Arpita Mukherjee

এক বছর হল মেয়ের জেল জীবন, মুক্তি পেলে নিজের বাড়ি ছাড়া আর কোথায় যাবে! বলছেন অর্পিতার মা

গত বছর ২৩ জুলাই পার্থের মতোই ইডি গ্রেফতার করেছিল অর্পিতাকেও। তাঁর দু’টি ফ্ল্যাট থেকে যে নগদ ও সোনার গয়না উদ্ধার হয়েছিল (৪৯.৮০ কোটি টাকা), তা যে ‘দুর্নীতির টাকা’, আদালতে তা জানিয়েছে ইডি।

Advertisement
সারমিন বেগম
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ জুলাই ২০২৩ ০৮:০২
Completion of one year custody of arrested Arpita Mukherjje in school recruitment scam, how her mother reacts

এক বছর জেলবন্দি অর্পিতা মুখোপাধ্যায়। বেলঘরিয়ার বাড়িতে অপেক্ষোয় মা মিনতি। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

বাড়ির পাঁচিলের ইটে নোনা ধরে গিয়েছে। জোড়া দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই স্পষ্ট অযত্নের ছাপ। শ্যাওলা, জংলা গাছ। পৈতৃক বাড়ির কড়িকাঠে ঘুণ ধরেছে। ঘরদোরও অবিন্যস্ত। বাঁ দিকের লোহার সিঁড়ি দিয়ে উঠে যে ঘর, সেখানে থাকেন এক সত্তরোর্ধ্বা বৃদ্ধা। নাম মিনতি মুখোপাধ্যায়। এক বছর আগে তাঁকে সকলে চিনে গিয়েছিলেন। এখন ভুলে গিয়েছেন। তিনি অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের মা। নিয়োগ দুর্নীতিতে গ্রেফতার হওয়া অর্পিতা। যাঁর আরও একটা পরিচয়, পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ‘ঘনিষ্ঠ’।

বছর ঘুরে গিয়েছে। অর্পিতা এখনও কারাবন্দি। বেলঘরিয়ার দেওয়ানপাড়ার বাড়িতে অর্পিতার মা মিনতি রূঢ় বাস্তব মেনে নিয়েও স্বপ্ন দেখছেন। রূঢ় বাস্তব এই, সহজে মেয়ের জেলমুক্তি হবে না। আর স্বপ্ন? মিনতি বললেন, ‘‘এক দিন ঠিক ছাড়া পাবে! তার পর তো এই বাড়িতেই আসবে!’’ ঠিকই। জামিন পেলেও কোথায় বা যাবেন! ডায়মন্ড সিটির ফ্ল্যাট, কামারহাটির ক্লাব টাউনের ফ্ল্যাট— সবই তো ইডির হেফাজতে।

Advertisement

গ্রেফতারির পর দীর্ঘ ১০ মাস জামিনের আবেদন করেননি অর্পিতা। শেষ পর্যন্ত গত মে মাসে জামিনের আবেদন করেন তিনি। শুনানিতে সশরীরে অর্পিতাকে হাজির করানো হয় আদালতে। তাঁর হয়ে সওয়াল করেন দিল্লির দুঁদে আইনজীবী বৃন্দা গ্রোভার। যিনি পার্থকেই নিয়োগ দুর্নীতির ‘মাস্টার মাইন্ড’ বলে দাবি করেন এজলাসে। অন্য দিকে, ইডির তরফ থেকে বলা হয়, পার্থ যদি ‘রাজা’ হন, তা হলে অর্পিতা ‘ডিফ্যাক্টো রানি’ (প্রকৃত রানি)। তবে চোখে গ্লুকোমা নিয়েও অর্পিতার মা মিনতি স্বপ্ন দেখেন, মেয়ে জামিন পাবেন। তাঁর কথায়, ‘‘ও কিছু জানলে সবই নিশ্চয়ই বলেছে। ও তো আর চাকরি কেনাবেচা করেনি। তা হলে জামিন পাবে না কেন?”

গত বছর ২২ জুলাই দুপুরে অর্পিতার ডায়মন্ড সিটির ফ্ল্যাটে হানা দিয়েছিল ইডি। সে দিন সকাল থেকে রাজ্যের মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতেও তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদ চলছিল। সন্ধ্যায় ডায়মন্ড সিটির ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হয় টাকার পাহাড়। যা দেখে নড়েচড়ে বসেছিল গোটা রাজ্য। সেই সূত্রেই প্রকাশ্যে আসে অর্পিতার নাম এবং ছবি। প্রকাশ্যে আসে পার্থ-অর্পিতার সম্পর্কের রসায়ন। সেই ঘটনার সুবাদে অর্পিতা এতটাই পরিচিত হয়ে গিয়েছিলেন এবং তাঁকে নিয়ে এতই আগ্রহ তৈরি হয়েছিল যে, পার্থকে যখন আদালতের নির্দেশে ইডি ভুবনেশ্বর এমসে নিয়ে গিয়েছিল, তখন সেখানকার লোকজনও তদন্তকারী সংস্থার আধিকারিকদের প্রশ্ন করেছিলেন, ‘‘অর্পিতা আসেননি?’’ অর্থাৎ, তাঁরা অপেক্ষায় ছিলেন অর্পিতার।

Completion of one year custody of arrested Arpita Mukherjje in school recruitment scam, how her mother reacts

বেলঘরিয়া দেওয়ান পাড়ায় অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের পৈতৃক বাড়ি। — নিজস্ব চিত্র।

যেমন অপেক্ষায় রয়েছেন অর্পিতার মা মিনতি। এক চোখে অস্ত্রোপচার হয়েছে। গ্লুকোমার চিকিৎসা চলছে। ওজনও বিপদসীমার অনেকটাই উপরে। তাঁর ফ্ল্যাট থেকে টাকা উদ্ধারের দিন কয়েক আগেও মায়ের সঙ্গে দেখা করতে বেলঘরিয়ার বাড়িতে এসেছিলেন অর্পিতা। আগে গাড়ি করে এসে মাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতেন। গত এক বছর ধরে তা-ও বন্ধ। হাতে চশমা নিয়ে মিনতি বললেন, ‘‘এখন অন্যদের সাহায্য নিয়ে হাসপাতালে যাই। এই তো কিছু দিন আগে চোখ দেখিয়ে এলাম।”

মেয়ের সঙ্গে তাঁর মাঝেমাঝে ‘ভিডিয়োকল’-এ কথা হয়। জেল থেকেই ‘ই-সাক্ষাৎ’ করিয়ে দেওয়া হয়। তবে তা-ও বড়জোর মিনিট খানেক। কিছু পরামর্শ দেন মেয়েকে? মিনতির জবাব, ‘‘ও কি বাচ্চা নাকি? ও যা করার বুঝেই করবে!’’

এক বছর আগে ২৩ জুলাই পার্থের মতোই ইডি গ্রেফতার করেছিল অর্পিতাকেও। তাঁর দু’টি ফ্ল্যাট থেকে যে বিপুল নগদ ও সোনার গয়না উদ্ধার হয়েছিল (৪৯.৮০ কোটি টাকা), তা যে ‘দুর্নীতির টাকা’, আদালতে তা জানিয়েছে ইডি। বেবির (অর্পিতার ডাকনাম) উল্কাসদৃশ উত্থান নজর এড়ায়নি দেওয়ান পাড়ার প্রতিবেশীদেরও। মা মিনতি অবশ্য গোড়া থেকেই বলে এসেছেন, তিনি জানতেন মেয়ের গাড়ি, ফ্ল্যাট, বৈভবের জীবন— সবই মডেলিং, অভিনয়, নখ নকশার পার্লার থেকে রোজগারের টাকায়। বৃদ্ধা বললেন, গত এক বছরে পড়শিদের কেউ মেয়ের প্রসঙ্গ তুলে বা প্রশ্ন করে তাঁকে ‘বিব্রত’ করেননি। আর বললেন, ‘‘আমি এই পাড়ার পুরনো বাসিন্দা। সকলে জানে আমি কেমন মানুষ।’’

কখনও বিয়ে করে থিতু হতে বলেননি মেয়েকে? মিনতি বললেন, ‘‘মা হয়ে কি আর বলিনি! কিন্তু পুরুষমানুষ সম্পর্কে ওর বোধহয় অন্য রকম ধারণা আছে!’’ কী ধারণা? অর্পিতার মা বললেন, ‘‘শুধু আমার মেয়ে কেন! অনেক মেয়েই আছে, যারা অনেক ছেলের সঙ্গে ঘোরে। ওর কাছে অনেকে টাকা চাইত। ও দিয়েও দিত। ফেরত পেত না।’’ কিন্তু এমনও বললেন, ‘‘ওর (অর্পিতার) তো এখনও বিয়ে হতে পারে!’’

অর্পিতা যে অনেক ছবিতে অভিনয় করেছেন তা নয়। কিন্তু বাংলার পাশাপাশি ওড়িয়া ছবিতেও অভিনয় করেছেন তিনি। কলেজ জীবন থেকে মডেলিংয়ে হাতেখড়ি তাঁর। অর্পিতার বাবা কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরি করতেন। বাবার মৃত্যুর পর সেই চাকরি অর্পিতা করবেন বলে ভেবেছিলেন মা মিনতি। কিন্তু বিনোদনের আলো ঝলমলে জগতের হাতছানি এড়িয়ে সরকারি চাকরির দিকে যাননি অর্পিতা। মিনতিও রাজ্য সরকারের অর্থ দফতরে ৩৩ বছর চাকরি করেছেন। অনেকেই বলেন, তৎকালীন মন্ত্রী পার্থের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার পর থেকে অর্পিতার জীবনযাত্রা বদলে যেতে থাকে। ‘পার্থের পুজো’ বলে খ্যাত উদয়ন সংঘের ‘মুখ’ও হয়েছিলেন অর্পিতা। মিনতি অবশ্য জানালেন, পার্থের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার বিষয়ে তিনি কিছু জানতেনই না! তাঁর কথায়, ‘‘ভৈরব গাঙ্গুলি কলেজে এক বার একটা অনুষ্ঠানে এসেছিলেন উনি (পার্থ)। সেই সময়ে বাড়ির সামনে এসেছিলেন। ঘরে ঢোকেননি।’’

গত বছর ২৪ জুন নিয়োগ দুর্নীতিতে ইসিআইআর (এনফোর্সমেন্ট কেস ইনফর্মেশন রিপোর্ট) দায়ের করে তদন্ত শুরু করে ইডি। ২২ জুলাই পার্থ, মানিক ভট্টাচার্য-সহ একযোগে শিক্ষা দফতরের একাধিক আধিকারিকের বাড়িতে হানা দেয় ইডির একাধিক দল। কলকাতা এবং মেদিনীপুর জুড়ে চলে তল্লাশি। ওই দিন পার্থের বাড়ি থেকে উদ্ধার হয় ‘ইচ্ছে এন্টারটেনমেন্ট’, ‘সেন্ট্রি ইঞ্জিনিয়ারিং’-এর নথি। পার্থের বাড়িতে অর্পিতার নাম থাকা ‘ডিড’-সহ বেশ কিছু কাগজপত্র থেকে একাধিক সংস্থার যোগের কথা সামনে এসেছিল বলে জানান এক ইডি আধিকারিক।

মেয়ে কি রাজসাক্ষী হবে? জবাব দিতে গিয়ে কিছুটা গলার স্বর নামিয়ে নিলেন মা মিনতি, ‘‘সংবাদমাধ্যম থেকে এটা এক বার শুনেছিলাম। তবে ও তো (তদন্তে) সাহায্যই করেছে।’’

Advertisement
আরও পড়ুন