Advertisement
Back to
Sandeshkhali Incident

অবিশ্বাস আর রাজনীতির খেলা আন্দোলনের কঙ্কালে

সন্দেশখালি ফেরিঘাটের কাছে কাপড়ের দোকানি থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামে ভয়ে জড়সড় তরুণী, দিনভর এলাকা ঘুরে যাঁদের সঙ্গে কথা বলেছি, তাঁদের অনেকেই বুঝছেন না কোন খেলা কখন ঘুরছে।

sandeshkhali

—প্রতীকী ছবি।

সোমা মুখোপাধ্যায়
সন্দেশখালি শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০২৪ ০৭:৫১
Share: Save:

জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ!

না। সন্দেশখালিতে এখন দিনে বিজেপি, রাতে তৃণমূল! দু’পক্ষই বাড়ি থেকে ডাকতে আসে, মতে না মিললে দু’পক্ষই মারে। বাঁচতে পারলে বাঁচো। নয়তো জীবনের সমস্ত শান্তি, নিরাপত্তাবোধ বিসর্জন দিয়ে দিনগত পাপক্ষয় করো। এ ভাবে চলতেই অভ্যস্ত হচ্ছিলেন তাঁরা গত কয়েক মাস।

কিন্তু এখন খেলা-বদল! ভোটই হল না। অথচ ভোটের ফল প্রকাশের দিন যত এগিয়ে আসছে, মরিয়া দুই রাজনৈতিক দলের সমর্থকদের মধ্যে অন্যের চোখ এড়িয়ে শুরু হয়েছে সাপের গালে চুমু, ব্যাঙের গালেও চুমু। এতেই ভয় পাচ্ছেন এলাকার সাধারণ মানুষ।

সন্দেশখালি ফেরিঘাটের কাছে কাপড়ের দোকানি থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামে ভয়ে জড়সড় তরুণী, দিনভর এলাকা ঘুরে যাঁদের সঙ্গে কথা বলেছি, তাঁদের অনেকেই বুঝছেন না কোন খেলা কখন ঘুরছে। অহরহ রং বদলের এই হাওয়ায় যে শব্দটা সন্দেশখালি থেকে পুরোপুরি মুছে গিয়েছে, তা হল বিশ্বাস।

ভিডিয়ো পাল্টা-ভিডিয়োর তরজা শুরু হতেই সন্দেশখালি ভোল বদলাতে শুরু করে। অবিশ্বাস, সন্দেহ, ঘৃণা এমনই শিকড় গেড়েছে যে প্রতিবেশী মহিলা ধর্ষণ এবং অপহরণের চেষ্টার অভিযোগ তুললে, এমনকি, গণধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগ রুজু হওয়ার পরেও কিছু দূরের ঘর থেকেই প্রশ্ন ওঠে, “এত কিছু হল, পাড়ায় থেকে জানতেও পারলাম না, এতই সহজ?” অভিযোগকারিণী যখন সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের ডেকে বাড়ির অদূরে মাঠের মধ্যে তাঁর হাতের পলা, এক পাটি চটি পড়ে থাকতে দেখাচ্ছেন, তখন কয়েকশো মিটার দূরের জায়গা থেকেই অভিযোগ করা হচ্ছে, “পলা খুলে পড়ে গেল, আর শাঁখা ঠিকঠাক রইল?” এ সব দেখেশুনে কে বলবে যে এই সন্দেশখালিই মাস কয়েক আগে রাজনৈতিক রং নির্বিশেষে মহিলাদের সম্মিলিত লড়াইয়ের নজির গড়েছিল! পাত্রপাড়ার এক বৃদ্ধা বললেন, “অনেক বেনো জল ঢুকেছে। সত্যিকারের অত্যাচারগুলো সব মানুষ ভুলে যাচ্ছে। এখন শুধু আখের গোছানো।”

কোনও নির্দিষ্ট এলাকা নয়, গ্রামের পর গ্রাম একই রকম ছবি। ৭ নম্বর দ্বারীর জঙ্গলের কাছে পর পর যত ঘরেই গেছি, কেউ কথাই বলতে চাননি। আনাজ কাটতে কাটতে এক মহিলা বলেছেন, “আর পারছি না। মারটা কোন দিক থেকে আসবে কেউই জানে না। আপনারা বাইরে থেকে এক রকম দেখে যান। আর আমরা ভিতরে থেকে দেখি, দু’মুখো সাপেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে।”

তৃণমূল এবং বিজেপির স্থানীয় ছোট-মাঝারি নেতারাও কথা বলছেন রেখেঢেকে। কেউ কেউ আবার বেশ কয়েকটা উত্তপ্ত বাক্য বলার পরে বলছেন, “এগুলো লিখবেন না কিন্তু।” সন্দেশখালিতে এখন মুখোশ পরা মুখের ছড়াছড়ি!

কলোনি পাড়ায় অভিযোগ ফিরিয়ে নেওয়া এক নির্যাতিতার বাড়ির সামনে পুলিশি প্রহরা। প্রত্যেক শিফটে চার জন করে মোট ১২ জন। শুনছিলাম, পুলিশ নাকি তাঁর সঙ্গে কাউকে দেখা করতেই দিচ্ছে না। এ দিন অবশ্য অনুমতি মিলল। কিন্তু কথা বলতে যেতে প্রায় মারমুখী হয়ে উঠলেন তিনি। “যা বলার অনেক বার বলেছি। এখন সবটা ঘেঁটে গেছে। আর কোনও কথা বলব না। সবার থেকেই রেহাই চাই এখন।”

এমন অভিজ্ঞতার আঁচ মিলছিল দিনের শুরু থেকেই। বেড়মজুরের যে এলাকায় মহিলারা হাতে ঝাঁটা, লাঠি নিয়ে রাত পাহারা দিচ্ছিলেন বলে ভিডিয়ো প্রকাশ্যে এসেছিল, সকাল-সকাল সেখানে পৌঁছতেই ঘরের পর ঘর একই কথা। “আমরা নিজেদের মতো ঠিক আছি। আর আমাদের বিপদ বাড়াবেন না। কে কখন আমাদের ব্যবহার করছে, আমাদের নামে কী বলছে, আমরা কিচ্ছু জানি না। দয়া করে আমাদের বাঁচতে দিন।” বাগদি পাড়ায় পর পর তিন জন মহিলা একটাও কথা না বলে ভিতরে ঢুকে গেলেন। দাওয়ায় বসে থাকা বাচ্চাকে পর্যন্ত বাইরে থাকতে দিলেন না। ঘরের ভিতর থেকে মুখ বাড়িয়ে একটাই কথা তাঁদের, “আমরা ঠিক আছি। সব শান্ত এখানে।”

এলাকা থেকে বেরোনোর সময়ে এক চায়ের দোকানে কথা হল স্থানীয় বৃদ্ধের সঙ্গে। বললেন, “রাত হলেই তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা এলাকায় গিয়ে ভয় দেখাচ্ছে, আর সকালে বিজেপির লোকজন তড়পাচ্ছে, এ ভাবেই কাটছে আমাদের জীবন। আবার কখনও দেখছি, যারা আমাদের ভয় দেখিয়ে রাখছে, তাদের নিজেদের মধ্যে দিব্যি ভাব। হাসি-ঠাট্টা করছে। আমরা কোথায় যাই বলুন তো?”

সাধারণ মানুষের বড় অংশের বক্তব্য, ‘সাজানো চিত্রনাট্য’-এর সন্দেশখালিতে এখন এ-বেলা ও-বেলা রং বদলাচ্ছে। শেখ শাহজাহান গ্রেফতার হওয়ার পরে বেশ কিছু দিন কোণঠাসা থাকা তৃণমূল আবার খোলসের ভিতর থেকে বেরিয়েছে। বিজেপির তেড়েফুঁড়ে ওঠার দিনগুলোতে স্থানীয় তৃণমূল কর্মীদের অনেকেই বিজেপির সঙ্গে গলাগলি শুরু করেছিলেন। ‘রেখা পাত্রের জেতার আশা ক্ষীণ, তাই ভোটের ফল বেরোনোর পরে হিসেব হবে’—এই বলে তৃণমূল যে হুঁশিয়ারি দিতে শুরু করেছে, তাতে অন্য পক্ষেও গোপনে যোগাযোগ বেড়েছে বলে এলাকায় গুঞ্জন। স্থানীয় বিজেপি নেতারা প্রকারান্তরে তা স্বীকারও করছেন।

রাতের পর রাত শেখ শাহজাহান, শিবু হাজরা, উত্তম সর্দার আর তাদের দলবলের মর্জিমাফিক মেয়েদের ডেকে পাঠানো, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রাখা, সামনে বসিয়ে নিজেরা নেশা করা, বিনা মজুরিতে কাজ করানো, মেয়েদের অসম্মান, পুরুষদের মারধর— সবটা ভুলে যাচ্ছে এই এলাকা।

আর এই মুহূর্তে যা পড়ে রয়েছে, তা সন্দেশখালি নয়, সন্দেশখালির আন্দোলনের কঙ্কাল। (চলবে)

অন্য বিষয়গুলি:

Sandeshkhali Incident sandeshkhali TMC BJP
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy