অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল ছবি।
ইংরেজি বছরের শেষ সন্ধ্যা। অফিস কমপ্লেক্সের ঘরে একটি মাত্র বিধানসভা কেন্দ্রের কাটাছেঁড়া চলছে। সতীর্থের সঙ্গে তাঁর রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা সেরে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় যখন উঠলেন, পার্ক স্ট্রিট তো বটেই, গোটা শহর তখন উৎসবে উদ্দাম।
যে বছর বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস তৃতীয় বার ক্ষমতায় ফিরেছে, সেই বছরের বর্ষবরণের সন্ধ্যায় সতীর্থের সঙ্গে এই অঙ্ক চলছিল আড়াই বছর পরে, ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের একটি ‘বেহাল’ বিধানসভা কেন্দ্রের প্রস্তুতি নিয়ে। সেই সতীর্থ মঙ্গলবার বললেন, “উনি অঙ্কে বিশ্বাস করেন, আবেগে নয়। দলে অভিষেকের নিজের কোনও লোক নেই! ওঁর কাজের লোক আছে।” ফল ঘোষণার পরে পাশে বসিয়ে তাঁকে স্বীকৃতি দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বললেন, “এ বারের ভোটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল অভিষেকের।”
সাংগঠনিক দায়িত্ব আগেই অভিষেকের হাতে তুলে দিয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী। এ বারের লোকসভা ভোটের সাফল্যের পরে দলের রাজনৈতিক ‘ব্যাটন’ও কার্যত ৩৬ বছরের নবীন সাংসদের হাতে চলে গেল। ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চের বৈঠকে তাঁকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত ঘোষণায় মমতার সেই বার্তাও স্পষ্ট হল। এই সাফল্যের পরে অভিষেক অবশ্য নেত্রী মমতাকেই সামনে রেখেছেন। কালীঘাটের অফিস ঘর থেকে মঙ্গলবার সাংবাদিক বৈঠকে আসার সময়ে মমতার পিছনে ছিলেন। ঘণ্টাখানেকের সেই বৈঠকে কোলের উপরে হাত জড়ো করে ছিলেন অনুগত নীরব শ্রোতার মতোই। বিরোধীরা প্রশ্ন তুললেও নিজের কেন্দ্রে রাজ্যের ইতিহাসে সব চেয়ে বড় ব্যবধানের জয়ও দলের অন্দরে অভিষেকের ‘কর্তৃত্ব’ প্রশ্নহীন করে তুলল। ডায়মন্ড হারবারে অভিষেক জিতেছেন ৭ লক্ষ ১০ হাজার ভোটে!
নিজের কেন্দ্রে কাউকে দাঁত ফোটাতে না দেওয়া বা সংগঠনের হাল ধরাই শুধু নয়, অভিষেক ‘কৃতিত্ব’ দেখিয়েছেন আরও এক দিকে। রাজ্যে ২০২১ সালে বিধানসভা ভোটের সময়ে তাঁর পূর্বাভাস ছিল, বিজেপি ৭৫ থেকে ৭৭-এ আটকে যাবে। বিজেপি পেয়েছিল ৭৭! এ বারও শেষ পর্বের ভোট মেটার আগেই বলেছিলেন, তৃণমূল ৩১ আসনে জয়ী হবে। ফল বেরোনোর পরে দেখা গেল, তৃণমূল পেয়েছে ২৯টি আসন। এক সময়ে তারা ৩১টিতেই এগিয়ে ছিল!
তৃণমূলের আদি কালের নেতাদের অনেকেরই অভিষেকের কাজের ‘ধরন’ নিয়ে আপত্তি আছে। মমতার সঙ্গে কাজ করে অভ্যস্ত নেতাদের সেই ধারণা আগেই পিছনে ফেলে দিয়েছেন অভিষেক। সেই সূত্রেই এ বার দলের বেশ কয়েক জন প্রার্থী নিয়ে আপত্তি ছিল তাঁর। তবে ‘দিদি’র পছন্দে সায় দিয়ে এগিয়েছিলেন ‘স্যর’। এই রকম গুটিকতক আসন বাদ দিলে দলের ৩৭ জন প্রার্থী বেছে এবং প্রত্যাশা ছাপানো জয় এনে এই তরজায় ইতি টেনে দিয়েছেন তৃণমূলে মমতার উত্তরসূরি। দলের এক নেতার কথায়, “২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনেও অভিষেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন। তবে এ বার প্রার্থী বাছাই, প্রচার পরিকল্পনা, বুথ-ভিত্তিক সংগঠন সচল রাখার মতো সব কাজে সমন্বয় করেছেন। ফলে এই কৃতিত্ব তাঁর প্রাপ্য।” রাজ্যে ২০২১ সালে তৃণমূল নেতা সুখেন্দুশেখর রায় দলের ভাবনার সঙ্গে যে ‘বহিরাগত’ শব্দটি স্লোগানে এনেছিলেন, এ বার অভিষেক তাকে ‘বাংলা-বিরোধীদের বিসর্জন’ পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছেন।
এক সময় রাজনৈতিক আবেগকে পুঁজি করেই তৃণমূলকে নিয়ে এগিয়েছেন মমতা। গত ২০২০-২১ থেকে তার সঙ্গে অঙ্ক জুড়তে শুরু করেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক। তাঁর এই প্রক্রিয়ায় পুরনো নেতাদের অনেকেই ছিটকে গিয়েছেন মূল স্রোত থেকে। তা নিয়ে কানাঘুষো চললেও ‘নির্মম’ অভিষেক এগিয়েছেন নিজের মতোই। সেই অঙ্কেই একেবারে ব্লক ধরে সাংগঠনিক খামতি, জনসমর্থনের অভাব ও উন্নয়নের প্রয়োজন চিহ্নিত করার প্রক্রিয়া চালিয়েছে তাঁর নিযুক্ত পরামর্শদাতা সংস্থা। এবং তার ভিত্তিতেই প্রার্থী বাছাই করেছেন তিনি। পাশাপাশি, ২০১৯ সালে বিরোধীদের হাতে চলে যাওয়া ২৩টি লোকসভা আসনেই ‘নজর’ দিয়েছিলেন তিনি।
এ দিন হাতের আঙুলে বিজয় চিহ্ন দেখানোর সময় মমতা যে ভাবে তাঁর ‘সেনাপতি’র কাঁধে হাত রেখে ছবি তুলেছেন, তা তৃণমূলের রাজনীতির ভবিষ্যতের প্রতীক হিসেবেই ধরা পড়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy