চিন্তিত পদ্মশিবির। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
আচমকা ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ বললেও অত্যুক্তি হবে না। একই সপ্তাহে জোড়া আক্রমণ রাজ্যের আপাত-নিস্তরঙ্গ নির্বাচনী আবহে কার্যত ঝড় এনে দিয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে রাজ্যপালের বিরুদ্ধে রাজভবনের অস্থায়ী কর্মীর শ্লীলতাহানির অভিযোগ ঘিরে হইচই। তার ধাক্কা কাটতে না কাটতেই শনিবার সন্দেশখালিতে গোপন ক্যামেরা অভিযানে তোলা ভিডিয়ো ভাইরাল হয়ে যাওয়া (সেই ভিডিয়োর সত্যতা অবশ্য যাচাই করেনি আনন্দবাজার অনলাইন)।
সেই ভিডিয়োতে এক মহিলাকে কথা বলতে দেখা গিয়েছে। শোনা যাচ্ছে, তিনি দাবি করেছেন, তাঁকে ধর্ষণ করেননি শাহজাহানরা। বিজেপি নেতারা তার মোকাবিলায় নানা কথা বলেছেন। কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি গতিতে ওই ভিডিয়ো চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। শাসক তৃণমূল তা নিয়ে প্রচারে একটুও সময় নষ্ট করেনি। আক্রমণ শানাতে শুরু করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সাংবাদিক বৈঠক করে তোপ দেগেছেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। সন্দেশখালি নিয়ে বিজেপির যাবতীয় দাবির আড়ালে যে ‘পরিকল্পিত চিত্রনাট্য’ রয়েছে, সেই প্রচারকে জাতীয় স্তরে নিয়ে যেতে রবিবার দিল্লিতেও সাংবাদিক বৈঠক করেছে ঘাসফুল।
প্রকাশ্যে স্বীকার করছেন না দলের নেতারা। বরং তাঁরা নানা ভাবে ভিডিয়োটিকে ‘অস্বীকার’ করারই রাস্তা নিয়েছেন। কিন্তু তৃণমূলের আগ্রাসী আক্রমণের মুখে পদ্মশিবিরে আলোড়ন পড়েছে। দলে দোষারোপের পালাও চলছে। এই প্রচারের জবাব কোন পথে এবং কী ভাবে দেওয়া হবে, তা নিয়েও চলছে নিরন্তর ভাবনা। কারণ, বিজেপির শঙ্কা, এখনও বাকি ৩৬টি আসনের ভোটে এর প্রভাব পড়তে পারে।
তৃণমূল শিবিরে যখন কুণাল ঘোষ সংক্রান্ত ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে ‘সামাল-সামাল’ রব উঠেছে, তখনই আচমকা রাজভবনের ঘটনা প্রকাশ্যে। সরাসরি বিজেপির সঙ্গে যোগ না-থাকলেও রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসকে ‘কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের প্রতিনিধি’ হিসেবেই চিহ্নিত করে তৃণমূল। বোসের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ ওঠার পরে তারা দ্বিগুণ উৎসাহে ময়দানে নামে। সেখান থেকেই খানিক ‘অস্বস্তি’ শুরু হয় বিজেপি শিবিরে। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীও খুব জোরালো ভাবে ওই অভিযোগের মোকাবিলা করতে পারেননি।
বস্তুত, রাজভবনের ঘটনা নিয়ে প্রাথমিক ভাবে বিজেপি নাকও গলাতে চায়নি। দলের বক্তব্য ছিল, রাজভবন ও রাজ্যপালের তরফে যা বলার বলা হবে। এর সঙ্গে দলের সম্পর্ক নেই। তবে তৃণমূল ‘সাজানো রাজনীতি’ করছে বলে অভিযোগ তোলা হয়। কিন্তু সন্দেশখালিতে নারীনিগ্রহের যে অভিযোগকে দিল্লিবাড়ির লড়াইয়ে অন্যতম প্রধান অস্ত্র বানিয়েছে বিজেপি, যে কথা প্রচারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও বলছেন। সেখানে রাজভবনের বিরুদ্ধে ওই অভিযোগ নির্বাচনে বিজেপির ক্ষতি করতে পারে বলে দলের অনেকে মনে করছেন। এক রাজ্য নেতার কথায়, ‘‘তৃণমূল যে ভাবে রাজ্যপালকে অপমান করছে, সেটা কাম্য নয়। বড় নেতারা মঞ্চ থেকে বলছেন আর পাড়ায় পাড়ায় তৃণমূল কর্মীরা আরও জঘন্য ভাষায় প্রচার করছে। সেটা ভোটে প্রভাব ফেলতেই পারে।’’ তবে পাশাপাশিই ওই নেতার দাবি, ‘‘মানুষ এখন আর তৃণমূলকে ততটা বিশ্বাস করে না।’’
রাজভবন বিতর্কের মধ্যেই আশঙ্কা বাড়িয়েছে সন্দেশখালি নিয়ে ভাইরাল ভিডিয়ো। ২০১৬ সালে বিজেপি বিধানসভা নির্বাচনের মধ্যেই নারদাকাণ্ড প্রকাশ্যে এনেছিল বিজেপি। চাপে পড়ে গিয়েছিল তৃণমূল। তবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ভোটে তার বিশেষ প্রভাব পড়তে দেননি। এ বার নির্বাচনের মধ্যে বিজেপিকে ফ্যাসাদে ফেলা সন্দেশখানিতে গোপন ক্যামেরা অভিযানের জবাব কি শুভেন্দু দিতে পারবেন? এমন প্রশ্ন ঘুরছে বিজেপির অন্দরে। দলের একাংশ মনে করছে, কোনও ক্ষত তৈরি হলে তাতে প্রলেপ শুভেন্দুকেই দিতে হবে। কারণ, প্রথম থেকে সন্দেশখালির বিষয়টি তিনিই দেখেছেন। ভিডিয়োতেও বার বার শুভেন্দুরই নাম এসেছে।
গোপন ক্যামেরায় তোলা ভিডিয়োয় স্থানীয় বিজেপি নেতা গঙ্গাধর কয়াল দাবি করেছেন, গত কয়েক মাসে সন্দেশখালিতে ওঠা ধর্ষণের অভিযোগগুলি ‘সাজানো’ ছিল! টাকার বিনিময়ে ধর্ষণের অভিযোগ করেছিলেন মহিলারা। তাঁর দাবি, সবটাই বিরোধী দলনেতা শুভেন্দুর ‘মস্তিষ্কপ্রসূত’। তবে তার পরে পরেই শুভেন্দু ওই ভিডিয়োকে ‘জাল’ বলে তাঁর এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে পোস্ট করেছিলেন। শুধু তা-ই নয়, রাজ্য বিজেপির উদ্যোগে গঙ্গাধরকে দিয়ে একটি ভিডিয়ো বানানো হয়। সেখানে তিনি দাবি করেন, তাঁকে নিয়ে তৈরি ভিডিয়োয় গলার স্বর ‘বিকৃত’ করা হয়েছে। ওই সব কথা তাঁর নয়। গঙ্গাধরকে দিয়ে সিবিআইয়ের কাছে তদন্তের দাবিতে চিঠিও লেখানো হয়। সেই চিঠিতে ওই পুরো ঘটনার সিবিআই তদন্তের দাবি জানিয়েছেন গঙ্গাধর।
তবে এর পরেও কাঙ্ক্ষিত ‘স্বস্তি’ নেই বিজেপি শিবিরে। অনেকেই মনে করছেন, তৃণমূল যে ভাবে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে, তাতে জনমানসে তার প্রভাব পড়তে পারে। আর তার মোকাবিলায় দলের যেমন পদক্ষেপ করা দরকার ছিল, তা এখনও পর্যন্ত হয়নি। এই পরিস্থিতিতে কঠোর পদক্ষেপের চেয়েও সঠিক কৌশল নির্ধারণ জরুরি। যাঁরা এই মনোভাবাপন্ন, তাঁদেরই এক জন রবিবার বলেন, ‘‘সন্দেশখালির ঘটনা নিয়ে বাংলায় তো বটেই, গোটা দেশেও প্রচার হয়েছে। এখন তৃণমূল বিষয়টাকে জাতীয় স্তরে নিয়ে যেতে চাইছে। ফলে ক্ষতি শুধু বাংলায় হতে পারে, এমন ভাবা ঠিক নয়। বিজেপির সামগ্রিক ভাবমূর্তিতেও ওই প্রচার আঘাত হানতে পারে।’’ ওই নেতার আরও বক্তব্য, ‘‘নির্যাতিতা হিসাবে রেখা পাত্রকে প্রার্থী করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন। প্রচারেও তা বলা হয়েছে। তাই ভাইরাল ভিডিয়োর মোকাবিলার পথ দ্রুত খুঁজতে হবে। জুতসই জবাব না দিতে পারলে বাকি পাঁচ দফার ভোটে তার ছাপ পড়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy