Abdus Sattar

এক সাত্তারে তিনটি ‘তাস’ তৃণমূলের, বুদ্ধ-সরকারের প্রাক্তন মন্ত্রীকে নবান্নে এনে তিন ‘কৌশল’ মুখ্যমন্ত্রীর

২০০৬-২০১১ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সরকারে মন্ত্রী ছিলেন আব্দুস সাত্তার। যাঁকে বিধানসভায় টিকিট দিতে বর্ষীয়ান হাসিম আব্দুল হালিমকে আমডাঙা থেকে এন্টালিতে পাঠিয়ে দিয়েছিল সিপিএম।

Advertisement
শোভন চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০২৪ ০৯:৫৬
Why did the state government give appointment to Abdus Sattar in the administration

আব্দুস সাত্তারকে নবান্নের প্রশাসনে নিয়োগ করে এক চালে আস্তিনের তিনটি তাস টেবিলে ফেলেছেন মমতা। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।

সিপিএম থেকে কংগ্রেসে যাওয়ার সময় তিনি হাতে নিয়েছিলেন হাত চিহ্নের ঝান্ডা। তাঁর হাতে সেই পতাকা তুলে দিয়েছিলেন প্রদীপ ভট্টাচার্য এবং অধুনাপ্রয়াত সোমেন মিত্রেরা। সেই তিনিই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশাসনের অংশ হয়ে গেলেন প্রায় নিঃশব্দে। আনুষ্ঠানিক ভাবে তৃণমূলে যোগদান না করেই পেয়ে গেলেন পূর্ণমন্ত্রীর পদের মর্যাদা।

Advertisement

আব্দুস সাত্তারকে নবান্নের প্রশাসনে নিয়োগ করে এক চালে আস্তিনের তিনটি তাস টেবিলে ফেলেছেন মমতা।

সাত্তার ২০০৬-২০১১ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সরকারের সংখ্যালঘু ও মাদ্রাসা উন্নয়ন দফতরের মন্ত্রী ছিলেন। উল্লেখ্য, সাত্তারকে বিধানসভায় টিকিট দিতে দলের বর্ষীয়ান নেতা তথা বিধানসভার স্পিকার হাসিম আব্দুল হালিমকে আমডাঙা থেকে এন্টালিতে পাঠিয়ে দিয়েছিল সিপিএম। সেই সাত্তারকে মমতা-সরকার নিয়োগ করেছে সংখ্যালঘু উন্নয়ন ও মাদ্রাসা শিক্ষায় মুখ্যমন্ত্রীর ‘প্রধান উপদেষ্টা’ হিসাবে। একদা ঘোর সিপিএম, তার পরে কংগ্রেসি এই সংখ্যালঘু নেতার আচম্বিতে প্রশাসনিক পদে নিয়োগ নিয়ে শাসকদল এবং প্রশাসন জোর আলোচনা শুরু হয়েছে। যে আলোচনার নির্যাস— কেন? কী কারণে?

সাত্তারকে মুখ্যমন্ত্রীর প্রধান উপদেষ্টা পদে নিয়োগ করার পিছনে প্রাথমিক ভাবে তিনটি কারণ রয়েছে। যাকে অনেকে ‘কৌশল’ বা ‘বার্তা’ বলেও ব্যাখ্যা করতে চাইছেন।

১. ববির পাল্টা মুখ

এখনও পর্যন্ত তৃণমূল সারা রাজ্যে সংখ্যালঘুদের অবিসংবাদী সমর্থন উপভোগ করে। কিন্তু গোটা রাজ্যে দলের তরফে সংখ্যালঘু ‘মুখ’ একমাত্র ফিরহাদ হাকিম। তৃণমূলের অন্দরের একটি অভিমত হল, গনি খানের পরে সারা রাজ্যে ফিরহাদের মতো ‘দাপুটে’ সংখ্যালঘু নেতা আর উঠে আসেননি। বাকি যে সংখ্যালঘু মুসলিম নেতারা রয়েছেন, তাঁরা মূলত বিশেষ বিশেষ এলাকায় সীমাবদ্ধ। ফিরহাদ প্রথম থেকেই রাজ্যের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দফতরের মন্ত্রী। পাশাপাশি তিনি কলকাতার মেয়রও। উপরন্তু, তিনি দলনেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতার ‘আস্থাভাজন’। যদিও তৃণমূলের অন্দরে দ্বিতীয় মতামত বলে, যদিও বাংলাভাষী এবং হিন্দিভাষী মুসলমিদের মধ্যে ফিরহাদের গ্রহণযোগ্যতা সমান নয়। ঘটা করে দুর্গাপুজো করা তার একটি কারণ বলে অনেকে মনে করেন।

তৃণমূলের সাংগঠনিক কাঠামো, প্রশাসন বা সাংসদদের মধ্যে সংখ্যালঘু নেতা কম নেই। কিন্তু তাঁরা কেউই সারা বাংলার ‘মুখ’ হয়ে ওঠার মতো উদ্যোগ দেখাতে পারেননি। জাভেদ খান থেকে শওকত মোল্লা, মোশারফ হোসেন থেকে হামিদুল ইসলাম— প্রত্যকেই একটি নির্দিষ্ট এলাকার নেতা। আবার সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী, আব্দুল করিম চৌধুরী বা মুর্শিদাবাদের হুমায়ুন কবীরেরা সারা বছর বিতর্কে থাকেন। ফলে সারা রাজ্যের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কাছে তাঁদের ‘গ্রহণযোগ্যতা’ সংশয়াতীত নয়।

মনে করা হচ্ছে, প্রশাসনের মূলতম স্রোতে সাত্তারের নিয়োগ সেই কারণেই হয়েছে। সাত্তার একটা সময়ে রাজ্যের মন্ত্রী ছিলেন। প্রশাসক হিসেবে তাঁর অভিজ্ঞতা রয়েছে। সংখ্যালঘু সমাজে তাঁর ‘স্বচ্ছ’ ভাবমূর্তিও রয়েছে। তাঁকে দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে সংখ্যালঘু সংক্রান্ত বিষয়ে। প্রশাসনিক স্তরে ‘মুখ’ হিসাবে ফিরহাদের পাশাপাশি সাত্তারকে দেখাতে চাইছে নবান্ন। যদিও সাত্তার কতটা তা হয়ে উঠতে পারবেন, তা নিয়ে সংশয়ী অনেকে।

দ্বিতীয়ত, ফিরহাদ সম্পর্কে তৃণমূলের সেনাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বিরাগ’ সর্বজনবিদিত। তাঁদের সম্পর্কের ‘অমসৃণতা’ পরোক্ষে হলেও অনেক সময় প্রকাশ্যে এসে পড়েছে। দলনেত্রী মমতাও সে বিষয়ে ওয়াকিবহাল। সেই নিরিখেও দল এবং প্রশাসনের অন্দরে ফিরহাদের ‘পাল্টা’ একটি সংখ্যালঘু মুখ নির্মাণের প্রয়োজন ছিল। প্রসঙ্গত, প্রদেশ কংগ্রেসেরও অনেকে মনে করেছেন, সাত্তারকে তাঁদের দল থেকে ‘ভাঙিয়ে’ নেওয়া সংখ্যালঘু মুখ তৈরির চেষ্টা এবং মুসলিমদের বার্তা দেওয়ার জন্যই। যদিও তৃণমূলের এক প্রবীণ নেতার বক্তব্য, ‘‘বরকতদার (গনি খান চৌধুরী) পরে কোনও দল থেকে কোনও সংখ্যালঘু নেতা উঠে আসেননি, যাঁর সারা বাংলায় পরিচিতি আছে। এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই সংখ্যালঘুদের আস্থার মুখ। ফলে আলাদা করে সাত্তারকে ‘মুখ’ করা হচ্ছে বলে মনে হয় না।’’

২. প্রশাসনে রাজনৈতিক নিয়োগ

রাজনীতির সাত্তারের যে ভাবে প্রশাসনিক কাজে নিয়োগ করা হয়েছে, তা তৃণমূলের আমলে প্রথম! সাধারণত অন্য দল থেকে কোনও নেতা এলে তিনি আগে তৃণমূলে যোগ দেন। পরে দল মনে করলে তাঁকে প্রশাসনিক পদে নিয়োগ করেছে। যেমন রেজ্জাক মোল্লা। তিনি আগে তৃণমূলে গিয়ে পরে মন্ত্রী হয়েছিলেন। ২১ জুলাইয়ের মঞ্চে গিয়ে তৃণমূলে শামিল হয়েছিলেন প্রাক্তন সিপিএম নেতা তথা রাজ্যসভার প্রাক্তন সাংসদ মইনুল হাসান। মইনুল রাজ্য পরিবহণ পরিকাঠামো বোর্ডের চেয়ারম্যান। কিন্তু সাত্তার হলেন প্রথম নেতা, যাঁকে অন্য দল থেকে প্রথমে দলে শামিল না করিয়ে প্রশাসনে যুক্ত করা হল। এবং তাঁকে পূর্ণমন্ত্রীর মর্যাদাও দেওয়া হল। এই দৃষ্টান্ত সরকার তথা শাসকদলের জন্য নতুন ধারার সূচনা বলেই বক্তব্য অনেকের। আবার অনেকে মনে করছেন, এই নিয়োগের মাধ্যমে মমতা দল এবং প্রশাসনে নির্দিষ্ট ‘বার্তা’ দিতে চেয়েছেন। তৃণমূলের এক সাংসদের ব্যাখ্যা, ‘‘সাত্তারকে নিয়োগের মাধ্যমে অন্য দলের স্বচ্ছ ভাবমূর্তির নেতাদেরও বার্তা দেওয়া হল যে, আপনারা প্রশাসনে কাজ করতে চাইলে আসতে পারেন। তার জন্য দলীয় রাজনীতির বৃত্তে প্রবেশ করতে হবে না।’’

সাত্তারের নিয়োগকে তৃণমূলের একটি অংশ ‘মহড়া’ হিসাবেও ব্যাখ্যা করছেন। সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন বসিরহাটের সাংসদ হাজি নুরুল ইসলাম। ওই লোকসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচন হবে। ওই কেন্দ্রে সংখ্যালঘু কাউকেই প্রার্থী করার সম্ভাবনা। শাসক শিবিরের অনেকের দাবি, উত্তর ২৪ পরগনার আমডাঙার প্রাক্তন বিধায়ক সাত্তারকে প্রশাসনে নিয়োগ করে বসিরহাটের জন্য তৈরি করা হচ্ছে। তবে অন্য অনেকের পাল্টা বক্তব্য, এখনই এই সব ধারণা ‘অতি সরলীকরণ’। তেমন হলে সাত্তারকে বরং দলেই যোগ দেওয়ানো হত।

৩. ওয়াকফ অভিজ্ঞতা

কেন্দ্রে ওয়াকফ বিল নিয়ে যৌথ সংসদীয় কমিটিতে গত কয়েক দিন ধরেই ধুন্ধুমার চলছে। যা নিয়ে বিরোধী সাংসদদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সরব তৃণমূলেরই কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু দিল্লিতে কল্যাণ যখন কমিটির বৈঠকে বিজেপি সাংসদদের সঙ্গে টক্কর নিচ্ছেন (ক্রোধান্বিত হয়ে জলের বোতল ভেঙে নিজের হাতের আঙুল নিজেই কেটে ফেলেছেন), তখন তৃণমূলের অন্দরে আলোচনা রয়েছে যে, দল এবং প্রশাসনের অনেকেই গোটা বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট অবহিত নন। দিল্লির ঘটনার পরেই প্রশাসনের অনেকের টনক নড়ে এবং এ-ও আলোচনা হয় যে, ভবিষ্যতে ওয়াকফ বিল আইনে পরিণত হলে (তৃণমূলের অনেকেই ধরে নিচ্ছেন তা-ই হবে) এ রাজ্যেও তার প্রভাব আসবে। সে ক্ষেত্রে সাত্তারের পূর্ব অভিজ্ঞতাকে প্রশাসন কাজে লাগাতে চাইছে। যদিও সংখ্যালঘু মন্ত্রী হিসাবে সাত্তার কতটা ‘করিৎকর্মা’ ছিলেন, তা নিয়ে অনেক প্রাজ্ঞজনই সংশয় প্রকাশ করছেন। সাত্তার মন্ত্রী ছিলেন ১৩ বছর আগে। ১৩ বছর পরের পরিস্থিতিতে সেই অভিজ্ঞতা তিনি কতটা কাজে লাগাতে পারবেন, তা নিয়েও অনেকে সন্দিহান। তবে তাঁরাও মানছেন, সাত্তার শিক্ষিত এবং স্বচ্ছ ভাবমূর্তির রাজনীতিক। ফলে প্রশাসনে তাঁর আগমনে একটি নির্দিষ্ট ‘বার্তা’ পৌঁছবে।

আরও পড়ুন
Advertisement