মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র
বাংলা ভাগ বিরোধী প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা শুরু হল রাজ্য বিধানসভায়। সোমবার প্রস্তাবটি বিধানসভায় পেশ করেন রাজ্যের পরিষদীয় মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। বিধানসভায় নাম না করে তিনি আক্রমণ করেন কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী তথা বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারকে। পরে বিধানসভার অধিবেশনে যোগ দেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। শাসক এবং বিরোধী বিধায়কদের বাগ্যুদ্ধে বার বার উত্তপ্ত হয় বিধানসভার অধিবেশন।
প্রস্তাবের পক্ষে রাজ্যের মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বলেন, “বিরোধী দল জানে না কী চায়। কেউ বলছেন রাজ্য চাই। কেউ বলছেন ভাগ চাই।” মন্ত্রীর মন্তব্যের প্রতিবাদ করেন বিজেপি বিধায়কেরা। তাঁদের দাবি, দলের কেউ রাজ্য ভাগ চাননি। প্রস্তাবের বিপক্ষে বক্তব্য রাখতে উঠে শুভেন্দু বলেন, “যে প্রস্তাব আনা হয়েছে, তা মনে হচ্ছে রাজনৈতিক দলের লিফলেট।” শুভেন্দু বলেন, “রাজ্য থেকে নির্বাচিত সাংসদ, মন্ত্রী কখনও কেউ রাজ্য বিভাজনের কথা বলেননি।” ‘অখন্ড পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়নের প্রস্তাব’ আনার জন্য মন্ত্রী শোভনদেবকে অনুরোধ করেন শুভেন্দু। স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় বিরোধী দলনেতার উদ্দেশে বলেন, “আপনারাই আনতে পারতেন।” শুভেন্দুর পর বলতে ওঠেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা।
মমতা বলেন, “পশ্চিমবঙ্গ এক থাকবে। আমি শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়কে বলব, স্পিকার বিরোধী দলনেতার প্রস্তাব যুক্ত করা হোক। সংগঠিত প্রস্তাব এলে তা গ্রহণ করা হোক।” একই সঙ্গে তাঁর সংযোজন, “আমি যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোয় বিশ্বাসী। কেন্দ্র যেমন সহযোগিতা করবে, তেমনই রাজ্য কেন্দ্রকে সহযোগিতা করবে।”
সোমবার সকালে প্রস্তাব নিয়ে বিজেপির তরফে প্রথম বক্তব্য রাখেন তপনের বিধায়ক বুধিরাই টুডু। বিধানসভায় তিনি জানান, সুকান্তের মন্তব্যের অপব্যাখ্যা করা হচ্ছে। সুকান্ত বাংলা ভাগের কথা বলেননি বলেও দাবি করেন দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার এই বিধায়ক।
শাসকদলের তরফে দ্বিতীয় বক্তা হিসাবে বক্তব্য রাখেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী উদয়ন গুহ। বাংলা ভাগে উস্কানি দেওয়ার জন্য তিনি বিজেপিকে আক্রমণ করেন। বিজেপি বাংলা ভাগে প্ররোচনা দিচ্ছে, এমনটা দাবি করে বেশ কয়েকটি উদাহরণও তুলে ধরেন তিনি।
উত্তরবঙ্গের বালুরঘাট কেন্দ্র থেকে দ্বিতীয় বারের জন্য জিতে উত্তর-পূর্ব উন্নয়ন দফতরের প্রতিমন্ত্রী হয়েছেন সুকান্ত। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে উত্তরবঙ্গের কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলিকে উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রকল্পগুলির অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি। যা থেকেই নতুন করে বাংলা ভাগ সংক্রান্ত বিতর্কের সূত্রপাত। বিজেপির কার্শিয়াঙের বিধায়ক বিষ্ণুপ্রসাদ শর্মা আবার প্রকাশ্যেই সুকান্তের মন্তব্যের বিরোধিতা করেছিলেন। এই আবহে সোমবার বিধানসভায় উদয়ন বিষ্ণুর নাম না করেই তাঁকে গোর্খ্যাল্যান্ড নিয়ে অবস্থান ব্যাখ্যা করতে বলেন। কিন্তু বাংলা ভাগ নিয়ে তাঁকে কিছু বলার অনুমতি দেয়নি বিজেপি পরিষদীয় দল, এই অভিযোগ তুলে বিধানসভা থেকে ওয়াকআউট করেন তিনি। শাসকদলের বিরুদ্ধেও তাঁকে কথা বলতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ তোলেন বিষ্ণু।
উদয়নের পর বলতে ওঠেন বিজেপি বিধায়ক নীরজ তামাং জিম্বা। তিনি বলেন, “গোর্খাল্যান্ডের দাবি বঞ্চনার জন্য হয়েছে।” ঐতিহাসিক বঞ্চনা থেকেই এই দাবি উঠেছে বলে দাবি করেন তিনি। নীরজ জানান, কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের গোর্খাদের দাবি বিচার-বিবেচনা করা উচিত।
বাংলা ভাগ বিরোধী প্রস্তাব নিয়ে বলতে উঠে বিজেপি এবং তৃণমূল উভয় পক্ষকেই আক্রমণ করেন ভাঙড়ের আইএসএফ বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকি। মুখ্যমন্ত্রীকেও নিশানা করেন তিনি। নওশাদ বলেন, “আমরা রাজ্য ভাগাভাগির পক্ষে নই। বিজেপির রাজ্যসভার সাংসদ অনন্ত মহারাজ ২০২২ সালে গ্রেটার কোচবিহারের দাবি করেছেন। আর রাজ্যের প্রধান তাঁর বাড়িতে যান। প্রসঙ্গত, সম্প্রতি কোচবিহারের চকচকায় অনন্ত মহারাজের বাড়িতে গিয়েছিলেন মমতা।
প্রসঙ্গত, সুকান্ত উত্তরবঙ্গের জেলাগুলির উন্নয়নের স্বার্থে সেগুলিকে উত্তর-পূর্ব উন্নয়ন পরিষদের অন্তর্ভুক্ত করার পরেই গোড্ডার বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে বিহারের কাটিহার, আরারিয়া, কিষাণগঞ্জের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মালদহ, মুর্শিদাবাদ জেলাকে নিয়ে পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গড়ার দাবি তোলেন। মুর্শিদাবাদ জেলার দুই বিজেপি বিধায়ক গৌরীশঙ্কর ঘোষ ও কাঞ্চন মৈত্র আবার মুর্শিদাবাদ নিয়ে নিশিকান্তের দাবির সপক্ষে সওয়াল করেন।
বিধানসভায় বাংলা ভাগ নিয়ে বিজেপিকে হুঁশিয়ারি দিয়ে গত সোমবার মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘‘আসুক বাংলা ভাগ করতে। দেখিয়ে দেব কী করে রুখতে হয়! ভোট চলে গেলেই ভাগাভাগি ইস্যু নিয়ে আসা হয়। এক জন বলছেন, মুর্শিদাবাদ-মালদহ ভেঙে দাও। কেউ বলছেন, অসমের তিনটি জেলাকে নিয়ে নতুন কিছু করো। কেউ আবার উত্তরবঙ্গকে উত্তর-পূর্বের সঙ্গে যুক্ত করে দিতে বলছেন। চার মন্ত্রী বলেছেন উত্তরবঙ্গ ভাগের কথা। আমি ধিক্কার জানাই। আসুক বাংলা ভাগ করতে, কী করে রুখতে হয় দেখিয়ে দেব।’’
বাংলা ভাগ নিয়ে এই বিতর্কের আবহে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল বিধানসভায় ফের বাংলা ভাগ বিরোধী প্রস্তাব আনার পরিকল্পনা নেয়। স্থির হয় বিধানসভার চলতি অধিবেশনের শেষ দিন, সোমবারে প্রস্তাবটি আনা হবে। প্রসঙ্গত, এর আগে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এই একই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়েছিল রাজ্য বিধানসভায়।
বাংলার বিভাজন নিয়ে বিজেপির অবস্থান ব্যাখ্যা করতে গিয়ে শুভেন্দু গত সোমবার বলেছিলেন, ‘‘ভারতীয় জনতা পার্টির পরিষ্কার স্ট্যান্ড। আমরা বঙ্গভঙ্গ, বাংলা ভাগ, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল বা আলাদা রাজ্য এ সব চাই না। দলগত ভাবে আমি এটা বলতে পারি।”