Advertisement
Back to
Lok Sabha election result 2024

অশান্ত মণিপুর কি বার্তা দিল বিজেপিকে? ভোটের ফলে কী ইঙ্গিত উত্তর-পূর্ব ভারতের আট রাজ্যে

লোকসভা নির্বাচনের ফল বলছে, সরকার বাঁচাতে পারলেও সারা দেশেই ধাক্কা খেয়েছে বিজেপি এবং তার নেতৃত্বাধীন জোট এনডিএ। তার পরোক্ষ প্রভাব পড়ল উত্তর-পূর্ব ভারতেও।

কী বার্তা দিল উত্তর-পূর্ব ভারত?

কী বার্তা দিল উত্তর-পূর্ব ভারত? —ফাইল চিত্র

বিতান ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ জুন ২০২৪ ২০:৫৮
Share: Save:

চেরাপুঞ্জি, মেরি কম, চিত্রাঙ্গদা, শর্মিলা চানু— মোটের উপর এই কয়েকটা শব্দ দিয়ে আস্ত উত্তর-পূর্ব ভারতকে ব্যাখ্যা করে থাকে বাকি ভারত। আসলে এ হল ‘সাত বোন চম্পা’ আর ‘এক ভাই পারুলের’ গল্প। সাত ‘বোন’ অর্থাৎ মিজ়োরাম, মেঘালয়, অরুণাচল প্রদেশ, অসম, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড আর মণিপুর। সঙ্গে রয়েছে এক ‘ভাই’ সিকিম।

লোকসভা নির্বাচনের ফল বলছে, সরকার বাঁচাতে পারলেও সারা দেশেই ধাক্কা খেয়েছে বিজেপি এবং তার নেতৃত্বাধীন জোট এনডিএ। তার পরোক্ষ প্রভাব পড়ল উত্তর-পূর্ব ভারতেও। গোষ্ঠী হিংসায় দীর্ণ মণিপুরের দু’টি লোকসভা আসনেই জয়ী হয়েছে কংগ্রেস। মেইতেই জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত ইনার মণিপুরে লক্ষাধিক ব্যবধানে জয়ী হয়েছে কংগ্রেস। আর কুকি-জো উপজাতি অধ্যুষিত আউটার মণিপুরে প্রায় ৮৫ হাজার ভোটে জয়ী হয়েছে হাত শিবির। মেঘালয়ের দু’টি লোকসভা কেন্দ্রেই হেরেছে সে রাজ্যের শাসকদল তথা এনডিএ-র শরিক ন্যাশনাল পিপল্‌স পার্টি (এনপিপি)। তুরা আসনে আগাথা সাংমাকে হারিয়ে ১ লক্ষ ৫৫ হাজার ২৪১ ভোটে হারিয়ে জয়ী হয়েছেন কংগ্রেস প্রার্থী সালেং এ সাংমা। আর শিলং কেন্দ্রে কংগ্রেস প্রার্থী ভিনসেন্ট পালাকে ৩ লক্ষ ৭১ হাজার ৯১০ ভোটে হারিয়ে জয়ী হয়েছেন রাজ্যের নতুন দল ভয়েস অফ দ্য পিপল্‌স পার্টির রিকি অ্যান্ড্রু জে সিংকন। ২০২৩ সালের বিধানসভা ভোটের আগে প্রথম বার ভোট ময়দানে নেমে চারটি আসন জিতেছিল ভয়েস অফ দ্য পিপল্‌স পার্টি। এ বার সবাইকে খানিক চমকে দিয়েই প্রথম বার কোনও লোকসভা আসনে জিতল তারা।

দেশ: ৫৪৩৫৪৩

সংখ্যাগরিষ্ঠতা: ২৭২

  • দল
  • আসন
বিজেপি ২৪০
কংগ্রেস ৯৯
এসপি ৩৭
তৃণমূল ২৯
ডিএমকে ২২
টিডিপি ১৬
জেডিইউ ১২
শিবসেনা(উদ্ধব)
শিবসেনা(শিন্ডে)
এনসিপি(শরদ)
এলজেপি
ওয়াইএসআরসিপি
সিপিআইএম
আরজেডি
আপ
জেএমএম
আইইউএমএল
জেডিএস
জেকেএন
সিপিআই
আরএলডি
জেএনপি
সিপিআইএমএল
ভিসিকে
এজিপি
কেসি(এম)
আরএসপি
এনসিপি(অজিত)
ভিওটিপিপি
জ়েডপিএম
অকালি দল
আরএলটিপি
এসকেএম
এমডিএমকে
এএসপিকেআর
এআইএমআইএম
ইউপিপিএল
আপনা দল
এজেএসইউপি
ভারতএপি
এইচএএম (এস)
নির্দল

অবশ্য অরুণাচল প্রদেশের দু’টি আসনেই কংগ্রেসকে হারিয়ে জয়ী হয়েছে বিজেপি। আর অসমের ১৪টি আসনের মধ্যে ৯টিতে জয়ী হয়েছে বিজেপি, তিনটিতে জয়ী হয়েছে কংগ্রেস। একটি করে আসন পেয়েছে অসম গণ পরিষদ (এজিপি) এবং ইউনাইটেড পিপল্‌স পার্টি লিবেরাল (ইউপিপিএল)। মিজ়োরামের একটি মাত্র আসনে জয়ী হয়েছে সে রাজ্যের শাসকদল জ়োরাম পিপল্‌স মুভমেন্ট (জ়েডপিএম)। নাগাল্যান্ডের একটি মাত্র আসনে জয়ী হয়েছে কংগ্রেস। ত্রিপুরায় বিজেপির জয়ের ধারা অব্যাহত রইল। সেখানকার দু’টি আসনেই জয়ী হয়েছে বিজেপি। সিকিমের ওই একই নামের লোকসভা কেন্দ্রে জয়ী হয়েছে সে রাজ্যের শাসকদল তথা এনডিএ-র শরিক দল সিকিম ক্রান্তিকারী মোর্চা (এসকেএম)।

উত্তর-পূর্বের আটটি রাজ্য মিলিয়ে রয়েছে ২৫টি লোকসভা আসন। সাধারণ পাটিগণিতের অঙ্কেই দেশের ভোট রাজনীতির আলোচনায় খানিক উপেক্ষিতই থেকে যায় ওই সাত বোন আর এক ভাই। তবে এ বার লোকসভা ভোটের অনেক আগে থেকেই গোটা দেশের আলোচনা এবং কৌতূহলের কেন্দ্রে ছিল মণিপুর। ২০২৩ সালের ৩ মে থেকে গোষ্ঠীহিংসায় দীর্ণ এই রাজ্যে ভোটের ফল কাদের পক্ষে গেল, তা জানতে আগ্রহী ছিলেন অনেকেই।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

মণিপুরে আসন মাত্র দু’টি। ইনার মণিপুর এবং আউটার মণিপুর। ২০১৪ সালে মণিপুরের দুই কেন্দ্রেই জয়ী হয়েছিল কংগ্রেস। ২০১৯ সালে ইম্ফল উপত্যকার ইনার মণিপুর আসনে কংগ্রেসকে হারিয়ে জয়ী হয় বিজেপি। আর আউটার মণিপুর আসনে বিজেপিকে হারিয়ে দেয় অধুনা জোটশরিক এনপিএফ। মেইতেই জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত ইনার মণিপুরে এ বারও প্রার্থী দিয়েছিল বিজেপি এবং কংগ্রেস। রাজ্যের আইন ও শিক্ষামন্ত্রী টি বসন্তকুমার সিংহকে এ বার ওই কেন্দ্রে টিকিট দিয়েছিল পদ্মশিবির। আর কংগ্রেস প্রার্থী করেছিল দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনগোমচা বিমল আকোইজ়ামকে। অন্য দিকে, কুকি-জ়ো জনজাতি অধ্যুষিত আউটার মণিপুর আসনে আঞ্চলিক দল নাগা পিপল্‌স ফ্রন্ট (এনপিএফ)-কে সমর্থন করে বিজেপি। প্রসঙ্গত, এনপিএফ এনডিএ এবং উত্তর-পূর্বে বিজেপির নেতৃত্বাধীন আঞ্চলিক দলগুলির জোট নর্থ ইস্ট ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স বা নেডা-র শরিক দল। তফসিলি জনজাতি সংরক্ষিত আউটার মণিপুরে এনপিএফ, কংগ্রেস-সহ প্রায় সব দলই এ বার নাগা গোষ্ঠী থেকে প্রার্থী বেছে নিয়েছিল। গোষ্ঠীহিংসায় ঘর ছেড়ে অস্থায়ী আশ্রয়শিবিরে অংশ নেওয়া কুকি-জ়ো গোষ্ঠীর মানুষেরা অবশ্য ভোটের লাইনে দাঁড়াবেন কি না, তা নিয়েই দ্বিধায় ছিলেন। তুলনায় নরমপন্থীরা নোটায় ভোট দেওয়ার ডাক দিয়েছিলেন। আর চরমপন্থীরা আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে সরাসরি ডাক দিয়েছিলেন ভোট বয়কটের।

মণিপুরের মতোই দু’টি লোকসভা আসন রয়েছে উত্তর-পূর্বের আর এক রাজ্য মেঘালয়েও। এ বার মেঘালয়ের তুরা আসনে প্রার্থী দিয়েছিল তৃণমূল। তাই আপাত ভাবে অনালোচিত এই রাজ্য রাতারাতি উঠে এসেছিল বাংলা ও বাঙালির ভোটচর্চায়। তুরা আসনটিকে সে রাজ্যের শাসকদল ন্যাশনাল পিপল্‌স পার্টির ‘গড়’ বলা যেতে পারে। ২০১৪ সালে এই আসন থেকে জয়ী হয়েছিলেন লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার তথা মেঘালয়ের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী পিএ সাংমা। ২০১৬ সালে তাঁর মৃত্যুর পর এই কেন্দ্রের সাংসদ হন তাঁর পুত্র কনরাড সাংমা। ২০১৯ সালে কংগ্রেসের মুকুল সাংমাকে হারিয়ে জয়ী হন কনরাডের বোন আগাথা সাংমা। মেঘালয়ের আর এক প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কংগ্রেসের সেই মুকুল অবশ্য এখন তৃণমূলে। মুকুলের ভাই জেনিথ সাংমাকে এ বার তুরা আসনে প্রার্থী করেছিল জোড়াফুল শিবির। কথাবার্তা বেশ খানিকটা এগোনোর খবর পাওয়া গেলেও শেষমেশ এই রাজ্যেও কংগ্রেস-তৃণমূলের মধ্যে আসন সমঝোতা হয়নি। তুরায় আলাদা প্রার্থী দিয়েছিল কংগ্রেস। আর শিলংয়ে ‘হাত’ শিবির প্রার্থী করে ওই কেন্দ্রেরই বিদায়ী সাংসদ তথা মেঘালয় প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি ভিনসেন্ট পালাকে। মেঘালয়ের দুই কেন্দ্রেই এনডিএ এবং নেডার শরিক দল এনপিপি-কে সমর্থন করেছিল বিজেপি।

উত্তর-পূর্বের মিজ়োরামের ভোটরঙ্গে হরেক চরিত্র। এই রাজ্যের রাজনীতিতে পার্শ্বচরিত্রদের একাধিক বার মুখ্যচরিত্র হয়ে উঠতে দেখা গিয়েছে। মিজ়োরামে সবেধন নীলমণি একটিই লোকসভা আসন। গত নভেম্বরে এই রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে সবাইকে চমকে দিয়ে জয়ী হয়েছিল ইন্দিরা গান্ধীর প্রাক্তন নিরাপত্তা আধিকারিক লালডুহোমার দল জ়োরাম পিপল্‌স‌ মুভমেন্ট (জ়েডপিএম)। মিজ়োরাম কেন্দ্রে লালডুহোমার দলের পাশাপাশি প্রার্থী দিয়েছিল গত নভেম্বর পর্যন্ত রাজ্যের শাসনক্ষমতায় থাকা মিজ়ো ন্যাশনাল ফ্রন্ট (এমএনএফ)। কোনও আঞ্চলিক দলের সঙ্গে জোটে না গিয়ে আলাদা ভাবে লড়েছিল কংগ্রেস এবং বিজেপি।

নাগাল্যান্ড লোকসভা আসনে গত লোকসভা নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক প্রোগ্রেসিভ পার্টি (এনডিপিপি)। এ বার নিজেরা প্রার্থী না-দিয়ে এনডিপিপি-কে সমর্থন করেছিল বিজেপি। আলাদা প্রার্থী দিয়েছিল কংগ্রেস। অরুণাচল প্রদেশের দু’টি আসনের মধ্যে বিশেষ ভাবে নজর ছিল অরুণাচল পশ্চিম আসনটিতে৷ এই কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী করেছিল বিদায়ী সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কিরেন রিজিজুকে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রে দেড় লক্ষেরও বেশি ভোটে কংগ্রেস প্রার্থীকে হারিয়েছিলেন রিজিজু। সে বার অরুণাচল পূর্ব আসনেও ফুটেছিল পদ্মফুল। গত বারের মতো এ বারেও এই দুই কেন্দ্রে সরাসরি লড়াই কংগ্রেস এবং বিজেপির মধ্যে। সিকিমের ওই একই নামের একটি মাত্র আসনে লড়াই ছিল মূলত সে রাজ্যের শাসকদল সিকিম ক্রান্তিকারী মোর্চা (এসকেএম)-এর সঙ্গে সাবেক শাসকদল সিকিম ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (এসডিএফ)-এর। আলাদা প্রার্থী দিয়েছিল বিজেপি এবং কংগ্রেসও। ২০১৯ সালে প্রায় ১২ হাজার ভোটে এসডিএফ প্রার্থীকে হারিয়েছিল এসকেএম। তৃতীয় আর চতুর্থ স্থানে ছিল যথাক্রমে বিজেপি এবং কংগ্রেস।

উত্তর-পূর্বের আঞ্চলিক দলগুলিকে বিজেপির পক্ষপুটে নিয়ে আসার গুরুভার অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার কাঁধেই দিয়েছিল পদ্মশিবির। বস্তুত, হিমন্তই নেডার প্রধান। তবে উত্তর-পূর্বে বিজেপির প্রভাব অক্ষুণ্ণ রাখার পাশাপাশি অসমে দলের প্রভাব বজায় রাখার চ্যালেঞ্জও ছিল এই প্রাক্তন কংগ্রেস নেতার সামনে। গত লোকসভা নির্বাচনে অসমের ১৪টি আসনের মধ্যে বিজেপি পেয়েছিল ৯টি আসন। জোটসঙ্গী অসম গণ পরিষদ (এজিপি) পেয়েছিল ৩টি আসন। অন্য দিকে, কংগ্রেস জিতেছিল ৩টি আসনে। বদরুদ্দিন আজমলের অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (এআইইউডিএফ) জিতেছিল একটি আসনে। ৪০০ আসন পাওয়ার লক্ষ্যে এ বার অসমের সব আসনেই পদ্ম ফোটানোর লক্ষ্য নিয়ে নেমেছিলেন হিমন্ত।

একদা বাম দুর্গ ত্রিপুরায় গত বার দু’টি লোকসভা কেন্দ্রেই জিতেছিল বিজেপি। এ বার অবশ্য তফসিলি জনজাতি সংরক্ষিত ত্রিপুরা পশ্চিম আসনটি জোটসঙ্গী তিপ্রা মথাকে ছেড়ে দিয়েছিল তারা। আর ত্রিপুরা পূর্ব আসনে প্রার্থী হন রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব। বিজেপিকে রুখতে বিধানসভার পর লোকসভা ভোটেও জোট বেঁধেছিল বিরোধী বাম এবং কংগ্রেস।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE