(বাঁ দিকে) বন্দি থাকাকালীন কুণাল ঘোষ। আরজি কর-কাণ্ডে ধৃত সিভিক ভলান্টিয়ার (ডান দিকে)। —ফাইল ছবি।
পুলিশের প্রিজ়ন ভ্যান কি কেবলই একটি গাড়ি? না কি প্রতিবাদের মঞ্চ? গত এক যুগ ধরে ধারাবাহিক বিভিন্ন ঘটনা বলছে, প্রিজ়ন ভ্যান যতটা গাড়ি, ততটাই বাকিটিও।
আরজি করের তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ করে খুনের মামলায় অভিযুক্ত সিভিক ভলান্টিয়ার সোমবার প্রিজ়ন ভ্যানের ভিতর থেকে জানলার জালের সামনে এসে চিৎকার করে বলেছেন, ‘‘আমি ধর্ষণ, খুন করিনি। সরকার আমায় ফাঁসাচ্ছে।’’ বলেছেন, ‘আসল’ লোককে বাঁচাতে তাঁকে ফাঁসানো হচ্ছে। সেই সূত্রেই আলোচনায় উঠে আসছে এক যুগ আগে প্রিজ়ন ভ্যান থেকে তৎকালীন রাজ্যসভার তৃণমূল সাংসদ কুণাল ঘোষের ‘প্রতিবাদী’ কণ্ঠ। সারদা মামলায় বিধাননগর কমিশনারেটের হাতে ধৃত কুণাল যখন বলতেন, ‘‘সারদার সব থেকে বড় বেনিফিশিয়ারি (মুনাফাভোগী) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়’’, তখন তাঁকে কথা বলতে বাধা দিত পুলিশ। কুণাল পাল্টা ফুঁসে উঠে বলতেন, ‘‘যান, গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে অ্যারেস্ট করুন!’’
কুণালের সেই বক্তব্য নিয়ে রাজ্য রাজনীতি সরগরম হত। বিরোধীরাও ওই বক্তব্যকে ‘হাতিয়ার’ করতেন। যেমন আরজি করের ঘটনায় ধৃতের সোমবারের বক্তব্য ধরে ইতিমধ্যেই ময়দানে নেমেছেন আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারেরা। তাঁদের আন্দোলনের অন্যতম নেতা কিঞ্জল নন্দ বলেছেন, ‘‘কে তাঁকে ফাঁসাল? কেন ফাঁসাল? এর উদ্দেশ্য কী?’’
সোমবার শিয়ালদহ আদালতে আরজি কর মামলায় চার্জ গঠন হয়। সে কারণেই ধৃত সিভিককে পেশ করা হয়েছিল আদালতে। যদিও কুণালের মতো ধৃতের বক্তব্য থামাতে পুলিশের বিশেষ ‘তৎপরতা’ চোখে পড়েনি। এমনকি, কুণালের কথা যাতে সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরায় ধরা না পড়ে, তাই পুলিশই প্রিজ়ন ভ্যান পিটিয়ে ভিন্ন শব্দ তৈরি করত। মুখে ‘হা রে রে রে রে’ করে চিৎকারও করত। কিন্তু কুণাল থামতেন না। আরজি করের ঘটনায় ধৃত অভিযুক্তকে অবশ্য এত চেষ্টা করতে হয়নি। তিনি মোটামুটি নির্বিঘ্নেই তাঁর বক্তব্য বলতে পেরেছেন। জোর গলায়।
কুণাল অবশ্য তুলনা টানতে রাজি নন। তাঁর কথায়, ‘‘দু’টি ঘটনা ভিন্ন। তখন প্রকাশ্যে মুখ খোলার জন্য আমার কপালে প্রিজ়ন ভ্যান জুটেছিল। এ ক্ষেত্রে ধর্ষণ এবং খুনের মতো নারকীয় ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া এক জন চিৎকার করেছে। ও জানে ফাঁসি অনিবার্য! তাই বলেছে।’’
তবে শুধু কুণাল বা আরজি কর-কাণ্ডে ধৃত সিভিক ভলান্টিয়ার নন। সাম্প্রতিক সময়ে জেলবন্দি অনেকেই প্রিজ়ন ভ্যান থেকে ফুঁসে উঠেছেন। অভিযোগ করেছেন। তাঁদের ফাঁসিয়ে দেওয়ার তত্ত্ব বলেছেন। দাবি করেছেন, তিনি ‘নির্দোষ’। সেই তালিকায় রয়েছেন নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় ধৃত বলাগড়ের তৃণমূল নেতা শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়, বলাগড়েরই আর এক নেতা কুন্তল ঘোষ। রয়েছেন তাপস মণ্ডল। শান্তনু এক বার প্রিজ়ন ভ্যানের পাদানিতে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘‘আমি নির্দোষ। আমি নির্দোষ। আমি টাকা নিইনি। জেলের ভিতরে যারা আছে, তারা ফাঁসাচ্ছে।’’ তখনও প্রশ্ন উঠেছিল, শান্তনু কাদের কথা বলছেন। যদিও সেই প্রশ্ন বেশি দিন জারি ছিল না। নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় জেলবন্দি প্রাক্তন মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও প্রিজ়ন ভ্যানে বসে বা নামা-ওঠার সময়ে বিভিন্ন মন্তব্য করেছেন। এ-ও দাবি করেছেন, তিনি নির্দোষ।
বন্দিরা কেন প্রিজ়ন ভ্যানকে এই ভাবে ‘ব্যবহার’ করেন? কলকাতার প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার গৌতমমোহন চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘একজন বন্দির কাছে নিজের কথা বলার সুযোগ কম। জেলে তিনি বলতে পারেন না। কোর্টে পেশ করলে আদালত কক্ষেও যে তিনি কথা বলতে পারবেন তারও নিশ্চয়তা নেই। তাঁর কাছে খোলা জগৎ বলতে প্রিজ়ন ভ্যান থেকে নামা এবং সেখানে গিয়ে ওঠা। সেই সুযোগটা তাঁরা ব্যবহার করেন।’’ প্রাক্তন এই পুলিশকর্তা আরও একটি বিষয় উল্লেখ করেছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘এই ধরনের বন্দিদের কোর্টে পেশ করা হলে সেখানে সংবাদমাধ্যম থাকে। ফলে তাঁরাও ভাবেন সংবাদমাধ্যমের সামনে কিছু একটা বললে তাঁর কথাটা জনমানসে ছড়িয়ে যাবে।’’
কুণালও এই কারণগুলির কথাই বলেছেন। নিজের প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, আদালতে তিনি নিজের সওয়াল নিজে করেছেন। জেলে বসে লেখা কুণালের ৯১ পাতার নোটও ‘ফাঁস’ হয়ে গিয়েছিল। তা নিয়েও হইচই হয়েছিল রাজ্য রাজনীতিতে। প্রিজ়ন ভ্যানের দিন অতীত। কুণালের ‘প্রত্যাবর্তন’ হয়েছে রাজ্যের রাজনীতিতে। বাকিরা অনেকে বিভিন্ন মামলায় এখনও বন্দি। কেউ কেউ জামিনও পেয়েছেন। প্রিজ়ন ভ্যান রয়ে গিয়েছে প্রতিবাদের ‘মঞ্চ’ হয়ে।