স্যালাইনের মান নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
নির্দিষ্ট একটি সংস্থার ‘রিঙ্গার ল্যাকটেট’ স্যালাইনের উৎপাদন ও সরবরাহ বন্ধের নির্দেশ আগেই দিয়েছিল রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর। তার পরেও কেন মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের প্রসূতিদের সেই সংস্থার স্যালাইন দেওয়া হল, তা নিয়ে জোরালো প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। তার খোঁজেই শনিবার হাসপাতালে গেল স্বাস্থ্য দফতর গঠিত ১৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি। পাঁচ প্রসূতিকে ওই সংস্থার স্যালাইনই দেওয়া হয়েছিল কি না, সেই সংক্রান্ত রিপোর্ট সংগ্রহ করেছে তারা। গোটা বিতর্কের আবহে ওই সংস্থার স্যালাইনকে কালো তালিকাভুক্তও করেছে স্বাস্থ্য দফতর।
একই দিনে অস্ত্রোপচার করে সন্তানের জন্ম দেওয়া পাঁচ প্রসূতি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে। তাঁদেরই এক জন মামনি রুইদাসের (২২) মৃত্যু হয় শুক্রবার সকালে। আরও তিন জনের অবস্থা সঙ্কটজনক। দু’জন এখনও ভেন্টিলেশনে রয়েছেন। আর এক জন আইসিইউ-তে ভর্তি। ওই ঘটনার পর থেকেই হাসপাতালের স্যালাইনের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। প্রসূতিদের যে স্যালাইন এবং ওষুধ দেওয়া হয়েছিল, তার নমুনা পরীক্ষায় পাঠিয়েছে ড্রাগ কন্ট্রোলের বিভাগ। তড়িঘড়ি তদন্ত কমিটি গড়ে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর। সেই তদন্ত কমিটিই শনিবার হাসপাতালে গিয়েছিল।
হাসপাতাল সূত্রে খবর, যে সংস্থার স্যালাইন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, প্রসূতিদের সেই সংস্থার স্যালাইনই কি দেওয়া হয়েছিল, অ্যানাস্থেশিয়ার ক্ষেত্রে কী কী ওষুধ ব্যবহার করা হয়েছিল, সেই সংক্রান্ত খোঁজখবর নিয়েছে তদন্ত কমিটি। প্রশ্নের মুখে পড়া সংস্থার স্যালাইন এখনও হাসপাতালে মজুত রয়েছে কি না, তারও হিসাব চেয়েছে তারা। যদি মজুত থেকে থাকে, তা হলে কেন রয়েছে, তা-ও জানতে চাওয়া হয়েছে। যে প্রসূতির মৃত্যু হয়েছে, তাঁর শারীরিক অবস্থা কেমন ছিল, সেই সময় কোন কোন চিকিৎসক দায়িত্বে ছিলেন, সে সবও জানতে চেয়েছে তদন্ত কমিটি।
তদন্ত কমিটির সদস্য ওএসডি (মেডিক্যাল এডুকেশন) আশিস বিশ্বাস বলেন, ‘‘এখনও তদন্ত চলছে। এর থেকে বেশি কিছু বলতে পারব না। ড্রাগ কন্ট্রোলার আছেন আমাদের সঙ্গে।’’ তদন্ত কমিটির সদস্যেরা অসুস্থ প্রসূতিদের সঙ্গেও কথা বলেছেন। কমিটির সদস্য সরোজ মণ্ডল বলেন, ‘‘তদন্ত চলছে। রোগীরা চিকিৎসায় সাড়়া দিচ্ছেন। সব দিক খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’ মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ মৌসুমী নন্দী বলেন, ‘‘তদন্ত চলছে। এক জন রোগী ভাল আছেন। বাকিরা আইসিইউ-তে রয়েছেন। ভেন্টিলেশনে যিনি আছেন, তাঁর প্যারামিটার একটু কম।’’
নির্দিষ্ট সংস্থার স্যালাইন নিষিদ্ধ
মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে প্রসূতিদের নিম্নমানের স্যালাইন দেওয়ার অভিযোগ ওঠার পরেই রাজ্যের হাসপাতালগুলিকে কড়া নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য এবং পরিবার কল্যাণ দফতর। জানিয়ে দেওয়া হল, সুরক্ষার কারণে রোগীদের জন্য নির্দিষ্ট একটি সংস্থার তৈরি স্যালাইন ব্যবহার করা যাবে না। ওই সংস্থার তৈরি স্যালাইন সরকারি গবেষণাগারে পরীক্ষা করা হচ্ছে। পরীক্ষা এবং তদন্তের ফল প্রকাশিত না-হওয়া পর্যন্ত নির্দিষ্ট ওই সংস্থার তৈরি স্যালাইন ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে স্বাস্থ্য দফতর। স্বাস্থ্য দফতরের এই নির্দেশ পাওয়ার পরে আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে। সেখানে ১০ ধরনের স্যালাইন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তালিকায় রয়েছে— রিঙ্গার ল্যাকটেট-৫০০ এমএল, রিঙ্গার সলিউশন আইপি ইনজেকশন-৫০০ এমএল, ডেক্সট্রোস ইনজেকশন ১০% ৬৫০ এমওএসএম/এল-৫০০ এমএল, ম্যানিটল ইনফিউশন আইপি ২০%-১০০ এমএল, প্যারাসিটামল ইনফিউশন-১০০০ মিলিগ্রাম/১০০ এমএল, অফলোক্সাসিন-২০০ মিলিগ্রাম/১০০ এমএল, লেভোফ্লোক্সাসিন-১০০ এমএল, ১/২ ডিএনএস-৫০০ এমএল, সোডিয়াম ক্লোরাইড ইরিগেশন সলিউশন-৩ লিটার, পেডিয়াট্রিক মেনটেনান্স ইলেক্ট্রোলাইট সলিউশন-৫০০ এমএল। রিঙ্গার ল্যাকটেট সরিয়ে নেওয়া হয়েছে হাওড়ার উলুবেড়িয়া হাসপাতাল থেকেও। যদিও শনিবার পর্যন্ত ওই স্যালাইন রোগীদের দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় গভর্মেন্ট মেডিক্যাল কলেজে ও হাসপাতালের অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপার নীলাঞ্জন প্রামাণিক। তিনি জানিয়েছেন, জেলা স্বাস্থ্য দফতরের নির্দেশের পরে রবিবার ওই স্যালাইন সব ওয়ার্ড থেকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
রাজনৈতিক টানাপড়েন
প্রসূতি মৃত্যুর ঘটনায় দিনভর রাজনৈতিক টানাপড়েন চলেছে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে। হাসপাতালের ভিতরে বিক্ষোভ দেখায় কংগ্রেস। জেলা সভাপতি সমীর রায়ের নেতৃত্বে চলে বিক্ষোভ। ডিওয়াইএফআই বিক্ষোভ দেখায় হাসপাতাল সুপারের অফিসের সামনে। সুপারকে না পেয়ে তারাও চলে যায় মেডিক্যাল কলেজের সামনে। মেডিক্যাল কলেজে স্বাস্থ্য দফতরের আধিকারিকদের নিয়ে বৈঠকের সময় কলেজের বাইরে গেটে বসে বিক্ষোভ দেখায় ডিওয়াইএফআই। পরে হাসপাতালের সামনের রাস্তাও অবরোধ করে তারা। সেখানে পুলিশের সঙ্গে তাদের ধস্তাধস্তিও হয়। আটক হন সিপিএমের ছাত্র-যুব সংগঠনের কয়েক জন। বিকেলে বিক্ষোভ দেখায় বিজেপিও।