শতাব্দী রায়। —ফাইল চিত্র।
তাপমাত্রা ৪২-৪৩ ডিগ্রি ছুঁচ্ছে। রাস্তায় নামলেই ঝলসে যাওয়ার উপক্রম। এই পরিস্থিতিতে নেত্রীর মেজাজ মাঝেমধ্যেই বিপদসীমার ও-ধারে। এমনই এক দুপুরে দলের এক কর্মীকে কড়া ভাষাতেই ধমকালেন। তিরস্কারের বিশেষ শব্দ ভাইরাল হল সমাজমাধ্যমে। সমালোচনার ঝড়। পরের দিন দেখা গেল, সেই কর্মীকে ডেকেই সকলের সামনে দুঃখ প্রকাশ করছেন তিনি।
ভোটের রাজনীতি তা হলে যে কোনও সময় ভোল বদলাতেও শেখায়? প্রশ্নটা শুনে কয়েক বার মাথা নাড়লেন শতাব্দী রায়। “ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। আমার ১১ বছরের মেয়ে কলকাতা থেকে ফোন করে আমাকে বলেছিল, ‘সকলের সামনে যদি কাউকে এত কড়া ভাবে বকতে পারো, তা হলে সকলের সামনেই তাকে ‘সরি’ বলতে শিখতে হবে।’ মেয়ের কথায় খুব ধাক্কা লেগেছিল আমার। ভুল স্বীকারে লজ্জা কোথায়?”
বীরভূম লোকসভা কেন্দ্রের তিন বারের সাংসদ শতাব্দী। ২০০৯ সালে প্রথম বার লড়তে এসে বলেছিলেন, “আমি দিদির পায়রা। আমাকে দিদির দূত হিসেবেই বেছে নিন আপনারা।” ১৫ বছর পরেও শতাব্দী কিন্তু স্রেফ ‘দিদির পায়রা’ই থেকে গিয়েছেন। জনপ্রতিনিধি হিসেবে তাঁর নিজস্ব জোরালো পরিচয় এখনও সে ভাবে গড়ে ওঠেনি। শুধু বিরোধীরা এ কথা বলছেন তা নয়। তাঁর কেন্দ্রে যে এলাকাগুলি তৃণমূলের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত, সেখানেও সাধারণ মানুষের বক্তব্য, “প্রার্থী দেখে নয়, আমরা ভোট দিই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামে।”
তিন বার সংসদে যাওয়ার পরেও এই কথাটা কি আপনার পক্ষে খুব সম্মানের? পরনে হলুদ-কালো সিল্কের শাড়ি। কালো লম্বা হাতা ব্লাউজ। মানানসই গয়না। বাংলা ছবির এক সময়ের নামী নায়িকার ছিমছাম সাজ। কিন্তু গলায় সামান্য বিরক্তি। “প্রথমত আমি একা নই। আমরা সবাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামেই ভোটে লড়ি। সেটাই আমাদের শক্তি। আর দ্বিতীয়ত, আমি এলাকার জন্য কী করেছি, সেটা এখানকার মানুষ খুব ভালই জানেন। তাই এই সব অভিযোগ আমাকে খুব বেশি স্পর্শ করে না।”
কিন্তু ‘দিদির নামে’ ভোটের পরেও এমন অসহিষ্ণুতা কেন? আত্মবিশ্বাস কি কোথাও খানিকটা টাল খাচ্ছে? ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুললেও ভ্রু-র ভাঁজ খানিকটা গভীর হয় এ বার। “এই গরমে সাধুসন্তদেরও ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে। আমি তো সাধারণ মানুষ।”
বীরভূমের সাধারণ মানুষের একটা অংশ অবশ্য বলছেন, গরম নয়, শতাব্দীকে এ বার অসহিষ্ণু করছে কাঁটার খোঁচা। মিল্টন-কাঁটা।
এই কেন্দ্রের বাম-কংগ্রেস জোট প্রার্থী তথা বীরভূম জেলা কংগ্রেসের সভাপতি মিল্টন রশিদ সংখ্যালঘু ভোট কতটা কাটবেন, সেই প্রশ্নই ভাবাচ্ছে তৃণমূল নেতৃত্বকে। গত লোকসভা নির্বাচনে মূলত সংখ্যালঘু ভোট-ই জিতিয়েছিল শতাব্দীকে। প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, রশিদের জনপ্রিয়তা কি সেই নিশ্চিত দুর্গে কিছুটা ভাঙন ধরাতে পারে?
১৯৫২ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বীরভূম লোকসভা কেন্দ্র ছিল কংগ্রেসের দখলে। ১৯৭১-এ এই কেন্দ্রে ক্ষমতা দখল করে সিপিএম। তার পর থেকে টানা বাম জমানা। ২০০৯ সালে লাল দুর্গে ফাটল ধরিয়ে প্রবেশ করে তৃণমূল। বীরভূম কেন্দ্রের ১১টি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে একটি অর্থাৎ দুবরাজপুর বিজেপির দখলে। এ ছাড়া রয়েছে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জর্জরিত খয়রাশোল। রয়েছে নলহাটি-দু’নম্বর ব্লক। এ সব জায়গায় কেউ কারও কথা শোনে না।
গত বার শতাব্দীকে বিপাকে ফেলেছিল দুবরাজপুর, সিউড়ি, রামপুরহাট এবং সাঁইথিয়া। আর জিতিয়ে এনেছিল মূলত মুরারই। হাসন, মুরারই, নলহাটি এই তিনটি সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় তৃণমূল বিপুল ভোটে এগিয়ে ছিল। সংখ্যালঘু ভোট যাতে কোনও ভাবেই ভাগ না হয়, শীর্ষ নেতৃত্ব বার বার জেলায় এসে সে কথা বলে যাচ্ছেন। কিন্তু সেখানেই জিজ্ঞাসা চিহ্ন তুলে দিয়েছেন মিল্টন। শুধু সংখ্যালঘু প্রার্থী হিসেবে নয়, বিস্তীর্ণ এলাকায় তাঁর জনপ্রিয়তাই সংশয় তৈরি করছে অনেকের মনে। বাড়ি বাড়ি ঘুরে প্রত্যেকের প্রায় হেঁশেল পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছেন তিনি। ২০১৬ সালে হাসন বিধানসভা কেন্দ্র থেকে জিতেছিলেন পেশায় আইনজীবী মিল্টন। ২০২১-এ ওই কেন্দ্রে জেতে তৃণমূল। এ বার এই বাম-কংগ্রেস জোটে ভোট কাটাকাটির গল্পে কি লাভবান হবে বিজেপি? প্রশ্ন উঠছে সে নিয়েও। মিল্টন অবশ্য দাবি করেছেন, সংখ্যালঘু তকমায় তাঁকে বেঁধে দেওয়ার চেষ্টা করছে বিরোধীরা। তিনি বলছেন, “নিজের কাজের প্রমাণ অতীতে রেখেছি। মানুষ যে কোনও প্রয়োজনে আমাকে পাশে পান। তাই তাঁরা বদল চাইছেন।”
এক দুপুরে দেখা গেল, রামপুরহাটের বেনেগ্রামে বাড়ি বাড়ি ঘুরে একাই প্রচার চালাচ্ছেন। প্রার্থী একা, দলবল কই? এলাকার এক শিশুকে কোলে তুলে মিল্টন বললেন, “দলের লোকেরা বিকেলে সভায় থাকবে। আমি তো এলাকার লোক। সব বাড়িতে আমার জন্য দরজা খোলা। এই প্রচারে আমার একার উপস্থিতিই যথেষ্ট।” বুঝিয়ে দিলেন, ‘বহিরাগত নয়, বীরভূমের ভূমিপুত্র’ কার্ডটাও যত্ন করেই খেলছেন তিনি!
তুলনায় বিজেপির শুরুটা খানিক গোলমেলে। গোড়ায় প্রার্থী পদে দুধকুমার মণ্ডলের নাম শোনা যাচ্ছিল। তার পরে ঘোষণা হয় প্রাক্তন আইপিএস দেবাশিস ধরের নাম। শুরুতেই বিজেপির সাংগঠনিক দুর্বলতা নিয়ে কিছুটা ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন দেবাশিস। গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের আঁচ পোহাতে হয়েছিল তাঁকেও। তার পরে ছবি বদলায়। কেন্দ্রের বিভিন্ন এলাকায় দেওয়াল লিখনে তাঁর নাম জ্বলজ্বল করলেও রাজ্য সরকার ‘নো ডিউজ়’ সার্টিফিকেট না দেওয়ায় প্রার্থিপদ বাতিল হয়ে যায় দেবাশিসের। বিপদ আঁচ করে তত ক্ষণে অবশ্য বিজেপি বিকল্প প্রার্থী দেবতনু ভট্টাচার্যের নাম ঘোষণা করে দিয়েছে। এখন প্রশ্ন, এই টানাপড়েনকে ঘিরে বিজেপি তৃণমূলের বিরুদ্ধে যে চক্রান্তের অভিযোগ তুলেছে, তাতে কি লাভ হবে কিছু? নাকি উল্টোটাই ঘটবে?
দেরিতে ময়দানে নামা দেবতনু দাবি করছেন, “প্রার্থী নিয়ে এই টানাপড়েন ভোটে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না। বরং মানুষ বুঝবেন বিজেপিকে ঠেকাতে তৃণমূল কতটা মরিয়া। তা ছাড়া, ভোটটা প্রার্থী দেখে নয়, দল দেখেই দেবেন সাধারণ মানুষ।” এমন নানা দাবি আর পাল্টা দাবির ভিড়ে সব মিলিয়ে শেষ মুহূর্তেও অনেকটাই ঘেঁটে রয়েছে বীরভূমের পরিস্থিতি। কোনও এক দিকে যে বিশেষ ভাবে পাল্লা ভারী, তা জোর দিয়ে দাবি করার অবস্থায় কোনও পক্ষই নেই।
অতীতে ভোটের আগে-পরে অনেক হিংসার সাক্ষী থেকেছে এই জেলা। এ বারের টালমাটাল পরিস্থিতিতে আবার কি তেমন কিছুর পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলেছে? নাকি অনুব্রত-পরবর্তী বীরভূমের ছবি অনেকটাই আলাদা?
মুরারইয়ের মিরপুর গ্রাম ধরে গাড়ি এগোচ্ছিল কনকপুরের দিকে। মিরপুরে বড় গাছের নীচে বাঁধানো চাতালে বিকেলের জমায়েত। সামনে ছোট টিভি। হুমড়ি খেয়ে সকলে দেখছেন টিভির পর্দায় রঞ্জিত মল্লিক চাবুক হাতে শাসাচ্ছেন এক জনকে। গাছতলার অদূরেই ছোট্ট চায়ের দোকান।
গাড়ি থামিয়ে চাতালে বসতেই দৃষ্টি ঘুরল তাঁদের। কী বুঝছেন ভোটের হাওয়া? এক বৃদ্ধ বললেন, “বোঝাবুঝির কিছু নেই। আমরাই থাকব।” পাশের জন তাঁকে সামান্য ঠেলা মেরে বললেন, “ওই আশাতেই থাকো। জোট প্রার্থী কী করে দ্যাখো শুধু।” পাশ থেকে এক যুবক চোয়াল শক্ত করে স্বগতোক্তি করলেন, “মানুষ জানে কারা কাজ করবে। ভোট হবে মোদীর নামে।”
কয়েক মুহূর্ত সামান্য তর্কাতর্কি চলল। ততক্ষণে ধোঁয়া ওঠা চায়ের ভাঁড় হাজির। ভিড় বলল, “ও সব বাদ দিন। আমাদের আলাদা আলাদা মত। তর্কও হবে। আবার পাশাপাশি বসে চা-ও খাব। আপনিও খান।” চা এগিয়ে এল। সঙ্গে সমস্বরে হাসির শব্দ।
হিংসা আর নির্লজ্জতার ভোটের আবহে এর চেয়ে বড় স্বস্তির ছবি আর কী হতে পারে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy