গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
বাজারে আলুর দরবৃদ্ধি নিয়ে সরব হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর নির্দেশ অমান্য করে আলু বাইরের রাজ্যে পাঠানো হয়েছিল বলেই খুচরো বাজারে দাম বেড়েছে, এমন মন্তব্য করে বৃহস্পতিবার ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন তিনি। কিন্তু আলু কারবারিদের একাংশের মত, ‘রফতানি’ করার জন্য আলুর দাম বাড়েনি। বেড়েছে অন্য কারণে। তার সঙ্গে ‘রফতানি’র কোনও যোগ নেই। বরং, মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে নবান্নে প্রশাসনিক বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন, তাতে আগামী দিনে আলু বাইরে পাঠানো বন্ধ হলে বড় ক্ষতির মুখে পড়তে হতে পারে রাজ্যের চাষি এবং কারবারিদের! এমনটাই মত ওই অংশের।
গত বছর আলুর দাম সে ভাবে না-পাওয়ায় লোকসানের মুখে পড়তে হয়েছিল রাজ্যের আলু চাষিদের একটা বড় অংশকে। গত বছর নভেম্বরে খুচরো বাজারে ২২ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছিল জ্যোতি আলু। কিন্তু এ বছর আলুর দাম চড়া। শুক্রবার রাজ্যের খুচরো বাজারে আলুর দাম কেজিপ্রতি ৩০-৩৫ টাকার আশপাশে ঘোরাফেরা করেছে। দাম বৃদ্ধির জেরে স্বাভাবিক ভাবেই মধ্যবিত্তের হেঁশেলে টান পড়েছে। তা নিয়ে বৃহস্পতিবার মুখ্যমন্ত্রী যে কথা বলেছেন, তাতে খানিক আশঙ্কিত আলু ব্যবসায়ীরা। তাঁদের বক্তব্য, এখনও রাজ্যের হিমঘরগুলিতে যথেষ্ট পরিমাণে আলু মজুত রয়েছে। সরকারি নির্দেশ রয়েছে, আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে হিমঘর থেকে ওই আলু বার করে নিতে হবে। এই পরিস্থিতিতে ভিন্রাজ্যে আলু পাঠানো বন্ধ হলে লোকসানের মুখে পড়তে হবে তাঁদের।
মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ মতো শুক্রবার নবান্নে টাস্ক ফোর্সকে নিয়ে বৈঠকে বসেছিলেন মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ। ওই বৈঠকে ছিলেন রাজ্যের কৃষি বিপণন দফতরের মন্ত্রী বেচারাম মান্না। আনাজের দামের সার্বিক পরিস্থিতির উপর নজর রাখার দায়িত্ব তাঁকেই দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। নবান্নের বৈঠক নিয়ে কৃষি বিপণন দফতর সূত্রে অবশ্য খবর, ভিন্রাজ্যে আলু ‘রফতানি’তে এখনই কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই! প্রশাসনিক সূত্রে এই খবর মিললেও বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন বলেই দাবি আলু ব্যবসায়ীদের একাংশের। তাঁদের অভিযোগ, মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের সীমানাগুলিতে নজরদারি বৃদ্ধির নির্দেশ দেওয়ার পরেই শুক্রবার রাজ্যের বিভিন্ন সীমানায় আলুবোঝাই গাড়ি আটকানো হয়েছে। জলপাইগু়ড়ির ধূপগুড়িতে অসম সীমানায় এ রকম ঘটনা ঘটেছে। পরে সেই গাড়ি ছেড়ে দেওয়া হলেও ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, এর পর আলুর গাড়ি আর যেতে দেওয়া হবে না।
আলু কারবারিদের একাংশ জানাচ্ছেন, এ রাজ্যে অন্তত ৫০০টি হিমঘরে আলু সংরক্ষণ করা হয়। চলতি বছরে ওই ৫০০টি হিমঘরে সব মিলিয়ে ১২ কোটি ৫৫ লক্ষ ৪ হাজার ২৪৩ বস্তা আলু সংরক্ষণ করা হয়েছিল। তার মধ্যে ৯ কোটি ৪১ লক্ষ ২৬ হাজার ২৪১ বস্তা আলু বার করা হয়েছিল অক্টোবরের শেষ পর্যন্ত। অর্থাৎ, অক্টোবরের শেষেও আলু মজুত ছিল প্রায় ৩ কোটি ১৪ লক্ষ বস্তা। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২১ নভেম্বর পর্যন্ত মোটামুটি ১ কোটি ৬৫ লক্ষ বস্তা মজুত ছিল। কারবারিদের দাবি, নতুন আলু বাজারে না-আসা পর্যন্ত ওই পরিমাণ আলু এ রাজ্যের প্রয়োজনের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি। ফলে ভিন্রাজ্যে আলু ‘রফতানি’ যদি এখনই বন্ধ হয়ে যায়, তা হলে মজুত আলুর একটা বড় অংশ নষ্ট হবে।
রাজ্য প্রগতিশীল আলু ব্যবসায়ী সমিতির পূর্ব বর্ধমান জেলা কমিটির সভাপতি উত্তম পাল বলেন, ‘‘বর্তমান পরিস্থিতিতে যদি বিহার বা ঝাড়খণ্ডে আলু না যায়, তা হলে সবচেয়ে সমস্যায় পড়বেন আলু চাষিরা। মজুত আলু বিক্রি করেই নতুন বীজ কেনা হয়। ফলে বীজ কিনতে না পারলে পরের বছরের উৎপাদনও মার খাবে।’’
একই কথা বলছেন পশ্চিমবঙ্গ প্রগতিশীল আলু ব্যবসায়ী সমিতির সহকারী সম্পাদক বরুণ পণ্ডিত। তাঁর কথায়, ‘‘পশ্চিম মেদিনীপুরে নিম্ন মানের আলুর চাষ হয়। সেই আলু মূলত ঝাড়খণ্ড, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, ওড়িশা, ছত্তীসগঢ়ে যায়। এই রফতানি বন্ধ হলে আলু চাষিদের বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।’’
গত অগস্ট মাসেও এক বার আলুর দামবৃদ্ধি নিয়ে সরব হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। আপত্তি জানিয়েছিলেন আলু ভিন্রাজ্যে পাঠানো নিয়েও। গুদামে আলু মজুত করে রেখে বাজারে দাম বাড়ানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছিলেন তিনি। নির্দেশ দিয়েছিলেন, রাজ্যের চাহিদা না-মেটা পর্যন্ত আলু বাইরে পাঠানো যাবে না। এর পর থেকেই আলুবোঝাই ট্রাক রাজ্যের বিভিন্ন সীমানায় আটকে রাখা হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলতে শুরু করেছিলেন ব্যবসায়ীরা। তার প্রতিবাদে কর্মবিরতিরও সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বিভিন্ন সংগঠন। ফলে হিমঘর খোলা থাকলেও আলু বাইরে বেরোচ্ছিল না। এতে আলুর দাম বাজারে আরও বাড়ে। কোথাও কোথাও তা কেজিপ্রতি ৪০-৪৫ টাকাও ছুঁয়ে গিয়েছিল। এর পরেই আলু কারবারিদের সঙ্গে বৈঠকে বসে সরকার। সমস্যাও মেটে। বাজারে আলুর দাম ৩০ টাকার কাছাকাছি হয়। সম্ভাবনা ছিল, নভেম্বরের দিকে আলুর দাম কমবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি।
শুক্রবার নবান্নে সেই বিষয় নিয়েও আলোচনা হয়েছে। সোমবারের মধ্যে খুচরো বাজারে আলুর দাম কমানোর লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে বৈঠকে। নবান্নের বৈঠকে ছিলেন প্রগতিশীল আলু ব্যবসায়ী সমিতির রাজ্য সম্পাদক লালু মুখোপাধ্যায়। তিনিও বলেন, ‘‘কলকাতার বিভিন্ন খুচরো বাজারে আলুর দাম নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সরকার। পাইকারি আলুর দাম কিছুটা কমানোর অনুরোধ করেছে তারা। এই বিষয়টি নিয়ে শনিবার ফের হুগলির হরিপালে সরকারের সঙ্গে আমাদের বৈঠক রয়েছে। আপাতত সিদ্ধান্ত হয়েছে, সোমবার পর্যন্ত নানা ভাবে খুচরো বাজারে আলুর দাম কমানোর চেষ্টা করা হবে। তার পরেও দাম না-কমলে সে ক্ষেত্রে আলোচনাসাপেক্ষে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করবে সরকার।’’
বৈঠক শেষে টাস্ক ফোর্সের বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী প্রদীপ মজুমদার বলেন, ‘‘রাজ্যে উৎপাদিত আলু রাজ্যবাসী ন্যায্য মূল্যে পাবেন না, এটা হতে পারে না। কৃষকদের কাছ থেকে আলু কিনে মজুত করে ব্যবসায়ীরা বেশি দামে বিক্রি করছেন। এই অসাধু মনোভাবে চুপ থাকতে পারে না সরকার।’’
মন্ত্রীর এই মন্তব্যের সঙ্গে অবশ্য একমত নন ব্যবসায়ীদের একাংশ। তাঁদের দাবি, বাজারে আলুর দামবৃদ্ধির কারণ ভিন্ন। ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, প্রতি বছর এই সময়ে পঞ্জাব-উত্তরপ্রদেশ থেকে নতুন আলু বাজারে আসে। এ রাজ্যেও পোখরাজ, এস-ওয়ান প্রজাতির আলুর ফলন হয়। ফলে বাজারে পুরনো আলুর চাহিদা কমতে থাকে। এ বারে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অতিবৃষ্টির ফলে আলু চাষ কিছুটা পিছিয়ে গিয়েছে। ভিন্রাজ্যের আলুও সে ভাবে বাজারে আসেনি। ফলে পুরনো আলু দিয়েই চাহিদা মিটছে এখন। আর চাহিদা রয়েছে বলেই দাম কমেনি এ বার।
কারবারিরা জানান, গত রবি মরসুমে চাষিদের কাছ থেকে ১৬ টাকা কেজি দরে কিনে হিমঘরে আলু মজুত করা হয়েছিল। এর পর হিমঘর ভাড়া, ভাল-খারাপ বাছাই করা, কাটা আলু বাদ দেওয়া ধরে কেজিপ্রতি দামে আরও ৮ টাকা যুক্ত হয়। অর্থাৎ, হিমঘরে মজুত করার সময়ে আলুর দাম হয় কেজিতে ২৪ টাকা। যে ব্যবসায়ী আলু মজুত করেন, তিনি দু’টাকা লাভ রেখে আলু বাজারে ছাড়েন। গাড়ি ভাড়া করে আলু বাজারে পৌঁছে দেওয়ার খরচ ধরে আলুর দাম হয় ২৮ টাকা। ওই টাকাতেই আলু কেনেন খুচরো বিক্রেতারা। এ বার তাঁরা যদি চার টাকা বা ছ’টাকা লাভ রাখতে চান, সে ক্ষেত্রে ৩২ টাকা কেজি দরে আলু বিকোবে বাজারে। ফলে আলুর উৎপাদন খরচ কমাতে না-পারলে খুচরো বাজারে আলুর দাম কমানো যে কার্যত অসম্ভব, তা জানিয়ে দিচ্ছেন ব্যবসায়ীদের ওই অংশ।
আলুর উৎপাদন খরচ না-কমালে দামও কমবে না বলেই দাবি কারবারিদের একাংশের। তাঁদের বক্তব্য, বাংলায় আলু চাষ মূলত পঞ্জাব নির্ভর। কারণ, পঞ্জাবের বীজ না-এলে ভাল আলুর ফলন হয় না এ রাজ্যে। সেই বীজের দাম সম্প্রতি কুইন্টালপ্রতি হাজারখানেক টাকা বেড়েছে। জ্যোতি আলুর বীজ ১৮০০-২০০০ টাকা হলে চাষিদের পক্ষে সুবিধে হত। কিন্তু সেই বীজ এখন কুইন্টালপ্রতি প্রায় তিন হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চন্দ্রমুখী চার হাজার টাকা। সারের দামও বেশি। সব মিলিয়ে এক বিঘা আলু চাষ করতে ৩০-৩৫ হাজার টাকা খরচ হয়। গড় উৎপাদন যদি ৭০ বস্তা হয়, তবে বস্তা প্রতি ৫০০ টাকায় বিক্রি করলে চাষের খরচ উঠে। ফলে উৎপাদন খরচ কমানো সম্ভব হলেই বাজারে দাম কমবে আলুর।
চুঁচুড়া রবীন্দ্রনগর বাজারের আলু বিক্রেতা গোপাল কুন্ডু বলেন, ‘‘আলু যা কেনা হয়, তার উপর সামান্য লাভ রেখে আমরা বিক্রি করি। জ্যোতি আলু ৩৪ টাকা, চন্দ্রমুখী ৩৮ টাকা বিক্রি করছি। ছোট কাট্পিস, খারাপ আলু কম দামে বিক্রি হচ্ছে। নতুন আলু এখনও বাজারে না আসার কারণে পুরনো আলুই বিকোচ্ছে। আমরা কমে পেলে কমে বিক্রি করি।’’
বর্ধমানের আলু ব্যবসায়ী বিষ্ণু দত্তও বলছেন, ‘‘হিমঘর থেকে এক বস্তা (৫০ কেজি) আলু বার করার পর তা বাছাই করে ৩৫ কেজি আলু পাওয়া যায়। ঝাড়াই-বাছাই করতেই কম করে ৩০০ টাকা খরচ হয়ে যায়। ফলে দাম বাড়েনি। আর দাম এর থেকে কমও হবে না।’’
তথ্য সূত্র: শিখা মুখোপাধ্যায়, বিদিশা সরকার, সন্তোষ লাহা, প্রণয় ঘোষ এবং মৌসুমি খাঁড়া।