সুচেতন ভট্টাচার্য। —নিজস্ব চিত্র।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সন্তান সুচেতন রূপান্তরকামীর (ট্রান্সজেন্ডার) সরকারি পরিচয়পত্র পেয়েছেন। রাজ্য প্রশাসন সূত্রে এই খবর জানা গিয়েছে। জানুয়ারি মাসের ৫ তারিখে ওই পরিচয়পত্রটি সুচেতনের কাছে পৌঁছেছে।
ওই খবর জানার পরে আনন্দবাজার অনলাইন সুচেতনের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিল। তবে তাঁর ফোন বেজে গিয়েছে। জানা গিয়েছে, তিনি কলকাতার বাইরে রয়েছেন। সুচেতনের হিতৈষীরা বলছেন, ‘সুচেতনা’ থেকে ‘সুচেতন’ হওয়ার যে লড়াই তিনি শুরু করেছিলেন, তাতে আরও এক ধাপ এগোলেন। এর পরে তিনি আবেদন করবেন ‘ট্রান্সম্যান’ হওয়ার পরিচয়পত্রের জন্য। সে কারণে তাঁর আরও কিছু শারীরিক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। সেগুলি সম্পন্ন হওয়ার পরেই তিনি ওই পরিচয়পত্রের জন্য আবেদন করতে পারবেন। তবে আপাতত ‘ট্রান্সজেন্ডার’ পরিচয়পত্র এবং পরিচয়ের সুবাদে তিনি তাঁর ব্যাঙ্ক, আধার কার্ড, ভোটার পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট-সহ নানাবিধ সরকারি নথিতে নাম এবং লিঙ্গ বদল করার জন্য আবেদন জানাবেন। প্রসঙ্গত, লিঙ্গ পরিবর্তনের জন্য যে যে শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন এবং অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন, সুচেতন তা ইতিমধ্যেই সম্পন্ন করেছেন। তবে কিছু প্রক্রিয়া এখনও বাকি রয়ে গিয়েছে। সেগুলি সম্পন্ন করলে তিনি ‘ট্রান্সম্যান’ হিসেবে নিজের সরকারি পরিচয় দিতে পারবেন।
সরকারি যে পরিচয়পত্রটি বুদ্ধদেবের সন্তান পেয়েছেন, তার শিরোনামে রয়েছে ‘ট্রান্সজেন্ডার আইডেন্টিটি কার্ড’। নাম— সুচেতন ভট্টাচার্য। অভিভাবক হিসেবে নাম রয়েছে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যেরই। লিঙ্গের কলমে লেখা— ‘ট্রান্সজেন্ডার’। ঠিকানা রয়েছে বুদ্ধদেবের বাসস্থান পাম অ্যাভিনিউয়ের।
প্রসঙ্গত, বুদ্ধদেব এবং তাঁর স্ত্রী মীরা ভট্টাচার্য পাম অ্যাভিনিউয়ের সরকারি আবাসনের যে ঠিকানায় থাকেন, সুচেতন সেখানে থাকেন না। ব্যক্তিগত সঙ্গীর সঙ্গে থাকেন অন্যত্র। তবে নিয়মিত পাম অ্যাভিনিয়ের বাড়িতে যান। সেটাই তাঁর ‘অফিশিয়াল’ বা ‘আনুষ্ঠানিক’ ঠিকানা। পরিচয়পত্রটিতেও সেই ঠিকানাই দেওয়া হয়েছে— গ্রাউন্ড ফ্লোর, ফ্ল্যাট নম্বর-১, ৫৯এ পাম অ্যাভিনিউ, বালিগঞ্জ, সার্কাস অ্যাভিনিউ, কলকাতা-৭০০০১৯। পরিচয়পত্রে এ-ও উল্লেখ রয়েছে যে, ২০১৯ এবং ২০২০ সালের তৃতীয় লিঙ্গের সুরক্ষা আইনে এই পরিচয়পত্রটি তাঁকে দেওয়া হয়েছে।
রাজ্য প্রশাসন সূত্রের খবর, ওই পরিচয়পত্রটি পাওয়ার জন্য সুচেতনকে অন্যদের মতোই নির্দিষ্ট পন্থায় আবেদন করতে হয়েছিল। প্রয়োজনীয় ‘এফিডেবিট’ এবং চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়াও তিনি যে স্বেচ্ছায় লিঙ্গ পরিবর্তন করতে চাইছেন, সেই মর্মেও আবেদন করতে হয়েছিল। মঙ্গলবার রাজ্য প্রশাসনের এক আধিকারিক জানান, আবেদন পাওয়ার পরে সুচেতনকে সরকারি দফতরে ডেকে তাঁর সঙ্গে কথা বলা হয়েছিল। যেমন অন্য সব লিঙ্গ পরিবর্তনকামীদের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। সমস্ত দিক পরীক্ষা করেই রাজ্য প্রশাসনের তরফে তাঁকে ওই পরিচয়পত্রটি দেওয়া হয়েছে।
তবে লিঙ্গ পরিবর্তনকারীদের অনেকে মনে করছেন, সরকারি পরিচয়পত্রটি সুচেতনের লড়াইয়ের আদর্শ প্রতীক। লিঙ্গ পরিবর্তন অনেকেই করেন। কিন্তু রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর সন্তান যদি প্রকাশ্যে তাঁর যৌন অভিরুচির কথা বলেন এবং সেই অনুযায়ী নিজের লিঙ্গ পরিবর্তনের জন্য সক্রিয় হন, তা হলে তা বাকি সমাজের কাছে ‘দৃষ্টান্ত’ হিসেবে প্রতিভাত হবে। সে অর্থে সুচেতন তাঁর লড়াইয়ের প্রথম ধাপটি পেরোলেন। বাকি রইল আরও একটি ধাপ। তা হলেই বিষয়টি সম্পূর্ণ রূপ পাবে।
ঘটনাচক্রে, গত ২১ জুন আনন্দবাজার অনলাইনেই প্রথম লেখা হয়েছিল, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেবের একমাত্র সন্তান ‘সুচেতনা’ থেকে লিঙ্গ পরিবর্তন করে ‘সুচেতন’ হতে চান। সেই মর্মে সেই সময় থেকেই আইনি পরামর্শ নেওয়া শুরু করেছিলেন তিনি। তখন সুচেতন আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেছিলেন, ‘‘যিনি মানসিক ভাবে পুরুষ মনে করেন, তিনিও পুরুষ। যেমন আমি। আমি নিজেকে মানসিক ভাবে পুরুষ বলেই মনে করি। আমি এখন সেটা শারীরিক ভাবেও হতে চাই।’’
সন্দেহ নেই ২০২৩ সালে ইসরো চাঁদের অজানা অংশে চন্দ্রযান পাঠালেও লিঙ্গবদল নিয়ে সমাজে নানাবিধ ছুঁতমার্গ রয়েছে। ফলে এই সব ক্ষেত্রে রূপান্তরকামীদের লড়াইটা যতটা না আইনি, শারীরিক, তার চেয়েও বেশি মানসিক। তবে সুচেতন স্পষ্টই জানিয়েছিলেন, তাঁর মানসিক চাহিদা নিয়ে তাঁর বাবা বুদ্ধদেব অবহিত। এমনিতে এই সব ক্ষেত্রে বুদ্ধদেব বরাবরই আধুনিকমনস্ক। তবে সেই সময়ে জানা গিয়েছিল, সুচেতনের মা মীরা পুরোটা মানতে পারেননি তখনও। পর্যায়ক্রমে তিনিও বিষয়টি মেনে নিয়েছেন বলেই সুচেতনের হিতৈষীরা জানাচ্ছেন। বাবার সঙ্গে এখন মা-ও সুচেতনের লড়াইয়ে তাঁর সঙ্গে রয়েছেন। তবে সুচেতনের ঘনিষ্ঠেরা পাশাপাশিই বলছেন, লড়াই এখনও বাকি। দ্বিতীয় পর্যায়ের লড়াই জিতলে সুচেতনের যেমন ‘জয়’ হবে, তেমনই সাহস পাবেন সমাজের আরও বহু রূপান্তরকামী। যাঁরা এখনও লোকলজ্জার জন্য নিজেদের যৌন অভিরুচি প্রকাশ্যে আনতে পারেন না।