কলকাতা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম। — ফাইল চিত্র।
রাজ্যের পঞ্চায়েত ভোটে অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে রাজ্য নির্বাচনের কাছে কৈফিয়ত তলব করে যে উত্তরগুলি পাওয়া গিয়েছে তা যথেষ্ট নয়। প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে এমনটাই মনে করছে কলকাতা হাই কোর্ট। পঞ্চায়েত মামলার শুনানিতে এই পর্যবেক্ষণের কথা জানিয়ে বুধবার কলকাতা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম এবং বিচারপতি হিরণ্ময় ভট্টাচার্যের ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশ, বৃহস্পতিবারের মধ্যে মামলাকারীদের সব তথ্য আদালতে জমা দিতে হবে। আগামী ১৮ জুলাই এই মামলার পরবর্তী শুনানি।
অশান্তি এবং পুননির্বাচনের দাবিতে তিনটি নতুন জনস্বার্থ মামলা করেছেন শুভেন্দু অধিকারী, প্রিয়ঙ্কা টিবরেওয়াল এবং ফরহাদ মল্লিক। কমিশনের কোনও অফিসার বুধবারের শুনানিপর্বে আদালতে আসেননি। কমিশনের প্রতিনিধির অনুপস্থিতিতেই প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ জানায়, কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে অসহযোগিতার বিষয় বিশেষ ভাবে কোর্ট দেখবে। কমিশনকে পুনর্নিবাচন নিয়ে আবার দেখতে হবে। যে বুথগুলির প্রসঙ্গ মামলায় এসেছে সেগুলি দেখতে হবে। যে ঘটনা ঘটেছে তার দায়িত্ব নিতে হবে কমিশনকে।
রাজ্য সরকার ভোটের ফলাফলের পরেও কোনও অশান্তি সামলাতে পারেনি, এই ঘটনায় আদালত অবাক হয়েছে বলেও জানিয়েছে বেঞ্চ। প্রধান বিচারপতির মন্তব্য, ‘‘রাজ্য যদি নিজের নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে না পারে তা হলে সেটা গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে নোট করবে আদালত। কমিশনকে নির্দেশ হলফনামা দেওয়ার। আদালতের নজরে সব রয়েছে।’’
জয়ী প্রার্থীদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে এই মামলার ভবিষ্যতের উপর। জয়ী প্রার্থীদের উদ্দেশে নির্বাচন কমিশনকে ঘোষণা করতে হবে যে, আদালতের নির্দেশের উপর তাঁদের ফল নির্ভর করবে। কারণ, ৫০০০ বুথে পুননির্বাচনের যে দাবি করা হয়েছে নির্বাচন কমিশনারকে তা বিবেচনা করে দেখতে হবে বলেও জানিয়েছে কলকাতা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ।
প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ বুধবার জানিয়েছে, নির্বাচনের ফল ঘোষণার পরেও যে সব ঘটনা ঘটছে আদালত তা দেখে বিস্মিত। প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে, যে সন্ত্রাস, হিংসা চলছে রাজ্য তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। মানুষের জীবনধারণের স্বাধীনতার সঙ্গে আপস করা হচ্ছে। এবং পুলিশ নিরীহ মানুষকে সাহায্য করছে না বলে অভিযোগ। সাধারণ মানুষের শান্তি যাতে ভঙ্গ না হয় তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাজ্যের। যদি এটি তারা না করতে পারে তা খুবই উদ্বেগের। এবং এটিকে গুরুতর বিষয় হিসাবে আদালত নথিবদ্ধ করবে। কেন্দ্রীয় সরকারের আইনজীবীও কমিশনকে দুষে বলেন, ‘‘আজ পর্যন্ত কমিশনের কাছ থেকে আমরা স্পর্শকাতর বুথের তালিকা পাইনি। বিকেল সাড়ে ৩টের সময় কমিশনারকে ডেকে পাঠানো উচিত। কেন তিনি আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও সহযোগিতা করেননি?’’
প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ বুধবার পর্যবেক্ষণে জানায়, মঙ্গলবার ভোটের ফলঘোষণার পর থেকে বিরোধী প্রার্থীদের বাড়িঘর ভাঙচুর করার অভিযোগ আসছে। প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘‘মানুষের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে হবে রাজ্যকে। হিংসা নিয়ে কেন এত অভিযোগ উঠছে? প্রায় প্রত্যেকে এসে আদালতে বলছে অশান্তি এখনও চলছে। বোম পড়ছে। মানুষ মরছে। কী হচ্ছে এ সব?’’ এর পরেই মামলাকারীর আইনজীবীদের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘‘আপনারা অশান্তির ঘটনাগুলি পেন ড্রাইভে নিয়ে এসেছেন? ওটা চালানো হোক। এই আদালত কক্ষের সবাই তা দেখুক।’’
বিজেপির আইনজীবী গুরু কৃষ্ণকুমার অভিযোগ করেন, ফুটবলের মতো ব্যালট বক্স নিয়ে খেলা হয়েছে ভোটে। ব্যালট বক্সে লাথি মেরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আর সব কিছু পুলিশের সামনে ঘটছে। তিনি বলেন, ‘‘আমরা একটি ব্যালট বক্স পেয়েছি। গত কাল গণনাকেন্দ্র থেকে তা ছুড়ে ফেলা হয়েছিল। আমরা সেটা আদালতে নিয়ে আসতে বলেছি। তার মধ্যে ব্যালট পেপার রয়েছে।’’ এর পরেই তাঁর দাবি, ‘‘এই সমস্ত ঘটনা সিবিআইকে দিয়ে তদন্ত করা হোক। কোথায় কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে? এটা একটা নির্বাচন! নির্বাচন কমিশনার বলছেন গুলি চালানোর ঘটনার দায়িত্ব তিনি নেবেন না।’’
আবেদনকারীর আইনজীবী প্রিয়ঙ্কা বলেন, ‘‘আমি একটি ইমেল আইডি অভিযোগ জানানোর জন্য খুলেছি। এখনও অবধি ২৫০টি অভিযোগ পেয়েছি। রাজ্য জুড়ে অশান্তি চলছে। পরাজিত প্রার্থীদের উপর অত্যাচার হচ্ছে। গণনাকেন্দ্র থেকে পরাজিত এই মহিলা প্রার্থীকে চুলের মুঠি ধরে বার করে দেওয়া হচ্ছে। আর এ সবে ভূমিকা রয়েছে পুলিশের। শাসকদলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তারা কাজ করছে। বাড়ি, দোকান ভাঙচুর চলছে। ক্ষমতা দখলের জন্য তৃণমূল এত কেন ক্ষুধার্ত? আমি বলব, তৃণমূল ক্ষমতায় থাকলে ভোট দিতে যাবেন না। আপনারা ক্ষমতায় থাকুন। আমাদের শুধু বাঁচতে দিন। সন্ত্রাস, হিংসা করবেন না।’’
প্রধান বিচারপতি শিবজ্ঞানম সে সময় বলেন, ‘‘আমরা যা নির্দেশ দিয়েছিলাম তার কি কোন প্রভাব আছে? শুরুতেই দেরি হয়েছে। বাহিনী নিয়ে প্রথমে ১৩ জুন দেওয়া হয়েছিল নির্দেশ। খুব দুর্ভাগ্যজনক নির্দেশ দেওয়ার পরেও কাজ না হওয়া। রাজ্য আইনশৃঙ্খলা সামলাতে পারেনি। পুলিশ নিজেই আক্রান্ত।’’ রাজ্য নির্বাচন কমিশনের আইনজীবী জিষ্ণু সাহা জানান, প্রিসাইডিং অফিসারের রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে কয়েকশো বুথে পুনর্নির্বাচন হয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘৬ হাজার বুথে পুননির্বাচন হবে কি না, বিবেচনার জন্য দু’দিন সময় দেওয়া হোক।’’