গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
হরিয়ানায় ‘গেরুয়া ঝড়’ রুখে দিল কংগ্রেস। গান্ধী পরিবারের ‘জাঠ নীতি’তে পাঁচটি আসন খোয়াল বিজেপি! রাজ্যের অর্ধেকাংশই গেল ‘হাতের’ দখলে।
আগের দশক পর্যন্তও হরিয়ানায় ‘প্রান্তিক শক্তি’ হিসাবেই বিবেচিত হত বিজেপি। হাওয়া ঘোরে ২০১৪ সালের ভোটে। রাজ্যের ১০টি লোকসভা আসনের মধ্যে আটটি আসনে লড়ে সাতটিতে জিতেছিল তারা। পেয়েছিল ৩৪ শতাংশ ভোট। মাত্র একটি আসনে জয়লাভ করেছিল কংগ্রেস। সেই বছরই প্রথম বার ‘মোদী ঝড়ে’ বিধানসভা ভোটেও হরিয়ানার মসনদ দখল করে বিজেপি। পকেটে ৩৩ শতাংশ ভোট এবং ৪৭টি আসন। ২০০৯ সালের থেকে ৪৩টি বেশি। এর পর ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে ১০টি আসনেই জেতেন মোদী-শাহেরা। ৫৮ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন তাঁরা। এ বার রাজ্যের ১০টি আসনের মধ্যে পাঁচটিতে জেতে কংগ্রেস। বিজেপি জিতেছে পাঁচটিতে। তাদের ভোট শতাংশ কমে ঠেকল ৪৬ শতাংশে। কংগ্রেসের ভোট শতাংশ বেড়ে হল প্রায় ৪৪ শতাংশ। অর্থাৎ, মাত্র দু’শতাংশের ফারাক।
অনেকের মতে, গত বার মোদীর ব্যক্তিত্ব, ভোটের আগে পুলওয়ামায় জঙ্গি-হামলা ও বালাকোট অভিযানের পর দেশভক্তি আর হিন্দুত্বের মিশেল ঘটিয়ে বিজেপি যে ভাবে প্রচার করেছিল, তাতেই ওই ফল ফলেছিল। কিন্তু এ বার যে পরিস্থিতি তেমন নয়, তা আগে থেকেই আঁচ করেছিল বিজেপি। তাই প্রতিষ্ঠানবিরোধী হাওয়ার প্রভাব আটকাতে ভোটের আগে তড়িঘড়ি মুখ্যমন্ত্রী বদলও করেছিল তারা। কিন্তু ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের দাবিতে কৃষক আন্দোলনের জেরে জনরোষ ছিল। কৃষক আন্দোলনের হাত থেকে দিল্লিকে বাঁচাতে হরিয়ানাকে যে ভাবে ‘বাফার স্টেট’ হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে, তাতেও কৃষিজীবী জাঠ সমাজের ক্ষোভ বেড়েছিল। পাশাপাশি, কেন্দ্রীয় সরকারের ‘অগ্নিপথ’ প্রকল্প নিয়েও ক্ষুব্ধ জাঠ সম্প্রদায়। উত্তর ভারতের রাজ্যগুলির মধ্যে হরিয়ানার যুবকদের সেনায় যোগদানের হার বরাবরই বেশি। বছর দুয়েক আগে যখন অগ্নিবীর প্রকল্পের মাধ্যমে সেনায় নিয়োগের কথা ঘোষণা করে কেন্দ্র, তখন বিহার, উত্তরপ্রদেশ, হিমাচল, পঞ্জাবের মতো হিংসাত্মক প্রতিবাদ হয়েছিল হরিয়ানাতেও।
সেই জাঠ রোষকে কাজে লাগিয়েই জমি পুনরুদ্ধারে নেমেছিল আঞ্চলিক দলগুলি। অন্য গোষ্ঠীকে না-চটিয়ে জাঠ-জাত্যাভিমানকে জাগিয়ে তোলার কাজ করে গিয়েছে কংগ্রেসও। হরিয়ানায় ৩৬টি সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস। জাঠেরা সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি। কিন্তু ক্ষমতা দখলের জন্য বাকি ৩৫ সম্প্রদায়কে জাঠেদের বিরুদ্ধে বিজেপি উস্কেছে বলে দাবি কংগ্রেসের। কৃষকদের দাবি মেটানোর পাশাপাশি কংগ্রেস এমনও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে, কেন্দ্রের ক্ষমতা দখল করলে তারা অগ্নিবীর প্রকল্প বাতিল করবে।
বিজেপি অবশ্য কখনওই পুরোপুরি জাঠেদের মন জয়ের চেষ্টা করেনি। সেই কারণে ২০১৪ সালে রাজ্যে ক্ষমতা দখলের পর মুখ্যমন্ত্রী পদে ‘অ-জাঠ’ নেতা মনোহরলাল খট্টরকে বসানো হয়। ২০১৯ সালের নির্বাচনে দেশ জুড়ে জাতীয়তাবাদী হাওয়ায় জাঠেদের মন খানিক গললেও তা চিরস্থায়ী হয়নি। ওই বছরেই বিধানসভা নির্বাচনে তার ফল দেখা গিয়েছিল। এক ধাক্কায় বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের হার ৪০ শতাংশের নীচে নেমে গিয়েছিল। পদ্মশিবিরের বক্তব্য, মোদী-শাহেরা জানেন পানিপথ, কার্নাল, কুরুক্ষেত্র, যমুনানগর, অম্বালা, পাঁচকুলা হয়ে জিটি রোড বরাবর চণ্ডীগড় পর্যন্ত তারা এগিয়ে। পিছিয়ে রোহতক, ঝজ্জর, সোনেপত, জিন্দ, হিসারের মতো জাঠ-অধ্যুষিত এলাকায়। এ বার জাঠেদের মন পেতে জাঠ-রাজনীতির ‘প্রাণকেন্দ্র’ বলে পরিচিত রোহতকে সভাও করেছিলেন মোদী। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ফল মিলল না।
রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা ভূপেন্দ্র সিংহ হুডার পুত্র তথা দলের রাজ্যসভা সাংসদ দীপেন্দ্র হুডাকে রোহতক আসনে প্রার্থী করেছিল কংগ্রেস। তিনি বিজেপি প্রার্থীকে প্রায় সাড়ে তিন লাখ ভোটে হারিয়ে দিয়েছেন। ভূপেন্দ্রের প্রস্তাব মেনে সোনেপতে আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব সতপাল ব্রহ্মচারীকে প্রার্থী করেছিল কংগ্রেস। সতপাল ইতিমধ্যেই জাতীয় রাজনীতিতে ‘কংগ্রেসের যোগী’ বলে পরিচিতি পেয়েছেন। ২০০৩ সালে উত্তরাখণ্ডে হড়পা বানের কবলে পড়েছিল হুডার গাড়ি। পিলি নদীর জলের তোড়ে ভেসে যাওয়া প্রবীণ কংগ্রেস নেতা হুডাকে সে দিন উদ্ধার করেছিলেন উত্তরাখণ্ডের সতপাল। হুডার সঙ্গে যোগাযোগের সুবাদেই কংগ্রেসে আসা তাঁর। সোনেপতে তাঁর কিছু আশ্রমও রয়েছে। সেই সূত্রেও পরিচিতি রয়েছে সতপালের। ভোটেও তিনি জিতলেন। গুরুগ্রাম আসনে আবার রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী রাও বীরেন্দ্র সিংহের পুত্র তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ইন্দ্রজিৎ সিংহকে প্রার্থী করেছিল বিজেপি। ২০০৯ সালের ভোটে ওই আসনে ইন্দ্রজিৎ জিতেছিলেন কংগ্রেসের টিকিটে। পরে তিনি বিজেপিতে যোগ দেন। ২০১৪ এবং ২০১৯ পর পর দু’বার ওই আসন থেকে জিতে পদ্মের সাংসদ হয়েছিলেন তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে কংগ্রেস দাঁড় করিয়েছিল অভিনেতা রাজ বব্বরকে। তিনি হেরেছেন প্রায় ৭৫ হাজার ভোটে।
হরিয়ানার রাজনীতিতে জাঠেদের প্রাধান্য বরাবরই বেশি। এক সময় জাঠ সম্প্রদায়ভুক্ত ‘লাল’ পদবিধারীরাই রাজ্য-রাজনীতির নিয়ন্ত্রক ছিলেন। যাঁদের মধ্যে অন্যতম দেবীলাল, ভজনলাল এবং বংশীলাল। তিন জনেই কখনও না কখনও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। ধীরে ধীরে অবশ্য তাঁদের দাপট কমেছে। শক্তিশালী হয়েছে অন্য গোষ্ঠী। কিন্তু হরিয়ানার রাজনীতি থেকে কখনওই মুছে যাননি জাঠেরা। এই লোকসভা নির্বাচনেও দেশের প্রাক্তন উপমুখ্যমন্ত্রী দেবী লালের এক ছেলে ও দুই পুত্রবধূ ভোটযুদ্ধে নেমেছিলেন হিসার কেন্দ্রে। সেখানে বিজেপি প্রার্থী করেছিল দেবীলালের পুত্র রঞ্জিত সিংহ চৌটালাকে। একদা দেবীলাল প্রতিষ্ঠিত ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল লোকদল’ (আইএনএলডি) প্রার্থী করেছিল দলের মহিলা শাখার সম্পাদক সুনয়না চৌটালাকে। সুনয়না দেবীলালের কনিষ্ঠ পুত্র প্রতাপ সিংহ চৌটালার পুত্র রবি চৌটালার স্ত্রী। অন্য দিকে, আইএনএলডি ভেঙেই তৈরি হওয়া নতুন দল ‘জননায়ক জনতা পার্টি’র (জেজেপি) প্রার্থী হয়েছিলেন দেবীলালের আর এক পুত্র তথা হরিয়ানার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমপ্রকাশ চৌটালার পুত্র অজয় সিংহ চৌটালার স্ত্রী নয়না চৌটালা। কিন্তু শেষ হাসি হাসলেন কংগ্রেসের জয় প্রকাশ। তিনি জিতলেন প্রায় ৬৩ হাজার ভোটে।
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে হিসার আসনে জয়ী হয়েছিলেন নয়নার পুত্র তথা হরিয়ানার প্রাক্তন উপমুখ্যমন্ত্রী দুষ্মন্ত চৌটালা। আইএনএলডি-র প্রতীকে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। ২০১৯ সালে দুষ্মন্ত বিজেপি প্রার্থী ব্রিজেন্দ্র সিংহের কাছে হেরে যান। আমলা থেকে রাজনীতিক হওয়া ব্রিজেন্দ্র লোকসভা ভোটের আগেই কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁকে হিসারে প্রার্থী করা হতে পারে বলে জল্পনাও তৈরি হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস টিকিট দিয়েছিল হিসারেরই তিন বারের প্রাক্তন সাংসদ জয় প্রকাশকে। যিনি ১৯৯০ সালে প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখরের মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন।
এক সময় হরিয়ানার রাজ্য রাজনীতির অন্যতম নিয়ন্ত্রক আইএনএলডি ২০১৯ সালে আড়াআড়ি ভাবে বিভক্ত হয়ে যায়। ওমপ্রকাশের পুত্র অজয় চৌটালা এবং তাঁর পরিবারের সদস্যেরা তৈরি করেন নতুন দল জেজেপি। পুরনো দলে রয়ে যান ওমপ্রকাশ এবং তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র অভয় চৌটালা। এ বার কুরুক্ষেত্র আসনে অভয় আইএনএলডি-র প্রার্থী ছিলেন। ২০১৯ সালের ভোটে ওই আসনে অভয়ের কনিষ্ঠ পুত্র অর্জুন দাঁড়িয়েছিলেন। জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল তাঁর। এ বার অভয়ের প্রতিপক্ষ ছিলেন শিল্পপতি নবীন জিন্দল। যিনি এই আসনে কংগ্রেসে টিকিটে জিতে সাংসদ হয়েছিলেন। তবে ২০১৪ সালের ভোটে হেরে যান। এ বার নবীনকে বিজেপি টিকিট দিয়েছে।
হরিয়ানায় এ বার বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র দুই শরিক কংগ্রেস এবং আপের মধ্যে আসন ভাগাভাগি হয়েছিল। রাজ্যের মধ্যে একমাত্র কুরুক্ষেত্র আসনেই আপ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। অরবিন্দ কেজরীওয়ালের দল টিকিট দিয়েছিল ব্যবসায়ী সুশীলকুমার গুপ্তকে। তাঁকে প্রায় ৩০ হাজার ভোটে হারিয়েছেন নবীন।
গত বারের ভোটে কুরুক্ষেত্রে জিতেছিলেন বিজেপির নবাব সিংহ সাইনি। ওবিসি সম্প্রদায়ের সাইনি বর্তমানে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। আর সদ্যপ্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী খট্টরকে জাতীয় রাজনীতিতে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেন মোদী, অমিত শাহেরা। খট্টরকে কার্নাল লোকসভা কেন্দ্রের প্রার্থী করেছিল বিজেপি। ওই আসনে কংগ্রেসের প্রার্থী ছিলেন দিব্যাংশু বুদ্ধিরাজা। ওই আসনে দু’লাখেরও বেশি ভোটে জিতেছেন খট্টর।
২২ জেলার হরিয়ানায় মোট ৯০টি বিধানসভা কেন্দ্র রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে যেমন প্রতিটি লোকসভা কেন্দ্রের আওতায় সাতটি বিধানসভা কেন্দ্র, তেমনই হরিয়ানায় এক একটি লোকসভা কেন্দ্র তৈরি হয়েছে ন’টি করে বিধানসভা কেন্দ্র দিয়ে। বাংলার মতো হরিয়ানাতেও কোনও কোনও লোকসভা কেন্দ্রের বিস্তার দু’টি জেলা জুড়ে। কোথাও কোথাও আবার তিন-চারটি, এমনকি, পাঁচটি জেলা জুড়েও। রাজ্যের দক্ষিণ-পশ্চিমের ভিওয়ানি-মহেন্দ্রগড় লোকসভা কেন্দ্রটিই যেমন তিনটি জেলা জুড়ে। ২০০৯ সালের লোকসভা ভোটের সময় তৈরি হওয়া এই আসনে (আগে আসনটির নাম ছিল ভিওয়ানি) প্রথম বার জিতেছিলেন কংগ্রেস নেত্রী তথা বংশীলালের নাতনি শ্রুতি চৌধরি। হারিয়েছিলেন ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল লোক দলের (আইএনএলডি) অজয় চৌটালাকে। ২০১৪ সালে দেশে ‘পরিবর্তন’-এর হাওয়ায় আসনটি হারায় কংগ্রেস। ২০১৪ এবং ২০১৯ সালে পর পর দু’বার ওই আসন থেকে জেতেন বিজেপির ধর্মবীর সিংহ। দ্বিতীয় হন শ্রুতি। এ বারের ভোটেও ধর্মবীরকেই প্রার্থী করেছিল পদ্মশিবির। আর কংগ্রেস টিকিট দিয়েছিল মহেন্দ্রগড়ের বিধায়ক রাও দান সিংহকে। তিনি হেরেছেন। আসনটি দখল করেছে বিজেপি।
দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক কুমারী শৈলজাকে এ বার সিরসা কেন্দ্রে প্রার্থী করেছিল কংগ্রেস। শৈলজা অম্বালার দু’বারের সাংসদ ছিলেন। ২০১৯ সালে ওই আসনে তিনি বিজেপির রতনলাল কাটারিয়ার কাছে হেরে যান। এ বার অম্বালায় প্রয়াত রতনলালের স্ত্রী বান্টো কাটারিয়াকে টিকিট দিয়েছিল পদ্মশিবির। কংগ্রেস প্রার্থী করেছিল বরুণ চৌধরিকে। শৈলজাকে পাঠানো হয়েছিল একদা তাঁর পিতা চৌধরি দলবীর সিংহের লোকসভা কেন্দ্র সিরসায়। তাঁর বিরুদ্ধে বিজেপি টিকিট দিয়েছিল অশোক তনওয়ারকে। অশোকও এক সময়ে কংগ্রেসেই ছিলেন। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ভূপেন্দ্র সিংহ হুডার সঙ্গে দ্বন্দ্বের জেরে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির পদ যায় তাঁর। পরে দলও ছাড়েন। যোগ দেন তৃণমূলে। তার পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল ছেড়ে কেজরীর আপেও নাম লিখিয়েছিলেন। কিন্তু এক মাসের মধ্যেই সম্পর্ক ছিন্ন করে বিজেপিতে যোগ দেন। কিন্তু লাভ হল না। আড়াই লাখের বেশি ভোটে আসনটি দখল করেছেন শৈলজা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy