সব চেয়ে বড় কথা— আদিবাসীদের মধ্যে বিজেপির প্রভাব এবং সমর্থনও কম নয়। ২০০০-এ ঝাড়খণ্ড রাজ্য গঠনের আগে থেকেই ছোট নাগপুর, সিংভূম ও সাঁওতাল পরগনা এলাকায় রমরমিয়ে চলে আরএসএস-এর শাখা ‘অখিল ভারতীয় বনবাসী কল্যাণ আশ্রম’। বিহার ভেঙে আদিবাসীদের জন্য পৃথক রাজ্যের দাবিতে বিজেপিও জেএমএম-এর মতোই ছিল সরব।
সিকি শতাব্দীতে টোল পড়েছে শিবু সোরেনের ভাবমূর্তিতেও। হেমন্ত বা ছোট ছেলে বসন্তের শিবুর মতো যেমন লড়াইয়ের ঐতিহ্য নেই, তাদের নিয়ে মুখে মুখে ছড়ানো গল্পগাছাও নেই। বরং বিলাসবহুল জীবনযাত্রা ও আচার-আচরণে তাদের সঙ্গে ‘দিকু’ (বহিরাগত অনাদিবাসী)-দের বিশেষ ফারাক নেই। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে নিজের এলাকা দুমকা থেকেই পরাস্ত হন শিবু সোরেন।
সিংভূম ‘এসটি’ আসনে গত বারের জয়ী কংগ্রেস প্রার্থী গীতা কোড়া এ বার পদ্মের প্রার্থী। গীতার স্বামী প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী আদিবাসী হো সম্প্রদায়ের নেতা মধু কোড়া ৪ হাজার কোটি টাকার কয়লা কেলেঙ্কারিতে কারাদণ্ড পেয়েছেন। হো সম্প্রদায়ের ভোটে গত বার গীতা জয়ী হয়েছিলেন। এ বার সেই অঙ্কেই তাঁকে প্রার্থী করেছে বিজেপি। গীতাকে দলে টানতে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের দল ইডি-সিবিআইয়ের জুজুকে কাজে লাগিয়েছে বলে কানাঘুষো। গীতার বিরুদ্ধে জেএমএমের প্রার্থী জবা মাঝি, যাঁর স্বামী দেবেন্দ্র মাঝি জল-জঙ্গলের অধিকার আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে মাফিয়াদের হাতে খুন হয়েছিলেন। জবার দিকে রয়েছে আবেগ, গীতার পক্ষে অর্থবল।
আবার কুরমি মাহাতোদের রোষে পড়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা বিজেপি নেতা অর্জুন মুন্ডা হেরে যেতে পারেন, এমন বার্তায় বাতাস ভারী। তফসিলি উপজাতির তালিকায় ওঠার দাবিতে মাহাতোরা বহু কাল ধরে আন্দোলনে। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অর্জুন গত বার খুঁটি ‘এসটি’ আসন থেকে প্রার্থী হয়ে সেই দাবি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেন। গণনাকেন্দ্রে নানা রহস্যময় ঘটনার পরে মাত্র ১৪৪৩ ভোটে জিতলেও নরেন্দ্র মোদী তাঁকে আদিবাসী কল্যাণ মন্ত্রকের দায়িত্ব দেন। তবে মাহাতোদের দাবি পূরণে অর্জুনের তৎপরতার খবর নেই। বরং ‘পাতার মুন্ডা’-দের জন্য তিনি আদিবাসী তকমা আদায় করেছেন। বিজেপির এক নেতার আক্ষেপ— এর ফলে মাহাতোদের ভোট তো গেলই, চটেছেন মুন্ডা সম্প্রদায়ও, যাঁরা অন্য সম্প্রদায়ে বিয়ে করে সমাজের বাইরে চলে যাওয়া ‘পাতার মুন্ডা’দের আদিবাসী বলেই স্বীকার করেন না।
ইচ্ছাডিহির মোড়ে হাতে গাছের ভাঙা ডাল নিয়ে ট্রাফিক সামলাচ্ছিল চিট-ময়লা পোশাকের এক তরুণ। চুলে জট। যে গাড়ি তার নির্দেশ মানছে না, হাতের লাঠিটি তুলে তাকে গুলি করার ভঙ্গি করছে, সঙ্গে মুখে আওয়াজ, ‘ঠাঁআআই!’ সঙ্গের গাড়ির চালক হপন সোরেন সুর নিচু করে বললেন, “ইয়ে লড়কা মাওবাদী থা। শিকারপাড়া কা। হামারা গাঁওকাহি!” তার পর? হপন জানালেন, পায়ে গুলি লাগে। পুলিশ একে গ্রেফতার করে নিয়ে এসেছিল। কী করে ‘মাথা বিগড়ে গেল’ জানা যায় না। অনেকে পুলিশের থার্ড ডিগ্রির কথা বলে।
সিংভূম-তামাড়-দুমকা তো মাওবাদী মুক্তাঞ্চল ছিল। এখন তারা কোথায়? হপন জানান, স্থানীয়রা পাশ ছেড়েছিলেন, পুলিশ-সিআরপির ঘন ঘন অভিযান। ক্যাডারদের ফেলে রেখে মাথারা আগে উধাও হন। দু’এক জন মারাও যান। তার পরে ক্যাডারেরাও ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এখন সব শুনশান।
জাতপাত, ধর্ম-সম্প্রদায়ের অঙ্কে, টাকার রথে চড়ে ভোটের রাজনীতি এগোয়। গরিব ঝাড়খণ্ডের স্বপ্ন পড়ে থাকে আদিগন্ত খাঁ খাঁ টাঁড়ভূমির মতোই।#
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy