(বাঁ দিকে) দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, বিমান বসু (ডান দিকে)। —ফাইল ছবি।
নামবদল করলে কি বাংলায় বামেদের দিন বদলাবে? বামফ্রন্টের নামবদলের প্রসঙ্গে সিপিএমএল লিবারেশনের সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের প্রস্তাব নিয়ে বিভিন্ন বক্তব্য উঠে আসছে ফ্রন্টের শরিক দলের নেতাদের আলোচনায়। পাশাপাশিই আলোচিত হচ্ছে পুরনো ইতিহাস এবং সাম্প্রতিক ‘সংঘাতের’ প্রসঙ্গও।
নৈহাটি উপনির্বাচনে বামফ্রন্টের সমর্থনে লিবারেশন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। এই প্রথম সরাসরি সিপিএম তাদের ভাগের আসন ছেড়ে দিয়েছে ফ্রন্টের বাইরের দল লিবারেশনকে। সেই সূত্রেই প্রশ্ন উঠেছে, ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটে কি লিবারেশন বামফ্রন্টের ‘শরিক’ হয়ে লড়বে? সোমবার দীপঙ্কর বলেছেন, ‘‘প্রশ্নটা ভবিষ্যতের উপর ছেড়ে দিতেই পারি। তবে বৃহত্তর বাম ঐক্য দরকার, নামবদল দরকার। নামটা বদল করতে পারলে ভাল হয়।’’
তা হলে কি বামফ্রন্ট উঠে যাবে? এই প্রশ্নে যেমন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম কোনও বিতর্কে যেতে চাননি। তাঁর কথায়, ‘‘প্রস্তাব এলে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু বাংলায় বামপন্থীদের নেমচেঞ্জারের বদলে গেমচেঞ্জার হয়ে উঠতে হবে।’’ আরএসপি-র সাধারণ সম্পাদক মনোজ ভট্টাচার্য উদার আলোচনার পক্ষে অভিমত জানিয়েও বলেছেন, ‘‘বামফ্রন্টের একটা সুদীর্ঘ ইতিহাস এবং ঐতিহ্য আছে। এ কথা ঠিক যে আমরা গত ১৩ বছর রাজ্যে ক্ষমতায় নেই। এ-ও ঠিক যে, ক্ষমতায় ফেরার সম্ভাবনাও দেখছি না। তার মানে এই নয় যে আমরা ইতিহাস বিস্মৃত হব।’’ সিপিআই, ফরওয়ার্ড ব্লকও বামফ্রন্টের নামবদলের পক্ষে নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও শরিক নেতারা একান্ত আলোচনায় মেনে নিচ্ছেন, বামফ্রন্টের নামবদলের দাবি সাম্প্রতিক অতীতেও উঠেছিল।
২০১৬ সালে বাংলায় কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতা করে ভোটে লড়েছিল বামেরা। সেই সময়ে ফ্রন্টের একটি শরিক দল নামবদলের দাবি তুলেছিল। তাদের প্রস্তাব ছিল, কংগ্রেসের সঙ্গে যখন বোঝাপড়া করেই ভোটে লড়া হচ্ছে, তখন বামফ্রন্টের বদলে ‘জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট’ নাম নিয়ে লড়া হোক। এক আরএসপি নেতার কথায়, ‘‘ওই সময়ে একটি শরিক দল এমন বায়নাক্কা শুরু করেছিল যে, বিমানদা (ফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু) আমায় ফোন করে বলেছিলেন, এরা কি সাইনবোর্ডটাকেও তুলে দিতে চাইছে?’’ যদিও শেষ পর্যন্ত বামফ্রন্ট নাম রয়ে গিয়েছিল এবং এখনও রয়েছে।
২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে বামেদের সঙ্গে কংগ্রেসের তো সমঝোতা হয়েইছিল, পাশাপাশিই সেখানে জুড়ে গিয়েছিল নির্বাচনের আগে হঠাৎ তৈরি হওয়া আইএসএফ। এই তিন শক্তির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘সংযুক্ত মোর্চা’। সেই সংযুক্ত মোর্চার নামে ব্রিগেডে সমাবেশও হয়েছিল। তবে বামফ্রন্ট উঠে যায়নি। সেই সময়ে বামেদের প্রার্থীদের নামের আগে লেখা হয়েছিল, ‘সংযুক্ত মোর্চার বামফ্রন্ট প্রার্থী’। যদিও সেই নাম কতটা বাস্তবসম্মত ছিল, তা নিয়ে বামেদের মধ্যে আলোচনা রয়েছে। কারণ, সেই ভোটেই বাংলায় বামেরা বিধানসভার আসনসংখ্যার নিরিখে প্রথম শূন্য হয়ে যায়। ফলে নতুন নাম দিলেই যে সাফল্য আসবে, সেই তত্ত্বও অনেকে মানতে চাইছেন না।
২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে বামফ্রন্ট-কংগ্রেসের বোঝাপড়া হলেও তা সার্বিক ছিল না। কোচবিহার আসনে ফরওয়ার্ড ব্লকের বিরুদ্ধে প্রার্থী দাঁড় করিয়েছিল কংগ্রেস। আবার পুরুলিয়াতেও ফরওয়ার্ড এবং কংগ্রেস দুই দলেরই প্রার্থী ছিল। দেখা গিয়েছিল, বামফ্রন্টগত ভাবে কোচবিহারের ফরওয়ার্ড ব্লক প্রার্থীকে সমর্থন দেওয়া হয়েছিল। আবার পুরুলিয়ায় কংগ্রেসের নেপাল মাহাতো পেয়েছিলেন ফ্রন্টের সমর্থন। সেই সময়ে সিপিএম এবং ফরওয়ার্ড ব্লকের সংঘাত এমন জায়গায় গিয়েছিল যে, আলিমুদ্দিনের এক প্রথম সারির নেতা একান্ত আলোচনায় বলে দিয়েছিলেন, ‘‘দরকারে বামফ্রন্টই তুলে দেব! কিন্তু এই ব্ল্যাকমেল নেব না।’’ যদিও বামফ্রন্ট ওঠেনি। তার পরেও রয়ে গিয়েছে।
ক্ষমতায় থাকার সময়েও শরিক দলগুলি সিপিএমের বিরুদ্ধে ‘দাদাগিরি’র অভিযোগ তুলত। সিপিআইয়ের মঞ্জুকুমার মজুমদার, আরএসপি-র ক্ষিতি গোস্বামীরা প্রকাশ্যেই সিপিএমের সমালোচনা করতেন। বহু ক্ষেত্রে সিপিএমের নেতারাও শরিকদের কটাক্ষ করতেন প্রকাশ্যে। তবে শেষমেশ দেখা যেত, বর্ষীয়ান বিমান সবটা সামলে নিচ্ছেন। দীপঙ্করের খোলা প্রস্তাবের পরে সেই সব পুরনো কথাই আলোচিত হচ্ছে সিপিএম-সহ শরিক নেতাদের পরিসরে। সেই সঙ্গে প্রশ্নও থাকছে— নামবদল হলে কি দিনবদল হবে?