Advertisement
Back to
Lok Sabha Election 2024 Result

‘বালুহীন’ হাবড়ায় ভরাডুবি তৃণমূলের

হাবড়া এলাকায় প্রচুর মতুয়া উদ্বাস্তু মানুষের বসবাস। সিএএ নিয়ে মতুয়াদের বোঝানোর ব্যর্থতাও ভরাডুবির কারণ বলে মনে করছেন অনেকে।

—প্রতীকী চিত্র।

—প্রতীকী চিত্র।

সীমান্ত মৈত্র  
হাবড়া শেষ আপডেট: ০৬ জুন ২০২৪ ০৯:৩২
Share: Save:

তিনি না থেকে প্রমাণ করলেন, কতখানি জুড়ে ছিলেন!

হাবড়ার তৃণমূল নেতৃত্বের কাছে চ্যালেঞ্জ ছিল, বিধায়ক জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের অনুপস্থিতিতে ভাল ফল করে দেখানো। কিন্তু মঙ্গলবার বারাসত লোকসভা কেন্দ্রের ফল বেরনোর পরে দেখা যাচ্ছে, ভাল ফল করা তো দূরের কথা, তৃণমূল এখানে কার্যত কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতাই গড়ে তুলতে পারেনি। চূড়ান্ত ভরাডুবি ঘটেছে। তৃণমূলের জয়ী প্রার্থী কাকলি ঘোষ দস্তিদার বলেন, ‘‘বিজেপি হাবড়াকে টার্গেট করে, চক্রান্ত করে, বিভেদের রাজনীতি করে সাফল্য পেয়েছে। পাশেই বনগাঁ লোকসভা। সেখান থেকে লোকজন এনে চক্রান্ত করা হয়েছে।’’

পুরসভা এলাকার ২৪টি ওয়ার্ড এবং ৪টি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকা নিয়ে হাবড়া বিধানসভা। লোকসভা ভোটের ফলে দেখা যাচ্ছে ২৪টি ওয়ার্ডেই তৃণমূল প্রার্থী কাকলি ঘোষ দস্তিদার পিছিয়ে আছেন। হাবড়ার পুরপ্রধান নারায়ণচন্দ্র সাহা, উপ পুরপ্রধান সীতাংশু দাস, প্রাক্তন পুরপ্রধান নীলিমেশ দাসের স্ত্রীর ওয়ার্ডেও পিছিয়ে শাসক দল।

চারটি পঞ্চায়েতের মধ্যে কুমড়া এবং মছলন্দপুর ২ পঞ্চায়েত এলাকাতেও তৃণমূল পিছিয়ে। একমাত্র মুখরক্ষা করেছে পৃথিবা এবং রাউতারা পঞ্চায়েত এলাকা। এই দুই পঞ্চায়েতে তৃণমূল প্রার্থী এগিয়ে আছেন। সব মিলিয়ে হাবড়া বিধানসভা এলাকায় কাকলি পিছিয়ে আছেন ১৯ হাজার ৯৩৩ ভোটে। যদিও বারাসত কেন্দ্র থেকে তিনি জিতেছেন ১ লক্ষ ১৪ হাজার ভোটের ব্যবধানে।

জয়ী আসনেও কেন ব্যতিক্রম হাবড়া?

এ ক্ষেত্রে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের কথায় উঠে আসছে, দলের মধ্যে গোষ্ঠীকোন্দলের প্রসঙ্গ। সকলকে এক ছাতার তলায় এনে ভোট করা যায়নি বলে ঘরোয়া আলোচনায় মানছেন অনেকে। কিছু নেতা-কর্মীর নিষ্ক্রিয়তা নিঃসন্দেহে ভুগিয়ছে। হাবড়ায় এত দিন মাটি কামড়ে পড়ে থেকে ভোট করিয়ে এসেছেন স্থানীয় বিধায়ক জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক (বালু)। তিনি গ্রেফতার হওয়ার পরে সেই শূন্যতা যে পূরণ করা যায়নি, তা বলে দিচ্ছে ভোটের ফল।

হাবড়া এলাকায় প্রচুর মতুয়া উদ্বাস্তু মানুষের বসবাস। সিএএ নিয়ে মতুয়াদের বোঝানোর ব্যর্থতাও ভরাডুবির কারণ বলে মনে করছেন অনেকে।

হাবড়ার তৃণমূল নেতা তথা প্রাক্তন পুরপ্রধান নীলিমেশ দাস বলেন, ‘‘রাজ্যে প্রবল তৃণমূল হাওয়ার মধ্যেও কেন হাবড়ার মানুষ আমাদের বিরুদ্ধে ভোট দিলেন, তার কারণ অনুসন্ধান করতে হবে দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে। আমার মনে হয়, এখানে ভরাডুবির পিছনে স্থানীয় নানা কারণ আছে। পুরসভার উন্নয়ন, পরিষেবা সহ একাংশের নেতাদের প্রতি মানুষের অসন্তোষ ছিল। তা ছাড়া, বিধায়কের অনুপস্থিতি ভোটের ফলাফলে এখানে প্রভাব পড়েছে।’’

জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ তথা হাবড়ার তৃণমূল নেতা অজিত সাহার কথায় ক্ষোভের সুর। তিনি জানালেন, লোকসভা ভোটে হাবড়ায় যে নির্বাচন কমিটি তৈরি করা হয়েছিল পুরপ্রধান নারায়ণ সাহার নেতৃত্বে, সেখানে প্রথমে অজিত এবং নীলিমেশের নাম ছিল। পরবর্তী সময়ে তাঁদের নাম কাটা যায়। অজিত বলেন, ‘‘আমার ক্ষেত্রে যুক্তি দেওয়া দেওয়া হয়েছিল, আমি গাইঘাটা বিধানসভার ভোটার। এটা ঠিক, বিধানসভা হিসেবে আমি গাইঘাটার ভোটার। কিন্তু ব্লক হিসেবে আমি হাবড়া ১ ব্লকের বাসিন্দা। তর্কের খাতিরে যদি ওঁদের যুক্তি মেনেও নিই, তা হলে আমি ২০০৯, ২০১৪, ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে কী ভাবে কাকলিদির নির্বাচনে কাজ করেছিলাম?’’

