(বাঁ দিকে) অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (ডান দিকে)। —ফাইল ছবি।
প্রবীণদেরই ‘গরিষ্ঠতা’ রইল। তৃণমূলের জাতীয় কর্মসমিতিতে নবীনের প্রতিনিধিত্ব বাড়বে কি না, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বৈঠক ডাকার পর থেকেই সে প্রশ্ন উঠেছিল। কিন্তু বৈঠকের শেষে দেখা গেল, নবীনের সংখ্যা বৃদ্ধি তো দূরস্থান, উল্টে প্রবীণদের প্রতিনিধিত্বই বৃদ্ধি পেল। পুনর্গঠিত কমিটিতে জায়গা পেলেন দলের পাঁচ প্রবীণ নেতা— বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়, দুই সাংসদ মালা রায়, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রাজ্যের দুই মন্ত্রী জাভেদ খান এবং মানস ভুঁইয়া। এবং এঁরা সকলেই মমতার ‘ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন’ বলেই তৃণমূলের অন্দরে পরিচিত।
তৃণমূলে ‘নবীন বনাম প্রবীণ’ লড়াই শুরু হয় ২০২১ সালে দল তৃতীয় বার রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পরে পরেই। তা বড় আকার নেয় গত লোকসভা নির্বাচনের আগে। ২০২৪ সালের প্রথম দিনই তৃণমূলের অন্দরে এই মর্মে লড়াই নিয়ে জোর আলোচনা শুরু হয় রাজ্য রাজনীতিতে। তৃণমূলের প্রতিষ্ঠা দিবস ১ জানুয়ারি নানা নেতার নানা মন্তব্যে আলোড়িত হয়েছিল শাসকদলের গোষ্ঠী রাজনীতি। রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সীকে দিয়ে দিনের শুরু। পরে প্রকাশ্য প্রতিবাদ করেন কুণাল ঘোষ। সে দিনই নবীন-প্রবীণ বিতর্ক উস্কে দেন লোকসভার দলনেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। শেষ পর্যন্ত ‘বিতর্ক’ থামাতে সন্ধ্যায় মমতা বৈঠকে ডাকেন ‘নবীন’ অভিষেকের সঙ্গে ‘প্রবীণ’ ফিরহাদ হাকিমকে।
২০২৩ সালের শেষ থেকে দলের অন্দরে অভিষেক নিজেকে কিছুটা ‘সীমাবদ্ধ’ রেখেছিলেন। ডিসেম্বরের শেষে অভিষেকের সঙ্গে দেখা করে দলের অন্দরে তাঁর ‘ঘনিষ্ঠ’ বলে পরিচিত কুণাল, ব্রাত্য বসু, পার্থ ভৌমিক, তাপস রায় এবং নারায়ণ গোস্বামীরা অভিষেককে ‘ময়দানে নামতে’ অনুরোধ করেন। অভিষেক তাঁদের জানিয়ে দেন, লোকসভা ভোটে তিনি তাঁর রাজনৈতিক কাজকর্মের গণ্ডি নিজের কেন্দ্র ডায়মন্ড হারবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চান। এর পরে পরেই দলের প্রতিষ্ঠা দিবসের কর্মসূচিতে বক্সী বলেন, ‘‘এই নির্বাচনে যদি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় লড়াই করেন, নিশ্চিত ভাবে আমাদের ধারণা, উনি লড়াইয়ের ময়দান থেকে পিছিয়ে যাবেন না।’’ বক্সীর বক্তব্যে এমন ধারণা তৈরি হয় যে, তিনি অভিষেকের ডায়মন্ড হারবারে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখার সিদ্ধান্তকে ‘লড়াইয়ের ময়দান ছাড়া’ বলতে চাইছেন। এর পরেই মন্তব্য এবং পাল্টা মন্তব্যে ধুন্ধুমার বাধে।
ফিরহাদ বলেন, ‘‘দলে অনেকেই বলছেন, নবীন-প্রবীণের বিতর্ক রয়েছে। যুবদের মাথার উপরেও রয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আবার আমরা যারা প্রবীণ, তাদের মাথার উপরেও রয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই।’’ সুদীপ বলে বসেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় না থাকলে তৃণমূল সারা দেশের রাজনীতিতে ছাগলের তৃতীয় বাচ্চায় পরিণত হত।’’
নবীনদের ‘প্রতিনিধি’ হিসাবে সকলকেই ‘কড়া’ জবাব দেন কুণাল।
তবে লোকসভা নির্বাচন পর্বে দলের ভাল ফল সব কিছু চাপা দিয়ে দেয়। তবে ভিতরে ভিতরে সেই দ্বন্দ্ব থেকে গিয়েছিল বলেই দাবি তৃণমূলের অনেক নেতার। সদ্য বিধানসভা উপনির্বাচনে ‘ছক্কা’ হাঁকানো তৃণমূলে যখন নতুন উচ্ছ্বাস, তখন ফের সেই বিতর্ক সামনে আসে। দলীয় সূত্রের খবর, সোমবারের বৈঠকে অভিষেকের উপস্থিতিতেই মমতা বুঝিয়ে দিয়েছেন, সংগঠনে প্রবীণদের উপর তাঁর ভরসা রয়েছে। শুধু পাঁচ প্রবীণকে জাতীয় কর্মসমিতিতে নিয়ে আসাই নয়, বিভিন্ন দায়িত্ব বণ্টনেও প্রবীণদের উপরেই দলনেত্রী বেশি ‘আস্থা’ রেখেছেন।
নবীনদের দাবি নিয়ে দলের বাইরে সব চেয়ে বেশি ‘সরব’ থেকেছেন কুণাল। সাধারণ ভাবে রাজ্য বা জাতী রাজনীতির যে কোনও বিষয়েই দলের তরফে প্রতিক্রিয়া জানান কুণাল। কখনও সখনও দলের অন্দরের ‘বিতর্ক’ উস্কে দেন। অথবা নিজ উদ্যোগে নতুন বিতর্ক তৈরি করেন। সোম-বৈঠকের পর মুখপাত্রদের এক্তিয়ার বেঁধে দেওয়ার যে বিষয়টি জানানো হয়েছে, তাতে কুণালের দায়িত্ব পড়েছে বিধানসভা নিয়ে সংবাদমাধ্যমে মন্তব্য করার। প্রসঙ্গত, বিধানসভার অধিবেশনের সময় সীমিত। সাংসদ থাকলেও কুণাল কখনও বিধায়ক থাকেননি।
দলের আসন্ন কর্মসূচিতেও প্রবীণদের ‘গুরুত্ব’ বাড়ানোর বার্তা রয়েছে। তৃণমূলের ইতিহাস সম্পর্কে কর্মীদের ‘অবহিত’ করতে জেলায় জেলায় কর্মসূচি নিতে বলা হয়েছে। এক প্রবীণের ব্যাখ্যা, অতীত জানানো মানেই দলের শুরুর দিন থেকে যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের অবদান সম্পর্কে অবহিত করা। এই কর্মসূচিও প্রকারান্তরে দলে নবীনদের প্রবীণদের গুরুত্ব বোঝানোর উদ্যোগ। ওই নেতার মতে, ২০২৪ সালের শুরুতে যে ‘নবীন বনাম প্রবীণ’ বিতর্ক তৈরি হয়েছিল, বছরের শেষ লগ্নে তার উত্তর দিয়ে দিলেন মমতা।
বছরের গোড়ায় অভিষেক বলেছিলেন, ‘‘বয়স হলে কর্মক্ষমতা কমে।’’ ফিরহাদ বলেছিলেন, ‘‘যাঁরা পার্টিতে নতুন এসেছেন, অভিষেকের নেতৃত্বে যাঁরা পার্টিকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন, তাঁদের দলের ইতিহাস জানতে হবে! অনেক লড়াই-আন্দোলন করে দল ক্ষমতায় এসেছে। আমাদের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই আন্দোলন করেছেন।’’
তাঁর ‘আস্থাভাজন’ ফিরহাদের সেই বক্তব্যেই সোমবারের বৈঠকে সিলমোহর দিয়েছেন মমতা।