সোমবার রাজভবনে (বাঁ দিকে) সিভি আনন্দ বোসের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎ। —নিজস্ব চিত্র।
বরফ কি গলে গেল? না কি আপাতত শান্তিকল্যাণ? রাজভবন আর নবান্নের ‘পরিবর্তিত’ সম্পর্ক দেখে প্রশ্ন ঘুরছে বাংলার মনে।
মাস সাতেক আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, ডাকলেও তিনি রাজভবনে যাবেন না। রাজ্যপালের দরকার হলে তিনি রাস্তায় বসে কথা বলবেন, তবু রাজভবনে নয়। তার পর গত ১৫ অগস্ট স্বাধীনতা দিবসের বিকেলে প্রথামাফিক রাজভবনে গেলেও রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসকে কিছুটা এড়িয়েই চলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু সোমবার বিকেলে সেই তিনিই আবার রাজভবনে গেলেন। প্রায় আধ ঘণ্টা কথা বললেন রাজ্যপালের সঙ্গে। সূত্রের খবর, বিশ্ববিদ্যালয়গুলির স্থায়ী উপাচার্য নিয়োগের বিষয়ে কথা হয়েছে রাজ্যপাল এবং মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যে। ঘটনাপরম্পরা দেখে রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক মহলে কৌতূহল, কী এমন ঘটল যে, রাজভবন এবং নবান্নের ‘সংঘাত’ বা ‘দূরত্ব’ কাটছে বলে মনে হচ্ছে?
এ বছর লোকসভা নির্বাচনের সঙ্গেই বাংলার চার বিধানসভায় উপনির্বাচন হয়েছিল। বিজয়ী তৃণমূল প্রার্থীরা রাজভবনে যেতে চাননি শপথ নিতে। এঁদের মধ্যে বরাহনগরে জয়ী সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘নিরাপত্তার’ কথা তুলেছিলেন। কিন্তু সেই চার জনের শপথ নিয়ে বিধানসভা-রাজভবনের বিস্তর দড়ি টানাটানি চলে। শেষ পর্যন্ত রাজ্যপালকে ‘উপেক্ষা’ করেই বিধানসভায় শপথ নিয়েছিলেন সায়ন্তিকারা। কিন্তু সদ্য হওয়া ছ’টি বিধানসভার উপনির্বাচনে বিজয়ীদের শপথের ক্ষেত্রে কোনও সমস্যা হল না। বোস নিজে বিধানসভায় গিয়ে শপথবাক্য পাঠ করান। শপথ হয় মসৃণ ভাবে।
তার পর বাংলা আবার ‘উলটপুরাণ’ দেখল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে, যে ক্ষেত্র দীর্ঘ দিন ধরে রাজভবন এবং নবান্নের মধ্যে ‘যুদ্ধক্ষেত্র’ হয়ে ছিল। ছ’টি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা যে প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন রাজ্যপাল তথা বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্যকে, তাতেও অনুমোদন মিলে গিয়েছে। তার দু’দিনের মধ্যেই দেখা গেল, মুখ্যমন্ত্রী রাজভবনে গিয়ে রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করে এলেন। যা ‘শৈত্য’ কাটার লক্ষণ।
রাজ্যপাল বোস দিল্লির ‘বার্তা’ না পেয়ে কিছু করেন না। বস্তুত, রাজ্যপালের নিয়োগকর্তা হল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক। এই রাজ্যপাল আবার স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর ‘আস্থাভাজন’ বলে শোনা যায়। অর্থাৎ, তিনি যা বলেন বা করেন, ‘রাজধানীর বার্তা’ পেয়েই করেন। মমতা তথা রাজ্য সরকারের সঙ্গে সংঘাতের পথ ছেড়ে ‘সমন্বয়ের’ যে আবহ তৈরি করছেন রাজ্যপাল, তার নেপথ্যেও কি ‘দিল্লির বার্তা’ রয়েছে? তা হলে কি কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে রাজ্য সরকারের সম্পর্কের কিঞ্চিৎ হলেও ‘উন্নতি’ হয়েছে? এ বিষয়ে সদুত্তর কেউ দিতে পারছেন না। তবে কিছু সূচক দেখে বোঝার চেষ্টা করছে রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক মহল।
লোকসভার শীতকালীন অধিবেশনে কেন্দ্রীয় সরকারকে আদানি-কাণ্ড নিয়ে ছেঁকে ধরছে কংগ্রেস এবং বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র আরও অনেক ছোটখাটো শরিক। কিন্তু তা থেকে ‘দূরে’ থাকছে জোটের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বৃহত্তম শক্তি সমাজবাদী পার্টি এবং তৃণমূল। কংগ্রেসের সঙ্গে লোকসভা এবং রাজ্যসভার কক্ষ সমন্বয়ের ক্ষেত্রেও তৃণমূল নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে এগোচ্ছে এখনও পর্যন্ত।
সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী একটি সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেছেন, চাইলে তিনিই বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র নেতৃত্ব দিতে পারেন। এমনকি, তার জন্য দিল্লি যাওয়ারও দরকার নেই, বাংলায় বসেই তিনি তা করতে পারেন বলে অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন মমতা, যা নিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে গত তিন-চার দিন ধরে আলোচনা হচ্ছে। কংগ্রেসকে ‘বিড়ম্বনায়’ ফেলা মমতার ওই মন্তব্যে কেন্দ্রীয় বিজেপি খানিকটা ‘উস্কানি’ই দিচ্ছে। রসিকজনেরা যাকে আরও একটু এগিয়ে ‘রাজনৈতিক সুড়সুড়ি’ বলতে চাইছেন। কারণ, এই মুহূর্তে কংগ্রেসই প্রধান বিরোধী দল। লোকসভায় রাহুল গান্ধী বিরোধী দলনেতা। তাঁকেই ‘নেতা’ হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে। এ কথা ঠিক যে, দেশে অর্ধেকের বেশি লোকসভা আসনে লড়াই হয় বিজেপির আর কংগ্রেসের মধ্যেই। দেশের আর কোনও দলের সেই ব্যাপ্তি নেই। জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে বিজেপির কাছে তৃণমূলের তুলনায় কংগ্রেসই ‘অনেক বড় লক্ষ্যবস্তু’। সেই কংগ্রেস যে বিরোধী পরিসরের নেতৃত্ব দিচ্ছে, সেখানে মমতা যদি নেতৃত্ব দাবি করেন, বিরোধী পরিসরে যদি কংগ্রেস সম্পর্কে ‘অনাস্থা’ তৈরি হয়, তাতে বিজেপিরই লাভ।
দীর্ঘ দিন ধরেই আবাস, গ্রাম সড়ক যোজনা, ১০০ দিনের কাজের মতো বেশ কিছু কেন্দ্রীয় প্রকল্পের বকেয়া অর্থ নিয়ে দিল্লির বিরুদ্ধে সরব তৃণমূল। আগের টাকার হিসাব না-দেওয়া নিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী থেকে শুরু করে বাংলার বিজেপি নেতারা নিয়ম করে পাল্টা বিঁধতেন তৃণমূলকে। ২০২৩ সালে ১০০ দিনের কাজের বকেয়া টাকার দাবিতে যখন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে দিল্লি-অভিযান করেছিল তৃণমূল, তখন শুভেন্দু অধিকারীও দিল্লি গিয়ে হিসাবে ‘গরমিলের তথ্য’ তুলে দিয়ে এসেছিলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর হাতে। সেই শুভেন্দুই সম্প্রতি বলেছেন, বাংলার দাবি নিয়ে তাঁরাও সরব হবেন, সব কিছুতে রাজনীতি থাকা উচিত নয়। বিরোধী দলনেতা এ-ও বলেছেন, রাজ্যের মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে দিল্লিতে যেতেও তাঁরা প্রস্তুত। অন্য দিকে গ্রাম সড়ক যোজনার কিছু টাকা রাজ্য সরকার পাবে বলেও গুঞ্জন রয়েছে। এই সব কিছুই রাজভবন এবং নবান্নের সম্পর্ক-বদলের ক্ষেত্রে ইঙ্গিতপূর্ণ।
তবে এর পাল্টা যুক্তিও রয়েছে। প্রথমত, দিল্লিতে কংগ্রেসের সঙ্গে যে ‘দূরত্ব’ রাখছে তৃণমূল এবং সমাজবাদী পার্টি, তার সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকার বা বিজেপির সখ্যের কোনও সম্পর্কই নেই। এটা নিতান্তই শরিকি টানাপড়েন। কারণ, বাংলায় তৃণমূল বা উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদী পার্টির প্রধান প্রতিপক্ষ বিজেপি। দিল্লিতে ‘দোস্তি’ , রাজ্যে ‘কুস্তি’, ব্যাপারটা এত সোজা সরল নয়। কেন্দ্রীয় ভাবে কংগ্রেস আরও দুর্বল হয়ে বিজেপি আরও শক্তিশালী হলে তা বাংলায় তৃণমূলের পক্ষে যাবে না।
আরও একটি যুক্তিও উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। তা হল, কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যের যে ‘বোঝাপড়ার সম্পর্ক’ অতি সম্প্রতি নজরে পড়ছে, তার কারণ রাজনৈতিক নয়, প্রশাসনিক। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি এর অন্যতম কারণ। পশ্চিমবঙ্গেও প্রতিবেশী রাষ্ট্রের উত্তেজনার আঁচ পড়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার চায় না পড়শি দেশের কোনও ঘটনার আঁচ ভারতের কোনও অঙ্গরাজ্যে পড়ুক। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ঘটনা আরও বেশি স্পর্শকাতর এই কারণে, রাজ্যের একাধিক জেলার সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত রয়েছে। ফলে কেন্দ্রীয় সরকারও চাইছে এই পরিস্থিতিতে সমন্বয় রেখে চলতে। আরজি করের মতো ঘটনায় নরেন্দ্র মোদীদের ‘নীরবতা’ বা বাংলাদেশ নিয়ে কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত মতোই চলবেন বলে মমতার ঘোষণা তারই প্রতিফলন। এই সম্পর্কের ছাপই পড়েছে রাজভবন এবং নবান্নের মধ্যেও।
তবে এই ‘সুসম্পর্ক’ কত দিন থাকবে? ২০২৬ সালে রাজ্যে বিধানসভা ভোট। তৃণমূল বা বিজেপি কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলবে না। ফলে নাটকীয় কোনও পরিস্থিতি বদল না হলে মোদী-মমতার রাজনৈতিক দ্বৈরথ সময়ের অপেক্ষা বলেই অনেকে মনে করেন। তেমন হলে, রাজভবনের ভূমিকাও আবার বদলাবে না কি?