অজিতের মতে, ‘‘সিএএ নিয়ে যাঁরা এখানে নির্বাচন পরিচালনা করেছেন, তাঁরা মতুয়াদের বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছেন। এ ছাড়া, সাংগঠনিক দুর্বলতা ছিল।’’

ভোটের প্রচারে বালুকে একেবারেই ব্রাত্য রেখেছিলেন নেতারা। শহরে কার্যত বালুর কোনও ছবিও খু্ঁজে পাওয়া যায়নি মিটিং-মিছিল-সভায়। দলের নেতা-নেত্রী বক্তৃতায় তাঁর প্রসঙ্গ উঠেছিল খুবই কম।

বালু না থাকায় হাবড়ায় বিরোধীরা সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছিল। ভোটের প্রচারে অশোকনগরে জনসভা করতে এসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘‘শুনতে পাচ্ছি, সিপিএম হাবড়ায় একটু মিটিং-মিছিল করছে বালু নেই বলে।’’ মুখ্যমন্ত্রীর মুখে বহু দিন পরে বালুর নাম শুনে জেলবন্দি নেতার অনুগামীরা সক্রিয় হবেন বলে মনে করা হয়েছিল। তবে তেমনটা ঘটেনি বলে জানাচ্ছেন দলেরই অনেকে।

রাজনৈতিক মহলের অনেকেই মনে করছেন, গত বছর রেশন বণ্টন দুর্নীতি মামলায় ইডির হাতে বালু গ্রেফতার হওয়ার পর থেকেই হাবড়া তৃণমূলে ছন্নছাড়া ভাব দেখা যাচ্ছে। হাবড়ায় লোকসভা নির্বাচন পরিচালনা করতে তৈরি কমিটি কাজকর্ম নিয়ে তৃণমূলের একাংশের মধ্যে ক্ষোভ ছিল। কর্মী-সমর্থকেরা সে অর্থে চাঙ্গা করা যায়নি।

দলের অন্দরে গোষ্ঠীকোন্দলের চোরা স্রোত এখনও বইছে। কংগ্রেস থেকে আসা নেতাদের নেতৃত্ব আদি তৃণমূল কর্মীরা মানতে পারেননি। ভোটের প্রচারে হাবড়ায় এসেছিলেন তৃণমূল নেতা কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি মিছিল করেছিলেন। সেই মিছিলে তৃণমূলের দু’পক্ষ বচসা, ধাক্কাধাক্কিতে জড়ান।

গত লোকসভা ভোটেও অবশ্য তৃণমূল হাবড়া বিধানসভা এলাকায় পিছিয়ে ছিল। সে বার কাকলি ঘোষ দস্তিদার এখান থেকে ১৯,০৫০ ভোটে পিছিয়ে ছিলেন। সে বারও হাবড়া পুরসভার ২৪টি ওয়ার্ডে পিছিয়ে ছিল তৃণমূল। কিন্তু তারপরে বালু জনসংযোগ এবং উন্নয়নমূলক কর্মসূচি বাড়িয়ে দেন। বিধানসভা, পঞ্চায়েত এবং পুরসভায় তৃণমূল সাফল্য পেয়েছিল বালুর নেতৃত্বে। ২০১১ সাল থেকে বালুই এখানে নির্বাচন পরিচালনা করেছেন। তাঁর সেই নেতৃত্বের অভাব এ বার তৃণমূল হাড়েহাড়ে টের পেয়েছে।

হাবড়ায় ভরাডুবি নিয়ে তৃণমূলের নির্বাচন কমিটির চেয়ারম্যান নারায়ণচন্দ্র সাহা বলেন, ‘‘বারাসত লোকসভায় শহর এলাকায় তৃণমূলের ফল খারাপ হয়েছে। আমরা পুরসভার উন্নয়ন এবং পরিষেবা মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলাম। তারপরেও কেন এই ফল, তা আমরা পর্যালোচনা করে দেখব।’’ সাংগঠনিক ব্যর্থতার কথা অবশ্য মানতে নারাজ কাকলি।

কী বলছে বিরোধীরা?

বারাসত কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী স্বপন মজুমদার ভোটের প্রচার চলার সময়েই দাবি করেছিলেন, বারাসত লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত যে সাতটি বিধানসভা আছে, তার মধ্যে হাবড়া থেকে তিনি সব থেকে বেশি ভোটের ব্যবধানে এগিয়ে থাকবেন। মঙ্গলবার ভোটের ফল বেরনোর পরে দেখা যাচ্ছে, সে কথা ফলে গিয়েছে। স্বপন বলেন, ‘‘মতুয়া উদ্বাস্তু মানুষের ভোট আমি পেয়েছি। চাল চোর জ্যোতিপ্রিয়ের বিরুদ্ধেও মানুষ বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন।’’

হাবড়ার সিপিএম নেতা আশুতোষ রায়চৌধুরীর কথায়, ‘‘গত পঞ্চায়েত এবং পুরভোটে মানুষ এখানে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ পাননি। কোনও ভোট হয়নি। তৃণমূলের সন্ত্রাস, ছাপ্পা, রিগিং চলেছিল। মানুষ এ বার ভোট দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। তৃণমূলকে হারাতে পারে এমন দলকেই মানুষ ভোট দিয়েছেন।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Lok Sabha Election 2024 Habra
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy