—ফাইল চিত্র।
‘নূতন জাগিয়া শিখ/ নূতন উষার সূর্যের পানে/ চাহিল নির্নিমিখ’।
এ বছর লোকসভা ভোটে পঞ্জাবের হাতে বিকল্প ছিল দু’টি। এক, গত চার বছরের কৃষক আন্দোলনকে সামনে রেখে ভোটবাক্সে ‘মুখের মতো জবাব’ দেওয়া। অথবা কেন্দ্রবিরোধী আন্দোলনে সম্পূর্ণ ইতি টেনে ঘরে খিল দিয়ে মুখ লুকোনো। এই দুই বিকল্পের মধ্যে আবেগপ্রবণ আর সাহসী পঞ্জাব যে প্রথমটিই বেছে নেবে, সে ব্যাপারে সন্দেহ ছিল না। শুধু দেখার ছিল কী ভাবে বেছে নেবে সেটি। দেখা গেল পঞ্জাব নতুন ভাবে জেগেছে ঠিকই তবে ভরসা রেখেছে পুরনো সূর্য কংগ্রেসেই।
২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের ফলাফল বলছে, পঞ্জাব তার ১৩টি আসনের ৭টিই তুলে দিয়েছে কংগ্রেসের হাতে। শাসক আপকে দিয়েছে ৩টি আসন। বিজেপির সঙ্গ-ছাড়া শিরোমণি অকালি দল আসন পেয়েছে ১টি। এ ছাড়া জয়ী হয়েছেন দু’জন নির্দল প্রার্থী। কিন্তু বিজেপি একটি আসনও জেতেনি। তারা যে জিতবেও না, সেই ইঙ্গিত পঞ্জাবের হাওয়ায় ভাসছিল।
কৃষক বিক্ষোভ দীর্ণ পঞ্জাব এ বছর ঠিক করেছিল, আর যেখানেই হোক বিজেপিকে ভোট নয়। বদলে বিজেপির বিরুদ্ধে যে প্রার্থীর সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী মনে হবে, তাকেই ভোট দেবে পঞ্জাব, সে যে দলেরই হোক না কেন। কিন্তু পঞ্জাব যে শেষ পর্যন্ত সেটা করতে পারবে, সেই ভরসা ছিল না অনেকেরই। কারণ পঞ্জাবে অনেক সহজ সমীকরণই মেলে না।
অঙ্ক মেলে না
উত্তর ভারতের রাজ্য হলেও পঞ্জাব গোবলয়ের অন্তর্গত নয়। উত্তরের বাকি রাজ্যগুলির সঙ্গে তাই এর রাজনীতির কোনও মিল নেই। নির্বাচনী রাজনীতির বহু চেনা ছক পঞ্জাবে শুধু ধাক্কা খায় না, মুখ থুবড়ে পড়ে। হিসাব মেলে না। ঠিক যেমন ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটেও মেলেনি। ২০১৬-২০১৯ উরি, পুলওয়ামায় একের পর এক হামলা হয়েছে পাকিস্তান-আশ্রিত জঙ্গিদের। যার পাল্টা জবাব কখনও সার্জিকাল স্ট্রাইক, কখনও সীমান্ত সংঘর্ষের মাধ্যমে দিয়েছে ভারত। রাজনীতিবিদদের একাংশ মনে করেন, সীমান্তের সেই যুদ্ধ-যুদ্ধ পরিস্থিতি এবং তাতে ভারতের ‘বীরত্ব প্রদর্শনের’ সুফল ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে বিজেপি পেয়েছিল। কারণ, বহু অবিজেপি রাজ্যেও বিজেপির ভোট বেড়েছিল চোখে পড়ার মতো। দেশে শুধু বিজেপিরই আসনসংখ্যা ২৮২ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৩০৩-এ।
কিন্তু খাস পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী পঞ্জাবে, যেখানে এর সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ার কথা, সেই রাজ্যে এর কণামাত্র প্রভাব দেখা যায়নি। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের মোদী-তরঙ্গ চলাকালীনও, পঞ্জাবে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল কংগ্রেস। ১৩টি আসনের মধ্যে আটটিতেই জিতেছিল তারা। অন্য দিকে, বিজেপি এবং শিরোমণি অকালি দলের জোট একযোগে জিতেছিল চারটি। এর মধ্যে বিজেপির আসনসংখ্যা আগের বারের থেকে বাড়েওনি, কমেওনি। পঞ্জাবে তারা পেয়েছিল দু’টি আসন। আগের বারের থেকে দু’টি আসন কমে অকালিও পেয়েছিল দু’টি। আর ২০১৪ সালে লোকসভায় চারটি আসন জেতা আম আদমি পার্টি, যারা তিন বছর পর পঞ্জাবের বিধানসভার দখল নেবে, তাদের ঝুলিতে পঞ্জাব দিয়েছিল কেবল একটি আসন। কোন অঙ্কে, তার হিসাব পেতে আরও পিছিয়ে যেতে হবে!
অঙ্ক মেলেও
পঞ্জাবে যেমন চেনা অঙ্ক মেলে না, তেমনই বাঁধা গৎ বদলায় না। বাঁধাধরা সেই অঙ্কের হিসাবই বলছে, ১৯৮৯ সাল থেকে ২০১৯ সাল (১৯৯৮ সাল ছাড়া) পর্যন্ত পঞ্জাবে লোকসভা ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া দলের নাম প্রতি বার বদলেছে। রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন, সেই বদলে বদল আসেনি কখনও। ২০১৪ সালে সেই নিয়মেই পঞ্জাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল বিজেপি এবং অকালির জোট। সে বার তারা ছ’টি আসন জিতেছিল। প্রথম বার পঞ্জাবে লোকসভা ভোট লড়তে আসা আপ পেয়েছিল চারটি আসন। কংগ্রেস কমে দাঁড়িয়েছিল তিনটিতে। একই ভাবে ২০০৯, ২০০৪ এবং ১৯৯৯ সালেও নিয়ম মেনে এক বার কংগ্রেস, এক বার বিজেপি-অকালি জোট সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েছে পঞ্জাবে। আবার ২০১২ সালের হিসাব বাদ দিলে পঞ্জাবের বিধানসভাতেও পালাবদলের এই একই ধারা জারি থেকেছে। কেন্দ্রে মোদী ঝড় উঠুক বা কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন সরকার থাকুক, পঞ্জাব অঙ্ক মিলিয়ে এক বার ক্ষমতা তুলে দিয়েছে কংগ্রেসের হাতে আর পরের বার কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু ২০২০ সালের পর এই পঞ্জাবে পরিবর্তন এসেছে। তাই এ বছরের লোকসভা ফলাফল বাঁধা গতে আবার শিরোমণি বা বিজেপির পক্ষে যাবে কি না সে বিষয়ে সংশয় ছিল। কিন্তু দেখা গেল পঞ্জাব তাদের গৎ এবং পথ পরিবর্তন করেছে।
পঞ্চনদের দেশে পরিবর্তন
রবি ঠাকুর ‘বন্দী বীর’ কবিতায় লিখেছিলেন, ‘পঞ্চনদীর তীরে, বেণি পাকাইয়া শিরে, দেখিতে দেখিতে গুরুর মন্ত্রে জাগিয়া উঠিল শিখ, নির্মম-নির্ভীক। হাজারো কণ্ঠে গুরুজির জয় ধ্বনিয়া তুলিছে দিক, নূতন উষার সূর্যের পানি চাহিল নির্নিমিখ’। সেই কবিতাই ২০২০ সালের পরে রক্তমাংসের বাস্তব হয়ে উঠেছিল পঞ্জাবে। ২০১৯ সালে দেশের ক্ষমতায় আসার পরে তিনটি কৃষিবিল এনেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। যা ভবিষ্যতে আইনে পরিণত হলে দেশের কৃষকদের ‘সুবিধা’ হবে বলে জানিয়েছিল কেন্দ্র। সেই আইনের বিরুদ্ধেই গর্জে ওঠে পঞ্জাব। পঞ্জাবের চাষিরা পাল্টা জানান, ওই আইন কৃষকদের হাত-পা বেঁধে দেওয়ার জন্য। ওই আইনে তাঁদের স্বাধীনতা এবং ক্ষমতা খর্ব হবে। তাঁদের উৎপাদিত ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যও হাতে পাবেন না তাঁরা। অধিকার বুঝে নিতে শুরু হয় পঞ্জাবের কৃষকদের দিল্লি অভিযান। আন্দোলন। যা গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। মৃত্যু হয় সরকারি হিসাবে প্রায় সাড়ে ৫০০ কৃষকের। ভারতীয় কৃষকদের আর্তনাদ পৌঁছয় বিশ্বের দরবারেও। নড়েচড়ে বসে কেন্দ্র। প্রায় দেড় বছরের আন্দোলনের পর কৃষিবিল প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় কেন্দ্রের বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার। কৃষকদের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মুক্তি পায় কৃষক বিড়ম্বনা থেকে।
পরিবর্তন জারি
সাফল্যের স্বাদ পাওয়া পঞ্জাব ‘পরিবর্তন’-এর ধারা জারি রাখে। ২০২২ সালে পরিবর্তন আসে বিধানসভার ভোটেও। এই প্রথম পঞ্জাব কংগ্রেস এবং বিজেপি-অকালি জোটকে সরিয়ে রেখে জয়ী করে আপ-কে। মুখ্যমন্ত্রী হন ভগবন্ত মান। জারি থাকে কেন্দ্র-বিরোধী আন্দোলনও। কৃষিপণ্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিশ্চিত করার যে প্রতিশ্রুতি কেন্দ্র কৃষকদের দিয়েছিল, তা পূর্ণ না হওয়ায় ২০২৪ সালে আবার শুরু হয় কৃষক আন্দোলন। বিজেপির বিরুদ্ধে সেই আন্দোলনে কৃষকদের উপর অত্যাচার এবং গুলি চালানোর অভিযোগ ওঠে, মৃত্যুও হয় এক তরুণ কৃষকের। বাধা পেয়ে দৃঢ় হয় আন্দোলন। এতটাই যে, বছর দুই আগে সাদরে ক্ষমতায় আনা আপ সরকারের উপরেও খড়্গহস্ত হয় পঞ্জাব। কৃষকমৃত্যুর ঘটনায় রাজ্য সরকারের দেওয়া ক্ষতিপূরণ প্রত্যাখ্যান পাল্টা জানায়, কিছু করতে পারলে কেন্দ্রের থেকে কৃষকদের দাবি আদায় করে দেখাও!
যুদ্ধক্ষেত্রে
এ হেন তপতপে পঞ্জাবে এ বছর একা লোকসভার ১৩টি আসনে লড়তে নেমেছিল বিজেপি। তাদের জোটসঙ্গী শিরোমণি অকালি দল পুরনো বন্ধুর সঙ্গে হাত মেলাতে রাজি হয়নি। কারণ, বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে রাজ্যে কৃষকদের গুটিকয় ভোট হাতছাড়া করতে চায়নি তারা। ফলে ২৫ বছরের সম্পর্কে ইতি পড়েছিল। আবার কেন্দ্রে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বাঁধলেও পঞ্জাবে তাদের দূরে ঠেলেছিল রাজ্যের বর্তমান শাসক আপ। ফলে কৃষকবিক্ষোভে দীর্ণ পঞ্জাবে কোনও রাজনৈতিক দলের জোট হয়নি। চারটি বড় দল ১৩টি আসনেই নিজেদের প্রার্থী দিয়েছিল। সেখানকার কৃষকদের মতোই স্বনির্ভর হতে চেয়েছে তারা। তবে সেই চতুর্মুখী লড়াই ভোটারদের প্রভাবিত করতে পারেনি।
পঞ্জাব মন
কৃষক আন্দোলন ছাড়াও পঞ্জাবের ভোটে আরও অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বরাবর কাজ করেছে। প্রথমত, তফসিলি জাতির ভোটে দেশের মধ্যে শীর্ষে পঞ্জাব। এই রাজ্যের ৩১ শতাংশ ভোটারই তফসিলি জাতিভুক্ত। যাঁদের মধ্যে রয়েছেন অজস্র কৃষক। যাঁরা নিজেদের ঘাম-ঝরানো পরিশ্রমের ‘সঠিক’ দাম পেতে চান। তার জন্য রক্তক্ষয়ী আন্দোলনেও পিছপা হন না। দ্বিতীয়ত, এই পঞ্জাবে আবার এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী শ্রেণিও রয়েছে। যারা যে কোনও মূল্যে সব ছেড়েছুড়ে বিদেশে গিয়ে অর্থ উপার্জন করতে চায়। পঞ্জাব থেকে বিদেশে যাওয়ার যে বিপদসঙ্কুল পথ, সেই তথাকথিত ‘ডাঙ্কি’ রুটে মরণপণ লড়াই করে তারা ছুঁতে চায় অভীষ্ট।
কার্যক্ষেত্রে এই দুই শ্রেণিরই লক্ষ এক— সাচ্ছল্য। কার্যক্ষেত্রে দুই শ্রেণির পদ্ধতিও এক— সংগ্রাম।
পুরুর দেশ পঞ্জাব
পঞ্জাব পুরু রাজার ‘দেশ’। যে পুরু সম্রাট আলেকজ়ান্ডারের নাম শুনে হার মানেননি। পাল্টা রুখে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেছিলেন। অসম সেই যুদ্ধে হেরেও নতশির হননি। বরং মাথা উঁচিয়ে বলেছিলেন, এক জন রাজার কাছ থেকে তিনি রাজার মতো আচরণ আশা করেন। গত চার বছরে পঞ্জাব দেখিয়ে দিয়েছে, তার শিরায় শিরায় আজও এমন অজস্র পুরুর বাস। যে শাসক তাদের সঙ্গে শাসকের মতো আচরণ করে না, তাদের লাঠি-গুলির সামনে গুটিয়ে বেপথু হন না এই পুরুরা। বরং মাথা উঁচিয়ে প্রতিবাদ জানান। শাসককেই বাধ্য করেন ‘পথে আসতে’। মঙ্গলবারের ফলাফলে স্পষ্ট বিজেপিকেও পথে এনেই ছেড়ছে প়ঞ্জাব। এখন দেখার বিজেপি সেই পথের শিক্ষা নিয়ে ভুল শুধরোতে পারে কি না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy