Suchetana Bhattacharjee

‘সুচেতন’-এর সু চেতনাকে অভিনন্দন জানিয়ে অভিমত, এর ফলে আরও গতি পাবে প্রান্তিকদের আন্দোলন!

লিঙ্গ পরিবর্তন করে ‘সুচেতন’ হতে চান প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কন্যা সুচেতনা ভট্টাচার্য। সেই মর্মে আইনি পরামর্শও নিতে শুরু করেছেন। নিজের মতো করে বাঁচতে চাওয়ার চেষ্টাকে কুর্নিশ জানাচ্ছেন অনেকেই।

Advertisement
সুচন্দ্রা ঘটক
কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ জুন ২০২৩ ১৭:১২
lgbtqia+

সুচেতন ভট্টাচার্য ওরফে (অ্যালিয়াস) সুচেতনা ভট্টাচার্য। (সামনে, বাঁ দিক থেকে) অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুজয়প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, ঊষসী চক্রবর্তী, রত্নাবলী রায় এবং দেবলীনা। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

অন্যের বিপ্লবে পাশে থাকা এক কথা। নিজের জন্য জোর গলায় কোনও কথা বলতে পারা, আর এক। এবং সেটাই বেশি কঠিন। পারিবারিক পরিচয়, সমাজ, রাজনীতি— সব কিছু ছাপিয়ে গিয়ে যে ‘ব্যক্তিপরিচয়’ গুরুত্ব পেতে পারে, বুধবার তা নতুন করে প্রকাশ্যে এসেছে। রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের একমাত্র কন্যা সুচেতনা ভট্টাচার্যের লিঙ্গ পরিবর্তনের সিদ্ধান্তের কথা শুনে এমনই মত প্রকাশ করেছেন অনেকে।

লিঙ্গ পরিবর্তন করে ‘সুচেতন’ হতে চান সুচেতনা। সেই মর্মে আইনি পরামর্শও নিতে শুরু করেছেন। বুধবার সকালে এই খবর প্রকাশিত হয় একমাত্র আনন্দবাজার অনলাইনে। তার পর থেকেই পরিপার্শ্বে হইচই পড়ে গিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সমাজমাধ্যমেও তুফান উঠেছে। তবে আশার কথা, বেশির ভাগই সুচেতনার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। তাঁকে কুর্নিশ জানিয়েছেন খোলাখুলি।

Advertisement

সম্প্রতি যৌনতার নিরিখে প্রান্তিকদের জন্য আয়োজিত একটি কর্মশালায় অংশ নিয়েছিলেন সুচেতনা (যদিও তিনি চান, তাঁকে এখন ‘সুচেতন’ বলেই সম্বোধন করুন সকলে)। তার পরেই তিনি ঠিক করেন, নিজের ব্যক্তিপরিচয় সর্বসমক্ষে আনবেন। বুধবার আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘‘আমি এটা করছি আমার এই এলজিবিটিকিউ+ আন্দোলনের অঙ্গ হিসাবে। এক জন ট্রান্সম্যান হিসাবে প্রতি দিন আমায় যে সামাজিক হেনস্থার শিকার হতে হয়, সেটা আমি বন্ধ করতে চাই।’’

ঘটনাচক্রে, জুন মাস ‘প্রাইড মান্থ’। এই মাসটির একটি ঐতিহাসিক তাৎপর্য আছে। ‘এলজিবিটিকিউএআই’ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত অনেকেই এই মাসে নানা কর্মশালা-আলোচনাসভার আয়োজন করে থাকেন। সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা করেন। সেই জুন মাসে সুচেতনার এমন সিদ্ধান্ত খুব গুরুত্বপূর্ণ এক সন্ধিক্ষণ হয়ে রয়ে গেল।

সুচেতনার এই পদক্ষেপকে সমাজের একটি বড় অংশ ‘সাহসী’ বলেই দেখছে। মূলস্রোতের অভ্যাসের বাইরে গিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নিতেই সমস্যায় পড়তে হয় অধিকাংশকে। সেখানে সুচেতনা অনেকের পরিচিত। তাঁর পিতৃপরিচয় এবং পারিবারিক পরিচয়ও ফেলে দেওয়ার মতো নয়। ফলে নিজের সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করলে যে সামাজিক ভাবে নানা জনের নানা মন্তব্যের শিকার হতে পারেন, তা তাঁর অজানা নয়। তা সত্ত্বেও যে তিনি নিজের লিঙ্গপরিচয় নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলছেন, তাকেই সাহসী পদক্ষেপ বলে মনে করছে সমাজের নানা মহল।

lgbtqia+

এলজিবিটিকিউএআই আন্দোলন আজকের নয়। বহু শতক ধরে চলছে। দেশে দেশে নানা ভাবনা নতুন করে উঠে এসেছে। ছবি: পিক্সাবে।

যে মঞ্চে নিজের ভাবনার কথা প্রকাশ করেছিলেন সুচেতনা, সেখানে উপস্থিত ছিলেন অভিনেত্রী ঊষসী চক্রবর্তী। যৌনতার নিরিখে প্রান্তিকদের আন্দোলন যে গতি পাবে সুচেতনার এই পদক্ষেপে, তা মনে করেন ঊষসীও। ঘটনাচক্রে, সুচেতনার মতোই তাঁর পরিবারের সঙ্গেও বাম রাজনীতির গভীর যোগাযোগ। উষসীর বাবা অধুনাপ্রয়াত সিপিএম নেতা শ্যামল চক্রবর্তী। তিনি বলেন, ‘‘পরিচিত কেউ মুখ খুললে, এগিয়ে এলে অবশ্যই তার একটা প্রভাব পড়ে। আরও অনেকে নিজেদের অবস্থান প্রকাশ করার সাহস পান। আর যত মানুষ নিজের কথা স্পষ্ট করে বলে নিজের মতো করে বেঁচে থাকার সাহস পাবেন, ততই সফল হবে আন্দোলন।’’ সুচেতনার মতো যাঁদের একটা ‘সামাজিক প্রভাব’ আছে, তাঁদের আরও বেশি করে নিজেদের মতামত প্রকাশ করতে পারা জরুরি বলে মনে করেন উষসী।

মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় সুচেতনার এই পদক্ষেপকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন। অনুত্তমার কথায়, ‘‘সুচেতনকে কুর্নিশ। কারণ, এটা শুধু ব্যক্তি সিদ্ধান্ত উচ্চারণ নয়। আরও অনেকে, যাঁরা এই সিদ্ধান্তকে সামনে আনতে পারছেন না, তাঁদের হয়তো এই উচ্চারণ সাহস দেবে। এমন আরও অনেক মানুষ আছেন। কোনও ব্যক্তি যখন এমন সিদ্ধান্ত নেন, তিনি পরিচিত মানুষ হলে তাঁকে দেখে আরও অনেকে এই সিদ্ধান্ত উচ্চারণ করার সাহস পান। কোনও পরিচিত ব্যক্তি যখন এমন সিদ্ধান্তকে উচ্চারণ দেন, একেবারে অপরিচিত বলয় থেকে আক্রমণ আসতে পারে, এই সম্ভাবনা সত্ত্বেও পিছিয়ে যান না, আরও অনেক মানুষের কাছে তা উদাহরণ হয়ে উঠতে পারে।’’ অনুত্তমার (যিনি সচেতন ভাবেই ‘সুচেতনা’কে ‘সুচেতন’ বলে সম্বোধন করেছেন) মতে, ‘‘আমার মনে হয়, সুচেতনের এই অবস্থান খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই সিদ্ধান্ত কখনও ৪১ বছরে এসে মানুষ নেন না। নিজের লিঙ্গপরিচয় সম্পর্কে সম্যক ধারণা অনেক ছোটবেলায় গড়ে ওঠে। আজ এই সিদ্ধান্তকে সমাজের সামনে উচ্চারণ করলেন সুচেতন।’’

মনের মধ্যে থাকা লিঙ্গপরিচয়কে সমাজের সামনে প্রকাশ করতে পারা একটি জরুরি পদক্ষেপ। নানা সময়েই এমন কথা উঠে এসেছে। বিভিন্ন সময়ে রূপান্তরকামীদের নানা হেনস্থার কথা প্রকাশও পেয়েছে বার বার। তেমন সব অভিজ্ঞতার মাঝে সুচেতনার এই সিদ্ধান্ত আলাদা গুরুত্ব বহন করে বলেই জানাচ্ছেন যৌনতার নিরিখে প্রান্তিকদের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত অনেকে।

lgbtqia+

‘পিআরসি-র ৮০তম প্রতিষ্ঠা বছর উদ্‌যাপন উপলক্ষে ১০ জুন, ২০২৩ অ্যাকশন টু হেল্‌থ অফ দ্য এলজিবিটিকিউ+কমিউনিটি ওয়ার্কশপে সুচেতনা ভট্টাচার্য। ছবি: ফেসবুক।

এলজিবিটিকিউএআই আন্দোলন আজকের নয়। বহু শতক ধরে চলছে। দেশে দেশে নানা ভাবনা নতুন করে উঠে এসেছে। অত্যাচার, হেনস্থার কথা বলতে পেরেছেন অনেকে। তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছেন কেউ কেউ। কেউ বা সাহস পাওয়ার অপেক্ষায় আছেন। মনোসমাজকর্মী রত্নাবলী রায় সুচেতনার সিদ্ধান্তকে সেই আন্দোলনের অঙ্গ হিসাবেই দেখছেন। তিনি বলেন, ‘‘নিজের পিতৃ-মাতৃ পরিচয় সরিয়ে রেখে কেউ যে নিজের কথা এ ভাবে বলতে পারছেন, তা আসলে অনেকের কৃতিত্ব। গোড়ার দিকে যাঁরা আন্দোলন শুরু করেছিলেন, সুচেতনের এ ঘোষণা তাঁদের সাফল্য।’’ এই পদক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন রত্নাবলী। তিনি মনে করেন, এর পর আরও মানুষ নিজেদের লিঙ্গপরিচয় সমাজের সামনে প্রকাশ করতে পারবেন।

সুচেতনাও যে যৌনতার নিরিখে প্রান্তিকদের আন্দোলনকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন, তা তাঁর কথাতেও স্পষ্ট।

এলজিবিটিকিউএআই সংক্রান্ত কর্মশালা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘‘বিভিন্ন জেলা থেকে আসা এলজিবিটিকিউ+ মানুষদের সঙ্গে পরিচিত হতে পেরে খুব ভাল লেগেছে। তথাকথিত ‘মূলস্রোত’ সমাজের চোখরাঙানি, উপহাস, ঘৃণাকে মোকাবিলা করে এঁরা যে ভাবে লড়াই করছেন, এগিয়ে চলেছেন, তা আমার কাছে বিশেষ শিক্ষণীয়।’’

এলজিবিটিকিউএআই আন্দোলনের সঙ্গে গভীর ভাবে যুক্ত পরিচালক দেবলীনা। এ বিষয়ে বহু ছবি বানিয়েছেন তিনি। সুচেতনার এই পদক্ষেপকে রাজনৈতিক দিক থেকেই দেখছেন তিনি। দেবলীনা বলেন, ‘‘সুচেতন জানিয়েছেন যে, এই পদক্ষেপ তিনি করছেন একটি আন্দোলনের অংশ হিসাবে। এটা হয়তো আর এক পা এগিয়ে গিয়ে বলা। তিনি নিজের হেনস্থার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি এক জন পরিচিত মানুষ। তা সত্ত্বেও তাঁকে হেনস্থার শিকার হতে হয়েছে। তবে যাঁরা প্রত্যন্ত কোনও অঞ্চলে থাকেন, তাঁদের কথা ভাবুন! সুচেতন যে পদক্ষেপ করেছেন, তা বেশ জোরালো বলে মনে করি। এই ভাবনা একেবারেই রাজনৈতিক। ওঁকে অভিনন্দন।’’

তবে এতটা এগিয়েও যে এখনও এমন ভাবনা আলাদা করে ভাবতে হয়েছে সুচেতনার মতো এক জনকে, তা নিয়ে আবার চিন্তিত অনেকে। সমাজের একটি অংশ সে কথাও মনে করাচ্ছে। সুচেতনা এক জন স্বাধীন নাগরিক। তবু নিজের মতো করে বাঁচতে চাওয়া কত কঠিন, তা তাঁর এই ঘোষণা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল বলে মনে করেন তাঁরা। যৌনতার নিরিখে প্রান্তিকদের লড়াই এখনও যে অনেক দিন ধরে চালিয়ে যেতে হবে, সে কথা মনে করায় এই ঘটনা। এক জন নিজের মতো করে থাকবেন, তা অন্যদের জানাতে হবে কেন, সে প্রশ্ন তোলেন কেউ কেউ। অভিনেতা সুজয়প্রসাদ চট্টোপাধ্যায় যেমন বলেন, ‘‘সুচেতনা যদি সুচেতন হতে চান, সে তো তাঁর নিজস্ব সিদ্ধান্ত। তাঁর নিজের পরিচয়। আমি এতে চমকিত হইনি। এমনই তো হওয়ার কথা। তবে তা দেখে যদি কেউ অনুপ্রাণিত হন, সেটা ভাল।’’

সকলে নিজের মতো করে বাঁচার সুযোগ পান না বলেই এত দিন ধরে চলছে আন্দোলন। সুচেতনার পদক্ষেপ তা অনেকটা এগিয়ে নিয়ে গেল বলেই মনে করেন কেউ কেউ। কেউ আবার মনে করাচ্ছেন, আন্দোলন এগিয়েছে বলেই সুচেতনা ‘সুচেতন’ হয়ে উঠতে পারছেন।

আরও পড়ুন
Advertisement