নবমীর বিকেলে জুনিয়র ডাক্তারদের অনশনমঞ্চে একসঙ্গে তিন প্রজন্ম। —নিজস্ব চিত্র।
পুজোর জামা পরে আছে দুই খুদে। এক জনের বয়স দশ। অন্য জনের পাঁচ। দু’জনের জামার এক প্রিন্ট। বুকে সাঁটা ব্যাজ—উই ওয়ান্ট জাস্টিস। তারা দুই বোন। এক জন হাত ধরে আছে মায়ের, অন্য জন ঠাকুমার। এসেছিলেন বেহালা থেকে।
ডোরিনা ক্রসিংয়ে কলকাতা পুলিশের এলইডি বোর্ডের নীচে ওয়াকার হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক বৃদ্ধা। তাঁর হাত ধরে রয়েছেন এক তরুণ। বাড়ি হাওড়ার আন্দুলে।
চার মাসের সন্তানকে কোলে নিয়ে নৈহাটি থেকে এসেছিলেন অন্তরা দত্ত। ছিলেন স্বামী শুভব্রতও। স্লোগানের ছন্দে ছেলেকে কোলে নিয়ে উঁচুতে তুলে ধরছিলেন বাবা।
নবমীর বিকেল থেকে সন্ধে জুনিয়র ডাক্তারদের অনশন মঞ্চ হয়ে উঠল ‘মণ্ডপ’। যাকে ঘিরে প্রতিবাদের উৎসব দেখল কলকাতার প্রাণ কেন্দ্র। যে মণ্ডপকে কেন্দ্র করে মিলে গেল অনেক প্রজন্ম। কোনও ঠাকুমা এলেন নাতির হাত ধরে। কোনও মেয়ে তাঁরা বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে এলেন হুইলচেয়ারে বসিয়ে। শুক্রবার জুনিয়র ডাক্তারদের ডাকা ‘মহাসমাবেশে’ ধর্মতলা হয়ে উঠল আক্ষরিক অর্থেই প্রজন্ম চত্বর।
শাশুড়ি, দুই কন্যা সন্তানকে নিয়ে ধর্মতলায় এসেছিলেন বেহালার অনিন্দিতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কেন নবমীর বিকালে ধর্মতলায়? মেয়েদর দিকে আঙুল দেখিয়ে অনিন্দিতা বললেন, ‘‘আমারও তো দুই মেয়ে। যা হচ্ছে, তাতে ঘরে বসে থাকা যায় না। আরজি কর থেকে জয়নগর— সব কিছুর বিচার চাই।’’ খানিক ক্ষণ আগেই কলকাতা হাই কোর্ট অন্তর্বর্তী জামিন মঞ্জুর করেছে ত্রিধারার প্যান্ডেলে ‘বিচার চাই’ স্লোগান দেওয়ার অপরাধে ধৃত ৯ জন আন্দোলনকারীকে। অনশন স্থলে তখন যুদ্ধজয়ের আনন্দ। আর আনিন্দিতা বলে উঠলেন, ‘‘এই যে ছেলেগুলোকে গ্রেফতার করেছে, এটা কোন দেশের নিয়ম হতে পারে? আমি তো মনে করি ওঁরা স্লোগান দিয়ে ঠিক করেছেন।’’ আদালতের নির্দেশের খবর অনশনমঞ্চে পৌঁছনো মাত্রই দেখা যায় অনশনকারী চিকিৎসক স্নিগ্ধা হাজরা অঝোরে কাঁদতে শুরু করেছেন। আর জটলা থেকে স্লোগান উঠছে, ‘একটা জাস্টিস ছিনিয়ে নিলাম, অন্যটাও ছিনিয়ে নেব’।
উঁচু থেকে ভিড়কে চাক্ষুষ করবেন বলে পুলিশ কিয়স্কের ধারের রেলিং টপকে অনেক মানুষ উঠে দাঁড়িয়েছিলেন ডিভাইডারে। বোনের মেয়েকে কোলে নিয়ে রেলিং টপকে সেখানে উঠে পড়েছিলেন গড়িয়া আটা বাগান থেকে সমাবেশে আসা অর্পিতা সিংহ রায়। পাশে ছিল তার তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া ছেলে অরিন দে-ও। পুজোর মধ্যে এখানে কেন? অরিনের জবাব, ‘‘ডাক্তার দিদিটার জন্য জাস্টিস চাইতে এসেছি।’’
জুনিয়র ডাক্তারদের সমাবেশকে আনুষ্ঠানিক ভাবে সমর্থন জানিয়েছিল রাজ্য বামফ্রন্ট। ঝান্ডাহীন অথচ সিপিএমের চেনামুখের সংগঠিত জমায়েত ছিল ধর্মতলার সমাবেশে। ছিলেন মহম্মদ সেলিম, সূর্যকান্ত মিশ্র, সুজন চক্রবর্তীর মতো নেতারাও ছিলেন, তবে মঞ্চ থেকে দূরে। আন্দোলনকারীদের অনুরোধে সুজনদের আরও দূরে সরতে হয়েছে। সাধারণ কর্মী, মাঝারি স্তরের নেতারা মঞ্চের সামনের ভিড়ে মিশে ছিলেন। বক্তৃতা করতে গিয়ে কার্যত সিপিএমকেই বার্তা দিয়ে জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলনের নেতা দেবাশিস হাসদার বলেন, ‘‘বেশ কিছু রাজনৈতিক দল বিষয়টা (জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন) এমন ভাবে দেখানোর চেষ্টা করছে, যেন এই ডাক তাদের। এটা খুবই দুঃখজনক। আমরা বার বার বলছি দলীয় স্বার্থ এবং পতাকা দূরে রেখে, যে কোনও মানুষ যোগ দিতে পারেন। এই আন্দোলনকে হাইজ্যাক করা চেষ্টা হচ্ছে। অনুরোধ করব তেমন যেন না করা হয়।’’
সমাবেশ থেকে প্রায় প্রত্যেক বক্তাই জানান দিতে চাইলেন, সাধারণ মানুষের সমর্থনই তাঁদের সাহস যোগাচ্ছে। দেড়শো ঘণ্টা অতিক্রান্ত করা অনশনকারীরা শারীরিক ভাবে দুর্বল হলেও মানসিক ভাবে সতেজ। কারণ মানুষ তাঁদের পাশে রয়েছেন। সমাবেশে বক্তৃতা করেন অনশনকারী চিকিৎসক সায়ন্তনী ঘোষ হাজরাও। গলার স্বরে শারীরিক দুর্বলতা স্পষ্ট। একই সঙ্গে স্পষ্ট মানসিক দৃঢ়তাও। বললেন, ‘‘নবমীর জমায়েত বুঝিয়ে দিচ্ছে আমরা ৯ অগস্টকে ভুলব না। ভুলতে দেবেন না। আমাদের শরীর দুর্বল। কিন্তু আমাদের মনোবল কমেনি। আজ এত মানুষের ভিড়। সকলে মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালাচ্ছেন, বিচারের দাবি তুলছেন। এই ভিড় আমাদের মনোবল বৃদ্ধি করছে।’’
একজনের বক্তৃতা শেষ হতেই স্লোগান চলছিল। সেই স্লোগান শেষ হতে ফের এক জন বক্তা। বিচারের দাবিতে হাজার হাজার মানুষ যখন স্লোগানে মুখর তখনই মঞ্চ থেকে অনুরোধ—সকলে কি একসঙ্গে ‘আগুনের পরশমণি গাওয়া যায়?’ জনতা জানান দিল, ‘হ্যাঁ’। জোনাকির মতো ফ্ল্যাশলাইট জ্বলে উঠল। হাজার হাজার আলোকবিন্দু। আন্দোলনের উৎসবের মণ্ডপের সামনে তখন ভিন্ন আলোকসজ্জা। আর ‘আগুনের পরশমণি’ হয়ে উঠল গণসঙ্গীত। যাতে গলা মেলাল অনেক প্রজন্ম। ধর্মতলা হয়ে উঠল প্রজন্ম চত্বর।