West Bengal Panchayat Election 2023

২০১৮-কে ছুঁতে না-পেরেও প্রায় কাছাকাছি, ৯টি জেলা পরিষদ বিরোধীশূন্য এবং সব জেলাই শাসক তৃণমূলের

স্থানীয় সূত্র এবং শাসক, বিরোধী নানা পক্ষের অভ্যন্তরীণ মূল্যায়নের ভিত্তিতে বেশ কয়েকটি জেলা পরিষদে হাড্ডাহাড়ি লড়াইয়ের সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেওয়া হলেও ফলাফল বলছে তা একেবারেই মেলেনি।

Advertisement
সায়ন ত্রিপাঠী
কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০২৩ ২০:০৫
Overall results of Zila Parishad level in WB Panchayat Election 2023

ভোটে নিরঙ্কুশ জয়ের পরে তৃণমূল সমর্থকদের উল্লাস। ছবি: পিটিআই।

ছিল ২০-তে ২০। হলও তাই। রাজ্যের পঞ্চায়েত ভোটে জেলা পরিষদ স্তরে তৃণমূলের নিরঙ্কুশ জয় দেখে দলের একাংশ বলছেন, দেখতে গেলে এ-ও এক ‘টি২০’ জয়! যেখানে ‘টি’-র অর্থ ‘টোটাল’, পুরোটাই। তবে বিরোধীশূন্য জেলা পরিষদ গঠনের ক্ষেত্রে ২০১৮ সালের তুলনায় সামান্য পিছিয়ে রইল তৃণমূল।

গণনার আগে পর্যন্ত বিরোধীদের দাবি ছিল, রাজ্যে অন্তত চার-পাঁচটি জেলা পরিষদে ‘হাড্ডাহাড্ডি’ লড়াই হবে। জনমত সমীক্ষাতেও আলিপুরদুয়ার, কোচবিহারের মতো জেলায় এগিয়ে রাখা হয়েছিল বিরোধীদের। কিন্তু ভোটের ফল বলছে, ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটের মতো এ বারেও সব ক’টি জেলা পরিষদই তৃণমূলের দখলে। তার মধ্যে ন’টি বিরোধীশূন্য। কারণ, ওই জেলা পরিষদগুলিতে বিরোধীরা ‘খাতা খুলতে’ পারেনি।

Advertisement

তবে ‘বিরোধীশূন্য’ জেলা পরিষদ গড়ার ক্ষেত্রে ২০১৮ সালের তুলনায় অনেকটা পিছিয়ে তৃণমূল। ২০১৮ সালে তারা ১১টি জেলায় ১০০ শতাংশ আসনে জিতেছিল। জলপাইগুড়ি, দক্ষিণ দিনাজপুর, উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হুগলি, পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিম বর্ধমান এবং বীরভূম ছিল সেই তালিকায়। এ বারও দক্ষিণ দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি, পশ্চিম মেদিনীপুর, উত্তর ২৪ পরগনা, পূর্ব বর্ধমান এবং পশ্চিম বর্ধমান ফের বিরোধীশূন্য। তালিকায় নতুন সংযোজন আলিপুরদুয়ার, হাওড়া ও ঝাড়গ্রাম।

এ ছাড়া দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা পরিষদে ৮৫টি আসনের মধ্যে ৮৪টি জিতেছে তৃণমূল। হুগলির ৫৩-র মধ্যে ৫১টি, কোচবিহারে ৩৪টি আসনের মধ্যে ৩২টি। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ১টিতে আইএসএফ এবং কোচবিহার ও হুগলি জেলা পরিষদে ২টি করে আসন গিয়েছে বিজেপির দখলে। বাঁকুড়ার ৫৬টির মধ্য়ে তৃণমূল ৫৫ এবং বিজেপি ১টিতে জিতেছে।

পূর্ব মেদিনীপুরে ৭০টি আসনের মধ্যে তৃণমূল ৫৬ এবং বিজেপি ১৪টিতে জিতেছে। মালদহের ৪৩টি আসনের মধ্যে তৃণমূল ৩৩, কংগ্রেস ৬ এবং বিজেপি ৪টিতে। পুরুলিয়ার ৪৫টি আসনের মধ্যে তৃণমূল ৪২, বিজেপি ২ এবং নির্দল ১টি আসনে জয়ী। অর্থাৎ ফলাফল থেকে স্পষ্ট, কাগজে-কলমে বিরোধীশূন্য না হলেও বেশ কিছু জেলা পরিষদে বিরোধীদের উপস্থিতি একেবারেই অকিঞ্চিৎকর। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটে জেলা পরিষদ স্তরে বিরোধীদের সম্মিলিত আসন সংখ্যা ছিল, ৩.৮ শতাংশের কাছাকাছি। এ বার তা ৪.৮ শতাংশ হয়েছে। অর্থাৎ বৃদ্ধির হার মাত্র এক শতাংশের কাছাকাছি।

তৃণমূলের সবচেয়ে বেশি সাফল্য এসেছে জেলা পরিষদ স্তরে।

তৃণমূলের সবচেয়ে বেশি সাফল্য এসেছে জেলা পরিষদ স্তরে। ছবি: পিটিআই।

প্রসঙ্গত, রাজ্যের মোট ২২টি জেলায় পঞ্চায়েত নির্বাচন হলেও জেলা পরিষদ স্তরের ভোট হয়েছিল ২০টিতে। দার্জিলিং এবং কালিম্পং জেলায় পঞ্চায়েত ভোট হয়েছে দু’টি স্তরে— গ্রাম পঞ্চায়েত এবং পঞ্চায়েত সমিতিতে। কারণ, পাহাড়ে জেলা পরিষদের দায়িত্ব ও ক্ষমতা পালন করে ‘গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ (জিটিএ)। ওই ‘স্বশাসিত’ সংস্থার পৃথক নির্বাচন হয়।

রাজ্যের ২০টি জেলায় জেলা পরিষদের মোট আসনসংখ্যা ৯২৮। কিন্তু ভোট হয়েছিল ৯১২টিতে। কারণ, শাসক তৃণমূলের প্রার্থীরা ১৬টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে গিয়েছিলেন। কোচবিহারে ১টি, উত্তর দিনাজপুরে ৩টি, বীরভূমে ১টি, উত্তর ২৪ পরগনায় ৩টি এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার ৮টি আসনে ভোটের আগেই বিনা লড়াইয়ে জিতেছিল তৃণমূল। বাকি ৯১২টি আসনের সব ক’টিতেই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিল তারা।

অন্য দিকে, বিজেপি এ বার লড়ছিল ৮৯৭টি জেলা পরিষদ আসনে। সিপিএম (৭৪৭), ফরওয়ার্ড ব্লক (৫৩)-সহ বিভিন্ন বাম দলের প্রার্থীরাও জেলা পরিষদ আসনে প্রার্থী দিয়েছিল। কংগ্রেস প্রার্থী দিয়েছিল ৬৪৪টিতে। অর্থাৎ, সে অর্থে অধিকাংশ জেলা পরিষদ আসনেই বাম এবং কংগ্রেসের সমঝোতা হয়নি। বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত পাওয়া ৮০৪টি আসনের ফলাফল জানাচ্ছে তৃণমূলের ঝুলিতে ৭৬০টি গিয়েছে। বিজেপি ২৯, কংগ্রেস ১১, সিপিএম ৩ এবং নির্দল ও অন্যেরা ৩টিতে জিতেছে। বিভিন্ন দলগুলির জেলা পরিষদ স্তরের প্রাপ্ত ভোটের শতাংশের সম্পূর্ণ হিসাব এখনও মেলেনি। তবে গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরের প্রাপ্ত ভোটের বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, তৃণমূল প্রায় ৫৩ শতাংশ, বিজেপি প্রায় সাড়ে ২২ শতাংশ, বামেরা সাড়ে ১২ শতাংশ এবং কংগ্রেস সাড়ে ৫ শতাংশের মতো ভোট পেয়েছে। নির্দল এবং অন্য দলগুলির প্রার্থীরা সম্মিলিত ভাবে পেয়েছেন প্রায় ৫ শতাংশ ভোট।

২০১৮ সালের নির্বাচনে জেলা পরিষদে মোট আসনের সংখ্যা ছিল ৮২৫টি। এর মধ্যে তৃণমূল ৭৯৪ আসনে এবং বিরোধীরা ৩১ টিতে জিতেছিল। তৃণমূলের ঝুলিতে যাওয়া আসনগুলির মধ্যে ২০৩টিতে জয় এসেছিল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। বিরোধীদের মধ্যে বিজেপি ২২, কংগ্রেস ৬, বামেরা ১ এবং নির্দল ২টি জেলা পরিষদ আসনে জয়ী হয়েছিল। ২০১৮ সালের ওই নির্বাচনে তৃণমূল একাই ৫৬ শতাংশ ভোট পায়। বিজেপি পায় ১৯ শতাংশ। সিপিএম প্রায় ১০ শতাংশ এবং কংগ্রেস সাড়ে ৩ শতাংশের সামান্য বেশি ভোট পেয়েছিল ওই নির্বাচনে।

ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ভোটে জেলা পরিষদের ভোটই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং ‘রাজনৈতিক’। জেলার নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব অনেকাংশেই নির্ভর করে জেলা পরিষদ দখলের উপরেই। গ্রাম পঞ্চায়েত বা পঞ্চায়েত সমিতির ভোটে প্রতীকের থেকেও অনেক সময়ই ‘প্রার্থী’ বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। কিন্তু ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের উচ্চতম স্তরে তেমনটা প্রায় ঘটেই না। ফলে স্থানীয় ক্ষোভ বা ‘গোঁজ’ প্রার্থীর ‘ভূমিকা’র চেয়ে বৃহত্তর রাজনৈতিক পরিস্থিতিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

তৃণমূলের মুখপাত্র তাপস রায়ের বক্তব্যেও এসেছে সেই প্রসঙ্গ। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গ্রামবাংলায় উন্নয়ন কর্মসূচিকে সামনে রেখে আমরা পঞ্চায়েত ভোটে লড়েছিলাম। তিন স্তরেই আমরা বিপুল জয় পেয়েছি। পরিসংখ্যানের হিসাবে জেলা পরিষদে সেই জয়ের মাত্রা আরও বেশি, কারণ মানুষ বিরোধীদের কোনও জেলা পরিষদ পরিচালনার যোগ্য বলেই মনে করেননি। তা ছাড়া, জেলা পরিষদের ভোটে রাজ্য এবং জাতীয় স্তরের রাজনীতিও প্রভাব ফেলে। মানুষ সেখানে তৃণমূলের ভূমিকাকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছেন।’’

বস্তুত, এ বারের ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ভোটের ফলাফলেও জেলা পরিষদের ক্ষেত্রে সেই ‘বৃহত্তর প্রেক্ষাপটের’ প্রতিফলন দেখা গিয়েছে। স্থানীয় স্তরের ক্ষোভ এবং নিচুতলায় বিরোধীদের সমঝোতার প্রতিফলন গ্রাম পঞ্চায়েত এবং পঞ্চায়েত সমিতি স্তরে দেখা গেলেও জেলা পরিষদে তেমনটা হয়নি। ফলে আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার, মালদহ, মুর্শিদাবাদ, পূর্ব মেদিনীপুরের মতো ‘বিরোধী প্রভাবিত’ জেলাতেও নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছে তৃণমূল।

যদিও বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী থেকে শুরু করে সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী জেলা পরিষদে এমন ফলের জন্য গণনায় কারচুপিকে দায়ী করেছেন। শুভেন্দু বলেন, ‘‘রাতের দিকে জেলা পরিষদের গণনা পর্ব শুরু হয়েছে, তখনই জেলাশাসক, পুলিশ সুপার, মহকুমা শাসক, বিডিওদের নেতৃত্বে ভোট লুট শুরু হয়। কারচুপির মাধ্যমে, বৈধ ব্যালট বাতিল করে বিজেপি-সহ বিরোধীদের হারানো হয়েছে।’’ সুজনের কথায়, ‘‘এই ভোটের ফলাফলের কোনও ভিত্তিই নেই। মাঝরাতের পর থেকে জেলা পরিষদের গণনা শুরু হয়েছিল। অধিকাংশ জায়গায় বিরোধীদের কাউন্টিং এজেন্টকেই বসতে দেওয়া হয়নি। তৃণমূল, রাজ্য নির্বাচন কমিশন এবং পুলিশ মিলে ভয়ের বাতাবরণ তৈরি করেছিল। তাই এই ফল হয়েছে।’’

কার্যত একই সুরে কংগ্রেস নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেন, “তিন স্তরের পঞ্চায়েতের গণনা হয়েছে অত্যন্ত অবৈজ্ঞানিক ভাবে হয়েছে। প্রথমত, গ্রাম পঞ্চায়েতে ভোটগণনার পর থেকে গণনাকেন্দ্রেই শাসকদলের আক্রমণের মুখে পড়েছিলেন কংগ্রেস কর্মীরা। তবুও তাঁরা সাধ্যমতো লড়াই করেছেন। পুলিশ-প্রশাসনের ভুমিকা ছিল চূড়ান্ত পক্ষপাতদুষ্ট। ভোট গণনার সময় বিডিওরা পার্টি ক্যাডারদের মতো কাজ করেছেন। বিরোধী দলের জয়ী প্রার্থীদের হারিয়ে দিয়েছেন। তৃণমূলের পরাজিত প্রার্থীদের জিতিয়ে দিয়েছেন।’’

আরও পড়ুন
Advertisement