ধর্মতলায় অনশনমঞ্চের ভিড়। —নিজস্ব চিত্র।
নবমীর সন্ধ্যা। রাত পেরোলেই দশমী। পুজোর শেষ দিন। পুজোর শেষলগ্নে কলকাতার বিভিন্ন মণ্ডপে সাধারণ মানুষের ভিড় থাকে চোখে পড়ার মতো। কিন্তু অন্য বারের তুলনায় এ বারের ছবিটা কিছুটা আলাদা। নবমীর সন্ধ্যায় ধর্মতলা চত্বরে এত ভিড় শেষ কবে দেখা গিয়েছে, তা মনে করতে পারছেন না অনেকেই। ধর্মতলার আশপাশে কোনও পুজো নেই। তাই পুজোর দিনে অন্যান্য দিনের তুলনায় ভিড় কিছুটা কম থাকে। কিন্তু এ বছর নবমীর সন্ধ্যায় অন্যান্য নামী পুজোমণ্ডপগুলির ভিড়কে ছাপিয়ে গেল ধর্মতলা। জুনিয়র ডাক্তারদের অনশনমঞ্চের সামনে জনসমুদ্র। সাধারণ মানুষের সেই সমর্থন দেখে আপ্লুত আন্দোলনকারীরা। তাঁদের কথায়, ‘‘এই সমর্থন আমাদের আন্দোলনকে আরও জোরদার করে তুলেছে। বৃদ্ধি করছে মনোবলও।’’
শুক্রবার সকালেই সাংবাদিক বৈঠক করে ধর্মতলায় ‘মহাসমাবেশে’র ডাক দিয়েছিলেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টর্স ফ্রন্ট’, জুনিয়র ডাক্তারদের মিলিত মঞ্চের তরফে শুক্রবার সকালে দেবাশিস হালদার নাগরিক সমাজকে সংহতির বার্তা নিয়ে আন্দোলনের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান। ধর্মতলার অনশনমঞ্চ সংলগ্ন অঞ্চলেই সমাবেশের ডাক দেন তাঁরা। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে হাজার হাজার মানুষ ভিড় জমান ধর্মতলায়। দুপুরের পর থেকেই ধর্মতলার ছবি আস্তে আস্তে পাল্টাতে শুরু করে। মানুষের ঢল নামতে শুরু করে সেখানে। অনশনমঞ্চের সামনের রাস্তা দিয়ে সকালেও গাড়ি চলছিল, কিন্তু দুপুরের পর থেকে তা একে বারে বন্ধ হয়ে যায়। বলা ভাল, মানুষের ভিড়ের কারণে বাধ্য হয়েই ওই লেনে গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেয় কলকাতা পুলিশ।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভিড় বেড়েছে ধর্মতলা চত্বরে। অনশন মঞ্চের সামনে ব্যারিকেড দিয়ে ঘেরা ছিল। তবে তার বাইরে রাস্তা ছিল সাধারণ মানুষের দখলে। তাঁদের মধ্যে কেউ রাস্তায় ছবি আঁকছেন, কেউ স্লোগান দিচ্ছেন, কেউ কেউ আবার জাতীয় পতাকা হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। অনেকের হাতেই পোস্টার। সবকিছুতেই প্রতিবাদের ভাষা। হাজার হাজার কণ্ঠে ‘আগুনের পরশমণি’ গানও পুজোর আবহে অন্য হাওয়া বইয়েছে। হাজার হাজার মোবাইলের ‘ফ্ল্যাশলাইটে’র আলো ম্লান করে দিয়েছে রাস্তার সব আলোকে। ধর্মতলায় পালিত হল এক ভিন্ন পুজো।
‘মহাসমাবেশ’-এর ডাক
শুক্রবার সকালে আরও জোরালো আন্দোলনের বার্তা দিয়েছিল ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টর্স ফ্রন্ট’। জুনিয়র ডাক্তারদের মিলিত মঞ্চের তরফে সাংবাদিক বৈঠক করে দেবাশিস হালদার নাগরিক সমাজকে সংহতির বার্তা নিয়ে আন্দোলনের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানালেন। শুক্রবার বিকেলে ধর্মতলার অনশনমঞ্চ সংলগ্ন অঞ্চলেই সমাবেশের ডাক দিয়েছেন তাঁরা। শহরবাসীর উদ্দেশে দেবাশিসের বার্তা, “আমাদের সহযোদ্ধাদের লড়াই ও মানসিক দৃঢ়তার পাশে দাঁড়ান। নবমীর বিকেলে ধর্মতলার মোড়ে এই জমায়েতকে এক ‘মহাসমাবেশ’-এর রূপ দিন।’’
অনশনকারীদের শারীরিক অবস্থা
শুক্রবার সপ্তম দিনে পা রেখেছে ধর্মতলায় জুনিয়র ডাক্তারদের আমরণ অনশন। ১০ দফা দাবিতে শনিবার রাত সাড়ে ৮টা থেকে ধর্মতলায় আমরণ অনশন শুরু করেন কলকাতার বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের ছয় জুনিয়র ডাক্তার। তাঁরা হলেন, তনয়া পাঁজা, স্নিগ্ধা হাজরা, সায়ন্তনী ঘোষ হাজরা, অনুষ্টুপ মুখোপাধ্যায়, অর্ণব মুখোপাধ্যায় এবং পুলস্ত্য আচার্য। রবিবার অনশনে যোগ দেন আরজি করের জুনিয়র ডাক্তার অনিকেত মাহাতোও। বৃহস্পতিবার রাতে শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় অনশনরত অনিকেতকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। বর্তমানে সিসিইউতে চিকিৎসা চলছে তাঁর। অন্য অনশনকারীদের শারীরিক অবস্থাও আশঙ্কাজনক।
মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি চিকিৎসক সংগঠনগুলির
শুক্রবার সকালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি পাঠায় ‘জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অফ ডক্টর্স’। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে জুনিয়র এবং সিনিয়র ডাক্তারদের যাবতীয় দাবি মেটাতে সরকারকে হস্তক্ষেপ করার আহ্বান জানালেন তারা। এর আগেও গত তিন দিন ধরে একই দাবি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর দ্বারস্থ হয়েছেন, কিন্তু সুরাহা হয়নি।
অন্য দিকে, বৃহস্পতিবার রাতেই মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছে সর্বভারতীয় চিকিৎসক সংগঠন ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (আইএমএ)। একই মর্মে প্রশাসনকে হুঁশিয়ারি দেয় আইএমএ বেঙ্গলও। এ বার ফের ‘চরমতম পদক্ষেপ’ করার ‘হুমকি’ দিয়েছে আইএমএ।
‘মহাসমাবেশ’কে সমর্থন বামেদের
ডাক্তারদের ‘মহাসমাবেশ’কে আনুষ্ঠানিক ভাবে সমর্থন করে রাজ্য বামফ্রন্ট। রাজ্য বামফ্রন্টের তরফে বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়েছে, সাধারণ মানুষকে শুক্রবার বিকালে ধর্মতলায় ডাক্তারদের ডাকা সমাবেশে অংশ নিতে অনুরোধ করা হয়। কলকাতা, হাওড়া, হুগলি এবং কলকাতা-সংলগ্ন দুই চব্বিশ পরগনা থেকে দলীয় কর্মীরা যেন শুক্রবার ধর্মতলার সমাবেশে যোগ দেন, তেমনই নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল দলের তরফে। এ-ও বলা হয়, কোনও রকমের সাংগঠনিক পতাকা নিয়ে যেন কেউ না আসেন। নাগরিক হিসাবেই যেন কর্মসূচিতে অংশ নেন।
অনশন তোলার অনুরোধ আইএমএ সভাপতির
শুক্রবার বিকেলে জুনিয়র ডাক্তারদের অনশনমঞ্চে যান আইএমএ-র প্রতিনিধিরা। আইএমএ-র সর্বভারতীয় সভাপতি আরভি অশোকন বেশ কিছুক্ষণ ছিলেন অনশনস্থলে। সেখানে তিনি কথা বলেন অনশনরত জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে। কথা বলার পর আইএমএ-র সর্বভারতীয় সভাপতি বলেন, “অনশনকারীরা নিজেদের জন্য লড়ছেন না। তাঁরা লড়ছেন সাধারণ মানুষের জন্যই।” তবে অনশনকারীদের শারীরিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে অনশন তুলে নেওয়ার অনুরোধ করেন অশোকন।
ত্রিধারাকাণ্ডে জামিন মঞ্জুর হাই কোর্টের
দক্ষিণ কলকাতার একটি পুজো মণ্ডপের সামনে আরজি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদ জানানোয় নয় ছাত্রের গ্রেফতারি নিয়ে কলকাতা হাই কোর্টে প্রশ্নের মুখে পড়ল কলকাতা পুলিশ এবং রাজ্য। ধৃতদের জামিন মঞ্জুর করে আদালত। বিচারপতি শম্পা সরকার স্পষ্ট জানিয়ে দেন, ধৃতদের পুলিশি হেফাজতে রাখার কোনও প্রয়োজন নেই।
হাই কোর্টের নির্দেশে হাসি-কান্নার ছবি অনশনমঞ্চে
ত্রিধারাকাণ্ডে জামিনের খবর অনশনমঞ্চে এসে পৌঁছতেই হাসি ফুটল ধর্মতলা চত্বরে আন্দোলন-অনশনে বসা জুনিয়র ডাক্তারদের মুখে। দেবাশিস যখন এই ঘোষণা করেন, তখন হাততালিতে ফেটে পড়ে ধর্মতলা-চত্বর। সকলের চোখেমুখেই এক আনন্দের ছবি। এ যেন তাঁদেরই জয়। সেই আনন্দে চোখে জল দেখা গেল অন্যতম অনশনকারী স্নিগ্ধা হাজরার। শুধু স্নিগ্ধা নন, অন্য অনশনকারীরাও কেঁদে ফেললেন।
স্নিগ্ধার বাড়িতে পুলিশ
আরজি কর-কাণ্ডের প্রেক্ষিতে অনশনে বসা জুনিয়র ডাক্তারদের অন্যতম স্নিগ্ধা হাজরার বাড়িতে যায় পুলিশ। বৃহস্পতিবার গভীর রাত এবং শুক্রবার সকালে স্নিগ্ধার বাঁকুড়া শহরের প্রতাপবাগানের বাড়িতে গিয়েছিলেন পুলিশকর্মীরা। তবে জুনিয়র ডাক্তারের পরিবারের কারও দেখা পাননি তাঁরা। মাঝরাতে মিনিট ৪০ দরজার বাইরে কড়া নেড়ে ফিরে যাওয়ার পরে সকালে মূল দরজা তালাবন্ধ দেখে দ্বিতীয় বার ফিরতে হয়েছে পুলিশকে। সরকারি ভাবে পুলিশের তরফে এই খবরের সত্যতা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার বৈভব তিওয়ারি জানিয়েছেন, অনশনরত চিকিৎসকের স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে তাঁর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিল পুলিশ।
অনশন প্রত্যাহারের অনুরোধ মুখ্যসচিবের
জুনিয়র ডাক্তারদের অনশন প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়ে শুক্রবার আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারদের চিঠি দিলেন রাজ্যের মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ। জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অফ ডক্টর্স-এর তরফে তাঁদের বিভিন্ন দাবির কথা জানিয়ে বৃহস্পতিবার একটি ইমেল পাঠানো হয়েছিল মুখ্যসচিবকে। তারই জবাবি ইমেলে রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিষবায় ‘স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে’ অনশন প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।