‘ইন্ডিয়া’ নিয়ে বঙ্গ সিপিএমে ক্ষোভের আগুন। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
পটনায় বিরোধী জোটের বৈঠকের পর ‘ক্ষোভ’ তৈরি হয়েছিল সিপিএমের নিচুতলায়। কিন্তু বেঙ্গালুরুতে ‘ইন্ডিয়া’ তৈরির পর তা শঙ্কার আকার নিয়েছে। এমনটা একান্ত আলোচনায় মেনে নিচ্ছেন দলের অনেক নেতা। যা নেতৃত্বের কাছে খানিকটা ‘উদ্বেগ’ নিয়ে হাজির হয়েছে। সে উদ্বেগের আঁচ পাচ্ছে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটও। সিপিএম সূত্রে খবর, পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর্যালোচনা করতে যখন জেলায় জেলায় দলীয় সদস্যদের নিয়ে সাধারণ সভা হবে, সেখানে মূল আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠতে পারে ‘ইন্ডিয়া’। কারণ একটাই—তৃণমূলের সঙ্গে এক মঞ্চে যাওয়া। অনেকে এমনও আশঙ্কা করছেন, বিজেপিতে চলে-যাওয়া ভোট পঞ্চায়েত ভোটে যা-ও বা কিছুটা ফিরেছিল, এমন হলে লোকসভায় ফের সেই ভোটের বাক্সবদল হতে পারে। সিপিএমের এক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যের কথায়, ‘‘বুঝতে পারছি প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। বাংলার প্রেক্ষাপটে সেটা হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এর বাইরে কী করার ছিল! জোটে না গেলে পার্টি সম্পর্কে বিজেপি-বিরোধী পরিসরে কী বার্তা যেত? তা ছাড়া সংখ্যালঘুদের মধ্যেও ধারণা খারাপ হত।’’ ওই নেতা আরও বলেন, ‘‘কোন ভাবনা থেকে সর্বভারতীয় স্তরে বৈঠকে যেতে হচ্ছে, তা দলের কর্মী-সমর্থকদের কাছে ব্যাখ্যা করা হবে।’’
প্রথমে ২০১৯ সালের লোকসভা ভোট এবং তার পরে ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে শূন্য হয়ে গিয়েছিল সিপিএম। তখন থেকেই তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই শুরু করতে হয়েছে। তবে তার পর বালিগঞ্জের বিধানসভা উপনির্বাচন হোক বা পুরসভা ভোট— দেখা গিয়েছিল বামেদের ভোট বাড়ছে। শুধু তা-ই নয়, প্রধান বিরোধী দল বিজেপি অনেক এলাকাতেই তিন নম্বরে চলে যাচ্ছিল। সাগরদিঘি উপনির্বাচনে বাম-সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী বাইরন বিশ্বাসের জয় দেখে অনেকেই ধারণা করেছিলেন, তৃণমূলের বিরোধী হিসাবে বাম-কংগ্রেসের ‘ইতিবাচক অগ্রগতি’ হচ্ছে। কিন্তু সদ্যসমাপ্ত গ্রামীণ ভোটে ফের দেখা গিয়েছে, দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে গেরুয়া শিবিরই। তবে গত বিধানসভা ভোটের তুলনায় বাম-কংগ্রেসের মিলিত ভোট ১৬ শতাংশের মতো বেড়েছে। সিপিএমের অনেকের আশঙ্কা, ‘ইন্ডিয়া’ সেই সমীকরণ পাল্টে দিতে পারে।
পাশাপাশিই ২১ জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে কংগ্রেসের প্রতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সচেতন নীরবতা’ চাপ বাড়িয়েছে রাজ্য সিপিএমের। অনেকে এই ভয়ও পাচ্ছেন যে, এর ফলে লোকসভায় কংগ্রেস-তৃণমূল জোটের রাস্তা প্রশস্ত হয়ে গেল না তো? যদিও প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী স্পষ্টই বলেছেন, ‘‘বাংলায় কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূলের কোনও সমঝোতা হবে না!’’
বঙ্গ সিপিএমও প্রাথমিক ভাবে তৃণমূলকে আক্রমণের রাস্তা থেকে সরতে চাইছে না। বরং অতীতে মমতার সঙ্গে বিজেপির সখ্যের কথা সমাজমাধ্যমে আরও বেশি করে প্রচারে আনা হচ্ছে। কিন্তু তাতে যে বরফ গলছে না, তা-ও বুঝতে পারছেন সিপিএম নেতারা। আগামী ২৫-২৬ জুলাই সিপিএমের দু’দিনের রাজ্য কমিটির বৈঠক। সূত্রের খবর, পঞ্চায়েত পরবর্তী ‘পার্টি চিঠি’তে বিরোধী পরিসরের ‘ইন্ডিয়া’ বড় জায়গা নিতে পারে।
২০০৮ সালে পারমাণবিক চুক্তিতে ইউপিএ-১ সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের পর বঙ্গ সিপিএমের বড় অংশ প্রকাশ কারাটকে খুব একটা ভাল ভাবে নেয় না। তবে সীতারাম ইয়েচুরির ‘গ্রহণযোগ্যতা’ প্রশ্নাতীত। কিন্তু ‘ইন্ডিয়া’ পর্বের পর সীতারামকে নিয়েও অনেকে নানা কথা বলতে শুরু করেছেন। যদিও সিপিএম সাধারণ সম্পাদক স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, কেরলে যেমন কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সিপিএমের লড়াই, তেমনই বাংলায় তৃণমূল-বিজেপি উভয়ের বিরুদ্ধেই লড়বে তাঁদের দল। কিন্তু সমাজমাধ্যমে সক্রিয় দলের সমর্থক এবং হিতৈষীরা বার বার নীচুতলার কর্মীদের কথা বলছেন। এমনও লেখা হচ্ছে যে, ‘‘যারা গ্রামেগঞ্জে তৃণমূলের হাতে মার খেল, এখন তাদেরই তৃণমূলের সঙ্গে জোট করতে বলা হবে?’’ তার পাল্টা প্রতিক্রিয়াও আবার দেখা যাচ্ছে। সমাজমাধ্যমে এ নিয়ে জোরালো তর্কবিতর্ক শুরু হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে আপাতত মুচকি হাসছে তৃণমূল। বাংলার শাসকদল মনে করছে, বিজেপি-বিরোধী লড়াইকে শক্তিশালী করতে হলে সিপিএমকে তৃণমূলের ‘উগ্র বিরোধিতা’ ছাড়তে হবে। কারণ, বাংলায় বিজেপিকে রুখতে পারে একমাত্র তৃণমূলই। ২০২১-এর ভোট তা প্রমাণ করে দিয়েছে। ফলে ফাঁপরে পড়েছে সিপিএম। সেই কারণেই দলের কর্মী-সমর্থকদের পরিস্থিতির ‘বাধ্যবাধকতা’ বোঝাতে বিশেষ কর্মসূচি নেওয়ার ভাবনাচিন্তাও চলছে দলীয় স্তরে।