আপনি কি এই সমাজে আরও একটু সাহস বিলি করতে পারেন, সুচেতন? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
বয়সে আপনি বেশ খানিকটা ছোট। তবু বরাবর আপনাকে ‘আপনি’ সম্বোধনই করে এসেছি। আপনিও প্রথম থেকেই ‘আপনি’ এবং সম্মানসূচক ‘বাবু’ বলেছেন। এখনও বলেন। মাঝে ভেবেছিলাম, বয়সোচিত বাগাড়ম্বরে ‘তুমি’ বলি। হয়তো বলেও ফেলতাম। কিন্তু আপনি যা করলেন, তাতে সসম্ভ্রম ‘আপনি’ ছাড়া আর কিছু মাথায় আসছে না। আসবেও না।
বেশি দূর না গিয়ে এই বেলা লিখে ফেলি— সুচেতন (এই লেখায় এবং ভবিষ্যতেও আপনাকে ‘সুচেতনা’ নয়, ‘সুচেতন’ বলেই সম্বোধন করব), এই সমাজ আপনার সাহসের কাছে চিরকাল নতজানু থাকবে।
নিজের ‘লিঙ্গস্বাচ্ছন্দ্য’ এবং ‘যৌন অভিরুচি’ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করা সহজ নয়। সারা পৃথিবীতেই নয়। যাঁরা তা করতে পারেন, তাঁরা সাহসী। তিনি যদি এক কমিউনিস্ট পরিবারের সদস্য হন, তা হলে দুঃসাহসী। আর পশ্চিমবঙ্গ নামক একটি রাজ্যের এক প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর সন্তান হলে অকুতোভয়।
সুচেতন, আপনি সত্যি সত্যিই অকুতোভয়।
আপনার সঙ্গে আলাপ খুবই আকস্মিক। আপনার বিখ্যাত বাবার সঙ্গে খানিকটা ‘অম্লমধুর’ সম্পর্ক ছিল। আপনাকে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে ছুটকোছাটকা কথা কানে আসত। বাকি কিছু কাগজপত্রে পড়া। আপনি বন্যপ্রাণ অন্তপ্রাণ, আপনি নাকি কোনও না কোনও সময় কোনও নিরাপত্তারক্ষীকে ধমক দিয়েছেন এবং তার ফলে তাঁকে বদলি হতে হয়েছে ইত্যাদি বিবিধ বিষয় বিভিন্ন সময়ে কাগজে ‘খবর’ হিসেবে বেরিয়েছে। যে হেতু তার কোনও ‘প্রতিবাদ’ (ছাপার অক্ষরে বা মৌখিক) সে ভাবে কখনও আসেনি, তাই ধরে নিয়েছিলাম, সেগুলো ঠিকঠাকই হবে। আপনার ছবিও দেখা যেত কাগজে। ভোটের দিন ‘পাঠভবন’ স্কুলের বুথে বাবা-মায়ের সঙ্গে ভোট দিতে গিয়েছেন। কিন্তু সে ভাবে অতীতে কখনও আপনি সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে বিশদে কথাবার্তা বলেছেন বলে রিপোর্ট করা হয়নি। কখনও-সখনও মনে হত, আপনি বরাবরই বিখ্যাত (এবং শেষের দিকে বিতর্কিত) বাবার ছায়ায় আচ্ছন্ন। কিন্তু তার বেশি আপনাকে নিয়ে কোনও দিন মাথা ঘামানোর প্রয়োজন পড়েনি। মোদ্দা কথা— আপনি কোনও দিন আমার রাডারে ছিলেন না।
বছর দুয়েক আগে এক দুপুরে একটি অচেনা নম্বর ভেসে উঠল মোবাইলে। যা দিনকাল পড়েছে, সাধারণত অজ্ঞাত নম্বরে সাড়া দিই না। কেন জানি না, সে দিন ধরে ফেললাম।
‘‘আপনি অনিন্দ্য জানা বলছেন?’’
—বলছি।
‘‘আমার নাম সুচেতনা ভট্টাচার্য!’’
উপ্স! মাথাটা চোঁ করে ঘুরে গেল। আধ ঘণ্টা আগেই আনন্দবাজার অনলাইনে খবর প্রকাশিত হয়েছে, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কন্যা সুচেতনা ভট্টাচার্যের কোভিড হয়েছে। তিনি নিভৃতবাসে থাকছেন। এক সহকর্মী স্টোরিটা দেওয়ার পর মনে হয়েছিল, এক বার যাচাই করে তার পর প্রকাশ করা উচিত। কিন্তু তথ্যটা বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ। বুদ্ধদেব নিজে অসুস্থ। সঙ্গে রয়েছেন তাঁর প্রৌঢ়া স্ত্রী। তাঁদের একমাত্র কন্যার কোভিড হয়ে থাকলে সেটা বড় খবর! কিন্তু মুশকিল হল, বড় খবর বলে অনুধাবন করার চেয়েও ভিতরে-ভিতরে যেটা অনেক বেশি কাজ করেছিল— প্রতিদ্বন্দ্বীদের আগে জনমানসে খবরটা জানিয়ে দিয়ে কলার তোলার বিপজ্জনক তাড়না। সেই নেশা অতীতের যাবতীয় অভিজ্ঞতা ভুলিয়ে দিয়ে একটা সম্পূর্ণ ব্যাকরণ-বহির্ভূত কাজ করিয়েছিল। ‘যা থাকে কপালে’ বলে খবর প্রকাশ করার অবিমৃশ্যকারিতা দেখিয়েছিলাম। অন্যায় হয়েছিল। পেশাগত পরিসরে মহাপাপ বললেও অত্যুক্তি হয় না।
ফোনটা ধরে রেখে যখন এ সব ভাবছিলাম, তত ক্ষণে আপনি মেশিনগান চালাতে শুরু করে দিয়েছেন। তার মধ্যে যেটা, রবি শাস্ত্রীর ভাষায় ‘ট্রেসার বুলেট’— ‘‘আপনারা খবরটা এক বারও চেক না-করেই লিখে দিলেন? আমার সঙ্গেও তো যোগাযোগ করেননি!’’
মনে মনে ভাবছিলাম, ঠিক বলছেন আপনি। এর চেয়ে ঠিক কথা আর হয় না। আমতা আমতা করে বললাম, আসলে আপনার নম্বরটা জানতাম না। কিন্তু বলার সঙ্গে সঙ্গে এ-ও ভাবছিলাম, এর চেয়ে ফালতু এবং বোকা-বোকা ওজর আর হয় না। যে মুডে রয়েছেন, এটা বললে গোলাগুলি আরও চলবে।
ঠিকই ভেবেছিলাম। আপনি দ্বিগুণ তেজে ব্রাশ ফায়ার শুরু করলেন, ‘‘এটা কোনও কথা হল? নম্বর জোগাড় করার চেষ্টা করেছিলেন? কারও কাছে জানতে চেয়েছিলেন?’’ একটু বিরতি দিয়ে, ‘‘শুনুন, এ সব মিডিয়া-ফিডিয়া নিয়ে আমার কোনও মাথাব্যথা নেই। আমি খবরটা দেখিওনি। এক বন্ধু ফোন করে জানাল, আনন্দবাজার অনলাইনে এই সব বেরিয়েছে। তার পর আমিই খুঁজেপেতে আপনার ফোন নম্বর জোগাড় করলাম। শুনে রাখুন, আমার কোভিড-টোভিড কিছু হয়নি। আমি দীর্ঘ দিন ধরেই বাবা-মা’র সঙ্গে থাকি না। আলাদা থাকি। বুঝলেন?’’
বোঝা মানে? কান-মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছে তখন। অতএব নিজের ভিতরের অনাদি আপ্তবাক্য যা বলে, তা-ই করলাম। কোনও বেভুল তর্কে না-গিয়ে সটান বললাম, আমাদের ভুল হয়েছে। ভুলও নয়, অন্যায় হয়েছে। যেটা কোনও মতেই হওয়া উচিত ছিল না। আপনার কাছে এখনই ব্যক্তিগত ভাবে শর্তহীন ক্ষমা চাইছি। আধ ঘণ্টা সময় দিন। আপনি এবং আপনার পরিবার-পরিজনদের কাছে ছাপার অক্ষরেও নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থনা করে একই জায়গায়, একই রকম গুরুত্ব সহকারে ঠিক খবর প্রকাশ করছি। আপনাকে হোয়াট্সঅ্যাপে খবরের লিঙ্কটা পাঠিয়ে দেব। তার পাঁচ মিনিট পর আপনাকে ফোন করব। লিঙ্কটা পড়ে যদি আপনার মনে হয়, সেই খবরেও কোথাও কোনও পরিমার্জন বা সংশোধনের প্রয়োজন আছে, জানাবেন। আমরা দরকারে আবার সংশোধন করব।
‘‘আমি হোয়াট্সঅ্যাপ ব্যবহার করি না (আবার ট্রেসার বুলেট)!’’
—ইমেল ব্যবহার করেন তো? লিঙ্কটা মেল করে দেব। আপনার মেল আইডি-টা বলুন।
রাগে গরগর করতে করতে আপনি মেল আইডি দিলেন। নিজের হাতে ক্ষমাপ্রার্থনা সূচক কপিটি লিখে আপলোড করে লিঙ্ক পাঠালাম। কিন্তু তার আবার কোনও জবাব আসে না! লিঙ্কটা আদৌ পড়েছেন কি না, বোঝাও যাচ্ছে না ছাই! লজ্জার মাথা খেয়ে ঘণ্টা দুয়েক পর নিজেই ফোন করলাম। কিছু ক্ষণ রিং হওয়ার পর আপনি ফোন তুললেন এবং দেখা গেল, আপনি মেলটা খুলেই দেখেননি! ঘুমিয়ে পড়েছিলেন! বুঝলাম, আগের ফোনটা খানিকটা প্রেশার কুকারের ভাল্ভের কাজ করেছে। ক্রোধের বাষ্প বেরিয়ে গিয়েছে। পরে ফোন করে জানালেন, এ বার খবরটা ঠিক আছে। ধন্যবাদও দিলেন।
সেই আপনার সঙ্গে আলাপের সূত্রপাত। সেই সূত্র ধরেই ক্রমে জানতে পারলাম, পারিবারিক পরিচয় নিয়ে আপনি সবিশেষ বিব্রত। সেটা আপনার কাছে খানিকটা ‘বোঝা’র মতোও বটে। বুদ্ধ-সন্তান না-হলে নিজের জীবনটা নিজের মতো করে বাঁচতে পারতেন। যেমন আর পাঁচটা লোক পারে। আপনার তথ্যচিত্র বানানো এবং প্রকাশনার কাজ নিয়েও আলোচনা হত। আর বাকি সংসারের কচকচানি। এক বার বললাম, আপনার বাবা কি জানেন, আপনার সঙ্গে আমার কথা হয়? উনি কিন্তু আমাকে খুব একটা পছন্দ করতেন না। করার কোনও কারণও ছিল না। পেশাগত কারণেও তাঁর সঙ্গে আমার কখনও নিয়মিত কোনও বোঝাপড়া গড়ে ওঠেনি। বরং বিভিন্ন সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি আমার পাকা এবং ডেঁপো প্রশ্ন শুনে বিরক্তই হয়েছেন। অনেক সময়েই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওঁকে আমার ব্যক্তিগত ভাবে সৎ রাজনীতিক বলেই মনে হয়েছে। তার সঙ্গে মনে হয়েছে, ব্যক্তিগত সততা নিয়ে ওঁর একটা প্রচ্ছন্ন অহমিকাও রয়েছে। যেটা সময়ে সময়ে তত প্রচ্ছন্নও থাকত না। বিশেষত, মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর।
আপনি বলেছিলেন, ‘‘বাবাকে বলেছি আপনার কথা। আপনি ঠিকই বলেছেন। উনিও বললেন আপনার সঙ্গে ওঁর ‘অম্লমধুর’ সম্পর্ক ছিল।’’ বুঝতে পারতাম, বাবা এবং তাঁর সঙ্গে মা’কে নিয়েও গভীর চিন্তিত আপনি। তাঁদের সুস্থতা নিয়ে উদ্বিগ্ন। মাঝখানে এক বার বুদ্ধদেব বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হলেন। আপনাকে শঙ্কিত মনে হল। পাশাপাশিই মনে হল, হতে পারে ‘ভট্টাচার্য’ পদবিটি আপনাকে সময়ে-অসময়ে বিরক্ত এবং হতাশ করেছে। কিন্তু বিখ্যাত বাবার কাজের পরিধি পেরিয়েও তাঁর সঙ্গে কোথাও আপনার একটা অমলিন ভালবাসার সাঁকো রয়েছে। আর মায়ের প্রতি রয়েছে প্রগাঢ় দায়িত্ববোধ।
ধীরে ধীরে একটা স্নেহমিশ্রিত বন্ধুত্বের সম্পর্কই হয়ে গেল আপনার সঙ্গে। সে সম্পর্ক বুদ্ধদেব-রহিত। সম্ভবত সেই কারণেই কখনও প্রাণে ধরে জিজ্ঞাসা করতে পারিনি যে, কাগজে আপনার সম্পর্কে যা সব পড়তাম, সে সব কি ঠিক? আপনি কি সত্যিই লোকজনের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতেন ‘মুখ্যমন্ত্রীর কন্যা’ হওয়ার সুবাদে? কারণ, আমার মনে হয়েছিল, আপনি মানুষটা ঋজু। সরলরেখার মতো। সৎ। যিনি সমস্ত টেক্সট মেসেজের পরে বাধ্যতামূলক ভাবে ‘রিগার্ডস’ লেখেন। যিনি নিজের লেখা বই তাঁকে উপহার পাঠালেও তার দাম দেওয়ার কথা ঘ্যানঘ্যান করে বলতে বলতে কানের পোকা নড়িয়ে দেন। যিনি নিজের পছন্দ এবং অপছন্দ নিয়ে অকপট। যিনি কখনও-সখনও খানিক কর্কশও বটে। হয়তো সব কথা নিজের মতো করে গুছিয়ে বলতে পারেন না। কথা বলতে বলতে খেই হারিয়ে প্রসঙ্গান্তরে চলে যান। মনে হয়, সুতোটা প্রাণপণে ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। কিন্তু পারছেন না। হয়তো সেই কারণেই কথার মাঝে খটখট করে হেসে ওঠেন। কিন্তু আপনার মধ্যে কোনও প্যাঁচ-পয়জার নেই। শিশুর মতো। সেই কারণেই আপনাকে ‘ডিল’ করা খুব কঠিন নয়।
সেই কারণেই অবাক হইনি, যখন বছর দেড়েক আগে আপনি সকালে ঘুম থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ করার মতো সহজ অনায়াসত্বে বললেন, ‘‘অনিন্দ্যবাবু, আমি কিন্তু একজন ট্রান্সম্যান! আমার এক জন পার্টনারও আছেন। আমি তাঁর সঙ্গেই থাকি। আপনি কি আমায় খারাপ ভাবলেন?’’
—খারাপ ভাবব কেন? আপনি যেমন আপনি তেমন। এটা আপনার জীবন। আপনি যে ভাবে চাইবেন, সে ভাবেই থাকবেন। সে ভাবেই বাঁচবেন।
বলেছিলাম বটে। কিন্তু পাশাপাশিই মনে হয়েছিল, কী অসম্ভব কঠিন আপনার জীবন! কী দুরূহ আপনার নিজের মতো করে নিজের জীবনটা বাঁচতে চাওয়ার অভীপ্সা! নামজাদা কমিউনিস্ট পরিবারের সন্তান। সে নাম আবার যে-সে নাম নয়। একেবারে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য! সে কমিউনিস্ট দলও আবার যে-সে দল নয়। সিপিএম! যাদের গোঁড়ামি প্রবাদপ্রতিম। পাশাপাশি আপাত-রক্ষণশীল বঙ্গসমাজের বাসিন্দা। সেই দল এবং তৎসহ এই বঙ্গসমাজ সর্বক্ষণ আপনার উপর একটা অদৃশ্য কিন্তু শক্তিশালী দূরবিন ফোকাস করে রেখেছে। অহরহ আপনাকে অণুবীক্ষণের তলায় ফেলছে। মাপছে। জরিপ করছে। বুঝতে পারছিলাম, কেন আপনি অল্পেই মেজাজ হারান। মনে মনে পুরুষ হয়েও নারীশরীরে বেঁচে থাকার যে অসহায়তা, তা আপনার কাছে এক অসহ্য গ্লানি এবং অসত্যের সমান। আপনি প্রাণপণে আপনার সত্যটি উচ্চারণ করতে চান। কিন্তু পারেন না আপনার পরিবারের কথা, সমাজের কথা ভেবে। সেই কারণেই যে ‘ভট্টাচার্য’ পদবি পেলে অনেকে বর্তে যেত, সেই পদবি আপনার অভিশাপের মতো লাগে!
পেশাদার সাংবাদিকের মায়া-টায়া হওয়া অনুচিত। বস্তুত, এ সব প্রকাশ্যে লেখা অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড কেড়ে নেওয়ার মতো অপরাধের শামিল! এমনিতেই বলে, সাতশো শকুন মরে একটা সাংবাদিক হয়। টানা চৌত্রিশ বছর এই পেশায় থাকার পর নিজেও প্রায় একটি কসাইয়ের ভূমিকায় উপনীত হয়েছি। কিন্তু তবু আপনার উপর খুব মায়া হয়েছিল। ছেলেমানুষ বলে মনে হয়েছিল। হয়তো শ্বাসবায়ুর সঙ্গে বেরিয়েও এসেছিল, ‘‘আহা রে!’’ কিন্তু সতর্ক ছিলাম। কারণ জানতাম, কানে গেলেই আপনি রোখা গলায় বলবেন, ‘‘আমি কিন্তু কাউকে ভয় পাই না! আমাকে যেন কেউ করুণা-টরুণা না করে!’’
মায়ার পরিমাণ আরও কিছু বাড়ল, যখন আপনি কোনও রাখঢাক না-করেই বললেন আপনার জীবনসঙ্গিনীর কথা। হয়তো আপনার মনে হয়েছিল, এই লোকটা আপনার পরিস্থিতিটা খানিকটা হলেও বুঝতে পারছে। আপনাকে নিয়ে ‘জাজমেন্টাল’ হচ্ছে না। একে বিষয়টা বলা যায়। হয়তো আপনার মনে হয়েছিল, আপনার মানসিকতা, আপনার ইচ্ছেটা এই লোকটার কাছে বৈধতা পাচ্ছে। ঠিক বলতে পারব না। কিন্তু তার পর থেকে আপনাকে আরও বেশি করে বুঝতে পারতাম।
সেই কারণেই আপনাদের দু’জনকেই ২০২২ সালে আনন্দবাজার অনলাইনের ‘বছরের বেস্ট’ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানালাম। আপনি খানিক বিস্মিত, খানিক অপ্রতিভ হয়েছিলেন। পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘‘আমরা কি আপনাদের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হওয়ার যোগ্য?’’
মায়া হল। মনে হল, বড্ড ছেলেমানুষ (শব্দটা ইচ্ছে করেই লিখলাম)।
আপনারা এসেছিলেন। সেই আপনার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। মাস্কে মুখ ঢেকে (না কি খানিকটা মুখ লুকিয়েই?) এসেছিলেন। জোরজার করে মাস্ক খুলিয়েছিলাম। বলেছিলাম, কোভিড আর নেই। মাস্ক পরে বসে থাকলে লোকে কী বলবে! মাস্ক খুলে রাখলেও বসেছিলেন একেবারে শেষের সারিতে। অনেক অনুরোধ করেও সামনে নিয়ে আসতে পারিনি। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ামাত্র চলে গিয়েছিলেন দু’জনে। পরে টেক্সট করে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন আমন্ত্রণ করার জন্য। বলেছিলেন, আপনাদের খুব ভাল লেগেছে। সম্মানিত লেগেছে।
আরও এক বছর কাটল। আপনার সঙ্গে মাঝেমধ্যে কথা হয়। যেমন হত। আপনার-আমার পোষ্যদের নিয়ে। আনন্দবাজার অনলাইনে কেন পরিবেশ নিয়ে বেশি বেশি লেখা হয় না, সেই অনুযোগ এবং তার জবাব নিয়ে। খুব অল্প রাজনীতি নিয়ে। কারণ, ইদানীংকার রাজনীতি নিয়ে আপনি বীতশ্রদ্ধ।
আলাপের পর থেকেই যে কফি-আড্ডা ঝুলে আছে, সে-ও ঝুলেই ছিল। তার মধ্যেই এক দিন জানালেন, আপনার শরীরে একটি অস্ত্রোপচার হয়েছে। চিন্তা হল। তবে আপনি ফিট হয়ে গেলেন। গত এপ্রিলে ‘বছরের বেস্ট’ অনুষ্ঠানে আপনাদের আবার আমন্ত্রণ জানালাম। আমন্ত্রণ জানালাম আপনার মা’কেও। আপনি এলেন মা’কে নিয়ে। কিন্তু আপনার ‘পার্টনার’ এলেন না। জিজ্ঞাসা করলাম, কেন। উনি সুস্থ আছেন তো? আপনি তা-না-না-না করে কী একটা জবাব দিয়ে কেটে পড়লেন।
তিন দিন পরে ফোন এল— ‘‘আপনাকে একটা কথা না-বলা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছি না। আসলে আমাদের ঝগড়া হয়েছিল। তাই সে দিন ও যায়নি আপনাদের অনুষ্ঠানে। কিন্তু আপনাকে আমি সে দিন সত্যি কথাটা বলতে পারিনি। খারাপ লাগছিল। যত ক্ষণ না সত্যি কথাটা বলতে পারছিলাম, তত ক্ষণ ভিতরে ভিতরে একটা অস্থিরতা চলছিল। এই আপনাকে বলে দিলাম। এখন আমি আবার ঠিক হয়ে গেলাম!’’ তার পরে আর একটু স্বস্তিসূচক গলায়, ‘‘আমাদের ঝগড়াও মিটে গিয়েছে।’’
গত বুধবার, ২১ জুন সকালে ঠিক সেই গলাতেই ফোনটা এল, ‘‘আমি ঠিক করেছি আত্মপ্রকাশ করব। আপনাকে জানালাম। কিন্তু আপনি লেখায় কোনও ভাবেই আমার পরিবারকে টানবেন না। এটা আমার একার লড়াই। আমি লড়ে নেব। যা প্রশ্নের জবাব দেওয়ার, আমিই দেব। আমার একচল্লিশ প্লাস বয়স। নিজের দায়িত্ব নিজে নিতে পারি। আমার বাবা-মা’কে যেন কেউ বিরক্ত না করে! আমি আপনাকে আমার একটা বিবৃতিও পাঠাচ্ছি। তার পরেও যদি কেউ কথা বলতে চায়, যেন আমাকে সরাসরি ফোন করে। আমি বাড়িতেও (পাম অ্যাভিনিউ) একই কথা বলে দিচ্ছি!’’
বললাম, আপনাকে নিয়ে রিপোর্ট লিখতে গেলে আপনার পারিবারিক পরিচয় আসবেই। আসা উচিতও। কারণ, যে আন্দোলনের পাশে দাঁড়িয়ে, যে আন্দোলনের জন্য আপনি এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তাঁদের সকলের জানা উচিত, আপনি আপনার সামাজিক-রাজনৈতিক পরিচয় বাজি রেখেই সিদ্ধান্তটা নিচ্ছেন। কারণ, আপনার হারানোর অনেক কিছু আছে। আপনি বুদ্ধদেবের কন্যার পরিচয়ে এত দিন পরিচিত হয়েছেন। কিন্তু সেটা অতিক্রম করে আপনি আপনার শরীরের নারীকে বর্জন করতে চান। নিজের নাম থেকেও ‘আ’-কার বাদ দিতে চান। এই সাহস তুলনারহিত। আপনার মতো কেউ যদি এই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, তা হলে অন্য আরও অনেকে এমন সাহস পাবেন।
প্রশ্ন করলাম, এই সিদ্ধান্ত নিয়ে বাবার সঙ্গে কথা বলেছেন?
আপনি বললেন, ‘‘আমার বাবা তো ছোটবেলা থেকেই ব্যাপারটা জানতেন! উনি তো ছোটবেলায় আমার গালে সাবান মাখিয়ে আমার দাড়িও কামিয়ে দিতেন!’’
বললেন আর আমার কাছে হাট করে অন্য একটা দরজা খুলে গেল! যার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে রয়েছেন এক কমিউনিস্ট নেতা। যাঁর সম্পর্কে দাম্ভিক, উন্নাসিক আরও কী কী সব বলা হয়ে থাকে (আমিও যে ভাবিনি, তা নয়)। অবাক লাগছিল যে, তাঁর ভিতরেও এতখানি স্বতোৎসারিত সহিষ্ণুতা ছিল! হয়তো তাঁর ‘আত্মজা’ বলেই ছিল। কিন্তু সেই কারণেই কি বিষয়টা মেনে নেওয়া আরও কঠিন ছিল না? বিশেষত, তাঁর বামপন্থী পটভূমিকার কথা ভাবলে? ফলে আপনাকে বলতে হল যে, কপির হেডিংয়েই আপনার পিতৃপরিচয়টা দিতে হবে। সেটা এই ঘটনায় বাড়তি গুরুত্ব বহন করে।
আপনি রাজি হলেন। কিন্তু আপনার ভিতরে সম্ভবত তখন খানিক অবিশ্বাসও টিকটিক করতে শুরু করেছে। শুরু হয়েছে ঈষৎ বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলও। বললেন, ‘‘খবরটা প্রকাশ করার আগে কি এক বার আমাকে লেখাটা পাঠাবেন?’’
বললাম, আমি নীতিগত ভাবে তার বিরোধী। খবর প্রকাশের আগে কাউকেই তা পাঠাই না। পাঠাইনি কোনও দিন। খবরটা প্রকাশের পর আপনার যদি মনে হয়, কিছু ভুল লেখা হয়েছে, জানাবেন। সেই মতো সংশোধন করে দেব। কিন্তু প্রকাশের আগে আমি বা আমরা কাউকে লেখা খবর পাঠাই না। দুঃখিত, আই ডু নট অপারেট দ্যাট ওয়ে!
কে জানে কেন, আপনি বুঝলেন। আপত্তি করলেন না। মনে হল, আপনি আর ছেলেমানুষ নেই। যে আপনি হাসতে হাসতে বলতেন, ‘‘আপনার দাড়িটা দেখে আমার হিংসে হয়’’ বা ‘‘আপনি তো মশাই এক্কেবারে মনুবাদী’’, সেই ‘আপনি’র মাথা ছাড়িয়ে অন্য একটা ‘আপনি’ উঠে দাঁড়াচ্ছেন। সমাজের সমস্ত ঘাত-প্রতিঘাত, ঝড়ঝাপ্টা সামলে নেবেন বলে তৈরি হচ্ছেন। ‘সুচেতনা’ থেকে ‘সুচেতন’-এ এক নির্ভুল উচ্চারণ এবং এক অমোঘ উত্তরণ ঘটেছে আপনার।
তার পর থেকে ঝড়ের মতো কাটছে আপনার জীবন। মাঝেমধ্যে কথা হয়েছে। আপনাকে এই লেখার কথা জানাইনি। জানানোর কথাও নয়। কিন্তু ঠিক করেছিলাম, আপনার জীবনের মাত্র দুটো বছর দেখা, আপনার যাবতীয় জড়তা, সঙ্কোচ, দ্বিধা, ভয় কাটিয়ে বেরিয়ে আসার যাত্রার কথাটা আপনাকে ‘কুর্নিশ’ জানিয়ে লেখা উচিত।
এখন আর আপনার গোপন করার কিছু নেই। কিছু হারানোরও নেই। বরং জয় করার জন্য পড়ে আছে এলজিবিটিকিউ+ দুনিয়া। সাহস দেওয়ার জন্য রয়েছেন আরও অনেক সহযোদ্ধা। নইলে আপনাকে নিয়ে খবরটা প্রথম বেরল আনন্দবাজার অনলাইনে। প্রত্যাশিত ভাবেই তুমুল আলোড়ন পড়ল চরাচরে। দেখলাম, সমাজমাধ্যমে আপনাকে অভিনন্দন জানানোর ঢেউ উঠেছে। আশ্বস্ত হলাম। কিছু কুচো তৃণমূল আপনাকে নিয়ে রঙ্গ-রসিকতা শুরু করায় রাজনৈতিক দিক থেকে শত্রুশিবিরের অন্যতম মুখপাত্র কুণাল ঘোষ ‘মতামত ব্যক্তিগত’ বলেও টুইট করলেন, ‘‘সুচেতনা ভট্টাচার্যের সিদ্ধান্ত তাঁর নিজের। এ নিয়ে কোনও টিপ্পনী, কটাক্ষের কারণ নেই। অধিকারও নেই। ব্যক্তিগত বিষয়ে চর্চা সুরুচির পরিচায়ক নয়। সুচেতনা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সেটা তিনি নিতেই পারেন বলে মনে করি। সাহসী মনোভাবের জন্য সুচেতনাকে অভিনন্দন।’’ এতটা বোধহয় আপনি নিজেও প্রত্যাশা করেননি। সমাজমাধ্যমে প্রশংসার ঝড়ের কথা বলার সময় আপনার কণ্ঠে সেই আনন্দিত বিস্ময় ধরা পড়ছিল বার বার।
এর মধ্যেই এক দিন বলছিলেন, ‘‘শুনুন অনিন্দ্যবাবু, আমি কিন্তু আপনার ছোট ভাই।’’
মায়া হল? নাহ্, আর মায়া হল না। সম্ভ্রম হল। মনে মনে বললাম, ছোট ভাই নয়, আপনি বরং আমার কাছে বড় দাদার মতো। গরিমায়। ঋজুতায়। সৎসাহসে।
আপনি কি এই সমাজে আরও একটু সাহস বিলি করতে পারেন, সুচেতন?