স্থানীয় ভাবে তৈরি দূরপাল্লার শেল ছোঁড়া বন্দুক। —নিজস্ব চিত্র।
বলছে, জবাব চাই, জবাব দাও! আর জবাব দিলে বলছে, নো হিন্দি, নো ইংলিশ! এ দিকে দিব্যি দিনভর মোবাইলে হিন্দি সিনেমা, রিল দেখছে!
দোষের মধ্যে ইম্ফলে স্টেডিয়ামের পাশে রাস্তায় বিক্রি হওয়া এয়ারগান, এয়ার পিস্তল দরদাম করার অছিলায় ছবি তুলছিলাম। এসে হাজির সামরিক পোশাক পরা চার তরুণ। বুকে, বাহুতে কাংলেইপাক পতাকা। পরিচয় আরাম্বাই টেঙ্গল সদস্য। বোঝাতে যাই, ‘‘আমি এই কাজিয়ার মধ্যে নেই। কারও পক্ষেও নেই। বাইরের খবরের কাগজের রিপোর্টার।’’ লাভ হয় না।
কুকি এলাকায় মেইতেই বাড়ির ধ্বংসস্তূপে অনায়াসে ঘুরে বেড়িয়েছি। তাই সকালে বেরোনোর সময় পাঙ্গাল মুসলিম গাড়ি চালককে বলেছিলাম, ইম্ফলে কুকিদের পোড়ানো ঘরবাড়িও দেখতে যাব। জিভ কাটেন চালক। বলেন, “এর আগে এক সাংবাদিককে নিয়ে গিয়েছিলাম। ওরা মোবাইল কেড়ে নিয়েছিল। হাতেপায়ে ধরে ফরম্যাট করা ফোন ফেরত পেয়েছে। ” ভরসা দিলাম, ধরা পড়ব না। মহাবালি কাবুই খুল এলাকায় ঢুকতেই চাপা গলায় চালক জানালেন, এসে গিয়েছি। ঝটপট মোবাইল ক্যামেরা বের করে ছবি তুললাম। ক্রীড়া প্রাধিকরণ ও স্টেডিয়ামের ঠিক পিছনের পাড়াটার একটা বাড়িও আস্ত নেই। কুকিদের পাড়াছাড়া করার পরে সেখানে আরাম্বাইদের কড়া পাহারা। ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে গোবিন্দ-মন্দির। মন্দির থেকে বেরিয়েই দেখি, রাস্তায় কাংলেইপাকেরপতাকার পসরার সামনে বিক্রি হচ্ছে এয়ারগান, এয়ারপিস্তল। দাম তিন হাজার থেকে সাত হাজার। বিক্রেতা জানালেন, লাইসেন্স লাগবে না। নিশ্চিন্তে নাও।
যেহেতু ভোটের আগে লাইসেন্স থাকা সব বন্দুক জমা দিতে বলেছে নির্বাচন কমিশন, তাই আপাতত স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র হাতে ঘুরছে না আরাম্বাই বাহিনী। এয়ারগানের চাহিদা বাড়ছে। সেই ছবি তুলতে গিয়ে সতর্কতার রাশ আলগা হয়েছিল বৈ কি! ওরা আমায় আটক করে বসেদের ফোন করতে ব্যস্ত। উপায় না দেখে আমি বললাম, “বসের ইন্টারভিউ চাই।” কেন? “আরে তোমাদের কথা সবাইকে বলতে হবে তো! তোমরাই জাতির রক্ষাকর্তা। জাতীয় স্তরের সংবাদমাধ্যমে সে কথা প্রচার না করলে চলবে না।” বরফ গলল। তাঁদের বস এলেন বাইকে চড়ে। বললেন ‘ওনলি হিন্দি’। তাঁর মতে, বাইরের সাংবাদিকরা কুকিদের হয়ে খবর করছে। ক্রমাগত চাপে ফেলছে আরাম্বাইকে। তাঁরা নিছকই জাতিপ্রেমী। আরও কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন, ফের ফোন আরও উপরের বসের। গোটা দলই মোটরবাইকে উঠে দুড়দাড় কোথাও রওনা হল।
কারা এই আরাম্বাই? সুপ্রাচীন সানামাহি ধর্মমতের পুনরুত্থানের উদ্দেশ্যে বর্তমান রাজা ও রাজ্যসভার সাংসদ সানাজাওবা আরাম্বাই টেঙ্গল (বর্শাধারী অশ্বারোহী) বাহিনী তৈরি করেছিলেন। সংঘর্ষের সুযোগে রাজ্যের অস্ত্রাগার বিনা বাধায় লুঠ করে তারা বলীয়ান হয়। সব পাড়ার, সব ঘর থেকে অন্তত একজন করে তরুণের আরাম্বাইয়ে যোগদান বাধ্যতামূলক। কিন্তু তাঁরাই যখন মন্ত্রী-বিধায়কদের কাংলা দুর্গে তলব করে শপথ নিতে বাধ্য করেন, নারাজ হলে থাপ্পড় কষান, রাজপথে সশস্ত্র মিছিল করেন, এএসপির বাড়িতে চড়াও হয়ে তাঁকে মারধর করে পুলিশকে বেইজ্জত করেন, টনক নড়ে সরকারের। বড় দেরিতে। ততক্ষণে অস্ত্রভাণ্ডার গড়ে, সামাজিক সমর্থনে, তোলাবাজিতে ও ৫০ হাজার সদস্যের বলে বলীয়ান হয়ে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের দৈত্য দাপট দেখাচ্ছে।
এক সেনা গোয়েন্দা জানাচ্ছেন, লুঠ হওয়া অস্ত্রের কালোবাজারি শুরু হয়েছে। ইনস্যাস, একে রাইফেল বাজারে দুই থেকে আড়াই লক্ষ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এত দিনের লড়াইয়ে গুলির রসদে টান পড়ায় কার্তুজ প্রতি দাম উঠেছে ২০০-৫০০ টাকা। পরিস্থিতি এমনই, ঘরে ভাত না থাকলেও হাতে অস্ত্র চাই। আর সেই অস্ত্র দেখিয়েই চলছে জাতি রক্ষার নামে তোলা আদায় করা। ফলে আরাম্বাইয়ের বিরুদ্ধে জনতারক্ষোভও বাড়ছে।
আসাম রাইফেলসের কর্তা জানাচ্ছিলেন, স্বাধীনতার পরে দেশে এমন ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষ আগে হয়নি, যেখানে কালাশনিকভ, এম-১৬, কার্বাইন, ইনস্যাস, এলএমজি, স্নাইপার রাইফেল, আরপিজি, মর্টার ব্যবহার হয়েছে। এমনকি, বিশ্বের খুব কম গৃহযুদ্ধেই ড্রোন ব্যবহার করে বোমা ফেলা হয়েছে, যেমন ঘটেছে মণিপুরে।
মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ এক আমলা একধাপ এগিয়ে অভিযোগ আনলেন, মায়ানমারে ভারতের তরফে সামরিক সরকারের সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখার পাশাপাশি বিদ্রোহীদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সাহায্য করা হয়েছে। সিআইএ-র তরফে এসেছিল এম-১৬, এম-৪ এর মতো রাইফেল। এ দিকে মায়ানমারে বিস্তৃত মাদক সাম্রাজ্যের চিনা মালিকরা চিন-কুকি জনজাতিকে মণিপুরের কুকি এলাকায় ক্রমাগত ঢুকিয়ে পাহাড়ের পর পাহাড়ে পপি চাষ শুরু করেছিল হেরোইন তৈরির জন্য। সেই থেকেই সংঘর্ষ। উত্তর-পূর্বকে অস্থির রাখতে, চিনা মাদক কারবারিদের মদতে, বিদেশি অস্ত্র পৌঁছে যাচ্ছে কুকিদের হাতে। সেনা গোয়েন্দার মতে, মোরে হয়ে মাদক, সোনা ইত্যাদি পাচারে সব পক্ষের বিপুল লাভ। তাই মোরের দখল কেউ ছাড়বে না।
কুকিরা অবশ্য বলছেন, তাঁরা মোটেই বিদেশি অস্ত্র নিয়ে লড়ছেন না। কুকি বাহিনীর এক কমান্ডার জানান, এই সব ইম্প্রোভাইজ্ড মর্টার, আরপিজি সব তাঁদের তৈরি! কুকি-চিন গোষ্ঠী প্রাচীনকাল থেকেই কলকব্জার কাজে দক্ষ। ১৯১৭-১৯ সালে ইংরেজ-কুকি লড়াইয়ের সময় থেকে তারা গেরিলা যুদ্ধেও দক্ষ হয়ে ওঠে। সীমিত সরঞ্জাম দিয়ে বন্দুক গড়ে তারা ব্রিটিশকে টক্কর দিয়েছিল। সেই দক্ষতাই বংশানুক্রমে প্রবাহিত। তাই পাড়ায় পাড়ায় তৈরি হয়েছে অস্ত্র গড়ার কারখানা। গর্বিত কমান্ডারের সহাস্য মন্তব্য, ‘হামলোগো কাআত্মনির্ভর ভারত।’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy