নরেন্দ্র মোদী (বাঁ দিকে) এবং অমিত শাহ (ডান দিকে)। — ফাইল চিত্র।
লোকসভা নির্বাচনের প্রস্তুতির মধ্যেই বাংলায় রাজ্যসভার ভোট। মোট পাঁচটি আসনে ভোট হবে। বিধায়কের সংখ্যার বিচারে তার মধ্যে একটিতে বিজেপির জয় নিশ্চিত। কিন্তু কে হবেন সেই ‘ভাগ্যবান’ অথবা ‘ভাগ্যবতী’? নির্বাচন কমিশন ভোটের নির্ঘণ্ট প্রকাশ করতেই জল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছে পদ্মশিবিরে। অবশ্য কেউ এখনই এ নিয়ে মুখ খুলতে রাজি নন। কারণ, শেষ সিদ্ধান্ত নেবেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। তবে জল্পনা থেমে নেই।
আগামী ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলার পাঁচটি রাজ্যসভা আসনে ভোট। কমিশন জানিয়েছে, দেশের ১৫টি রাজ্যে ৫৬টি রাজ্যসভা আসনে মনোনয়ন জমা দেওয়ার শেষ দিন ১৫ ফেব্রুয়ারি। গত বছর জুলাই মাসে ছ’টি আসনে রাজ্যসভা নির্বাচন হয়েছিল। তখন বিজেপি ‘চমক’ দেখিয়েছিল প্রার্থীঘোষণাতেও। একেবারে শেষ মুহূর্তে দল জানায়, রাজবংশী সম্প্রদায়ের অনন্ত রায়কে প্রার্থী করা হচ্ছে। যিনি নিজেকে রাজবংশীদের ‘মহারাজা’ বলেও দাবি করেন। একই ভাবে এ বারেও একটি আসনে জয় নিশ্চিত হওয়ায় সেখানেও ‘চমক’ দিতে চাইছে বিজেপি।
দলীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, একাধিক নামের মধ্যে রাজ্যসভার প্রার্থী হিসাবে সম্ভাবনায় এগিয়ে রয়েছেন এক শিল্পী। সূত্রের খবর, রাজ্য নেতৃত্বের বড় অংশ তাঁকে চান। নির্বাচনী রাজনীতিতে তাঁকে এর আগে দেখা গেলেও আসলে তিনি কীর্তন, বাউল ও অন্যান্য ভক্তিমূলক সঙ্গীতশিল্পীদের সংগঠন নেতা। নাম সিদ্ধার্থশঙ্কর নস্কর। তিনি অবশ্য এর আগে দু’বার ভোটে দাঁড়িয়ে হেরে গিয়েছেন।
রাজ্য বিজেপিতে অবশ্য একটি নাম নিয়েই জল্পনা শুরু হয়নি। রাজ্যের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়ের নামও রয়েছে দৌড়ে। পশ্চিমবঙ্গে লোকসভা নির্বাচন পরিচালনার মূল দায়িত্ব তাঁকেই দিয়েছে দল। তার থেকে অনেকের ধারণা, আদতে বীরভূমের বাসিন্দা জগন্নাথকে লোকসভায় প্রার্থী না-ও করতে পারে দল। কারণ, তিনি নিজের কেন্দ্র নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলে সমস্যা হবে। সে ক্ষেত্রে তাঁকে লোকসভা নির্বাচনের আগেই রাজ্যসভায় পাঠিয়ে দেওয়া হতে পারে। রাজ্য বিজেপির সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের কথায়, ‘‘এটা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত। দিল্লি থেকেই নাম ঘোষণা হবে। শুধু বাংলা নয়, অন্য রাজ্যের ক্ষেত্রেও এটাই বিজেপির রীতি।’’ বাংলার নেতাদের মতামত নেওয়া হবে কি? সুকান্ত বলেন, ‘‘সেটা হতেই পারে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন শীর্ষ নেতৃত্বই।’’
রাজ্য নেতৃত্ব বলতে না চাইলেও বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে, ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তরফে নাম চাওয়া হয়েছে। রাজ্যের শীর্ষনেতারা পাঁচটি নাম ঠিকও করে ফেলেছেন। তবে কারা তাঁরা, তা নিয়ে কেউ মুখ খুলতে রাজি হচ্ছেন না। রাজ্য বিজেপি চাইছে ‘বিখ্যাত’ ব্যক্তি হওয়ার পাশাপাশি ‘রাজনৈতিক’ প্রতিষ্ঠাও রয়েছে এমন কাউকেই রাজ্যসভায় পাঠানো হোক। আগামিদিনে রাজ্যে সাংগঠনিক কাজে লাগবে, এমন কাউকে ওই নিশ্চিত আসনটিতে প্রার্থী করা হোক।
রাজ্যসভার ভোটে গত বারে জল্পনায় উঠে এসেছিল মিঠুন চক্রবর্তীর নাম। তিনি আগে তৃণমূলের টিকিটে রাজ্যসভায় ছিলেন। তবে রাজ্য বিজেপি মিঠুনের নাম নিয়ে ভাবছে না বলেই এখনও পর্যন্ত খবর। তা ছাড়া, তিনি সদ্যই ‘পদ্মভূষণ’ সম্মান পেয়েছেন। একদা অভিনেত্রী রূপা গঙ্গোপাধ্যায়কে রাজ্যসভায় মনোনীত সাংসদ করেছিল বিজেপি। কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে রূপাকে সে ভাবে সাংগঠনিক কাজে পাওয়া যায়নি। এ সব ‘দৃষ্টান্ত’ দেখেই রাজ্য বিজেপি ‘তারকা’ প্রার্থীর চেয়ে সংগঠনে কাজ করেন এমন কাউকে চাইছে। সে ক্ষেত্রে সিদ্ধার্থ খুব ফেলে দেওয়ার মতো নয় বলেই মনে করা হচ্ছে। পর পর দু’বার নির্বাচনে পরাজিত হলেও তিনি দলের কাজে নিয়মিত। রাজ্যসভার প্রাক্তন সাংসদ (মনোনীত) স্বপন দাশগুপ্তের নাম নিয়েও জল্পনা রয়েছে। তবে বয়স এবং সাংগঠনিক বিষয়ে তাঁর অংশগ্রহণ কম হওয়ায় সুযোগও কম। তৃণমূল ছেড়ে-আসা প্রাক্তন রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদীর নামও কেউ কেউ বলছেন। তবে কোনও অবাঙালিকে রাজ্যের একমাত্র রাজ্যসভা আসনে প্রার্থী করা হবে কি না, তা নিয়েও ভাবনাচিন্তা হচ্ছে।
তবে যে নামই রাজ্য বিজেপি পাঠাক আর কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ঘোষণা করুন, একটি বিষয় নিশ্চিত যে, কোনও নেতাকে ‘পুরস্কার’ হিসাবে রাজ্যসভায় পাঠাবেন না মোদী-শাহেরা। কাউকে ‘খুশি’ করার জন্য নয়, সংগঠনের সুবিধা হবে এবং ভোটের অঙ্কে কাজে লাগবে এমন কাউকেই বাংলার নিশ্চিত আসনে প্রার্থী করবে বিজেপি।
সিদ্ধার্থ মূলত নবদ্বীপের বাসিন্দা। তবে গত লোকসভা নির্বাচনে তমলুক আসন থেকে বিজেপির প্রার্থী ছিলেন তিনি। অধুনা বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর ভাই অধুনা তৃণমূল সাংসদ দিব্যেন্দু অধিকারীর কাছে হেরে গিয়েছিলেন প্রায় দু’লাখ ভোটে। বিজেপিতে যা জল্পনা, তাতে লোকসভা নির্বাচনের আগে দিব্যেন্দু বিজেপিতে এসে যেতে পারেন। সেটা হলে নিশ্চিত ভাবেই সিদ্ধার্থের তমলুকে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যাবে। তবে এখনও তমলুকে সাংগঠনিক কাজে ‘সক্রিয়’ তিনি। মঙ্গলবার আনন্দবাজার অনলাইনের তরফে সিদ্ধার্থের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি অবশ্য বলেন, ‘‘আমায় এখনও পর্যন্ত নেতৃত্বের তরফে আনুষ্ঠানিক ভাবে কিছু জানানো হয়নি। তেমন কোনও বার্তা পেলে তবেই আমি বিষয়টা জানাতে পারব।’’
উল্লেখ্য, ২০২১ সালে গত বিধানসভা নির্বাচনেও প্রার্থী হয়েছিলেন সিদ্ধার্থ। নবদ্বীপ বিধানসভা কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে তৃণমূলের পুণ্ডরীকাক্ষ সাহার কাছে পরাজিত হন। নবদ্বীপ আসনটি রানাঘাট লোকসভা এলাকার মধ্যে পড়ে। সেটি আগে থেকেই বিজেপির দখলে। সেখানে আবার সাংসদ জগন্নাথ সরকারই টিকিট পাবেন বলে ধরে নিচ্ছেন রাজ্যের বিজেপি নেতৃত্ব। তাই সিদ্ধার্থকে রাজ্যসভায় পাঠানো হতে পারে।
বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে, এই নাম নিয়ে ‘প্রাথমিক’ সম্মতি দিয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। বিজেপির যে অঙ্ক কষছে, তা বলছে, রাজ্যে যে বড় কীর্তন-বাউল সমাজ রয়েছে, তাঁরা মূলত হিন্দু। অনেক শিল্পীর অনুগামী ও ভক্তসংখ্যাও বড়। সেই ভোটারদের আবেগ ছুঁতেই সিদ্ধার্থ রাজ্যসভার প্রার্থী হিসাবে বিজেপির বাছাই হতে পারেন। যিনি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কীর্তন-বাউল শিল্পীদের বিভিন্ন সংগঠনকে একত্রিত করে ‘শিল্পী সংসদ’ নামে সংগঠনও তৈরি করেছেন। তৈরি করেছেন ‘সারা ভারত কীর্তন, বাউল ও ভক্তিগীতি কল্যাণ ট্রাস্ট’।
পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার যা বিন্যাস এবং রাজ্যসভার ভোটের যা অঙ্ক, তাতে এ বার বাংলা থেকে এক জন প্রার্থীকে জেতাতে ৪৭ বা ৪৮টি ভোট দরকার হবে। খাতায়কলমে বিধানসভায় বিজেপির শক্তি ছিল ৭৫। কিন্তু ইতিমধ্যেই ছ’জন তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। ধূপগুড়ি আসন উপনির্বাচনে হারিয়েছে। ফলে তাদের ভোট কমে হয়েছে ৬৮। অন্য দিকে, জেলে থাকার জন্য তৃণমূলের চার বিধায়ক ভোট দিতে পারবেন না। তবে তাতেও চারটি আসনে নিজেদের প্রার্থীকে রাজ্যসভায় পাঠাতে সমস্যা হবে না শাসকদলের। প্রসঙ্গত, বাংলায় মেয়াদ শেষ হওয়া পাঁচ সাংসদের মধ্যে চার জন তৃণমূলের— নাদিমুল হক, শুভাশিস চক্রবর্তী, আবির বিশ্বাস এবং শান্তনু সেন। এ ছাড়া রয়েছেন কংগ্রেসের অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি। কংগ্রেস এ বার বাংলা থেকে কোনও সদস্য পাঠাতে পারবে না। সেই আসনটিই পাবে বিজেপি। দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিদায়ী সাংসদদের মধ্যে কাকে কাকে রাখবেন, তা এখনও অজানা। সেখানেও কোনও ‘চমক’ থাকতে পারে বলেই মনে করা হচ্ছে।