ভীষণ রেগে বিষম খেয়ে দিলেন লিখে খাতায়, “কংগ্রেস কোনও এনজিও বা সেবামূলক প্রতিষ্ঠান নয়।” তা হলে কংগ্রেস কী? সেটা জানতে গেলে সত্যিই আগে জানতে হবে যে, কংগ্রেস কী নয়। নেতারা বলেছেন, দল কোনও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান নয়। তা নিয়ে সংশয়ের কোনও কারণই নেই— সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হতে গেলে মাঠে নেমে কাজ করতে হয়; আরামকেদারায় শায়িত অবস্থায় এক্স অথবা ফেসবুকে দু’একটা পোস্ট করা যথেষ্ট নয়। নেতারা এত দিনে সম্ভবত সে কথা বুঝেছেন। তবে, তাঁরা এখনও বোঝেননি যে, কংগ্রেস এখন আর ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দলও নয়। আগে ছিল, তাতে সন্দেহ নেই— এখন আর নয়, তাতে সন্দেহ আরও কম। ভারতের অধিকাংশ রাজ্যে কংগ্রেসের সাইনবোর্ডটুকুও আর অবশিষ্ট নেই। পশ্চিমবঙ্গই যেমন— এ রাজ্যে কংগ্রেসের নেতা কে, কর্মীদের যেমন সে বিষয়ে সংশয় আছে; তেমনই কংগ্রেসের কর্মী ঠিক কারা, নেতারাও সম্ভবত জানেন না। কংগ্রেস নেতারা মনে রাখতে পারেন যে, পাটকাঠি হাতে বাঘ-শিকারে যাওয়া মুশকিল। অতএব, কংগ্রেস ইন্ডিয়া জোটের ‘স্বাভাবিক’ নেতাও নয়। ইতিমধ্যেই জোটের শরিক দলগুলি বহু বার কংগ্রেসের হামবড়াই নিয়ে আপত্তি করেছে। আকবর রোডের শীর্ষনেতৃত্ব যে কথাটি বারে বারেই ভুলে যায়, তা হল, কেন্দ্রে কংগ্রেসের সরকার প্রতিষ্ঠা করা ইন্ডিয়া জোটের অন্য শরিকদের রাজনৈতিক লক্ষ্য হতে পারে না। প্রতিটি দলই সর্বভারতীয় এবং নিজস্ব রাজ্যের রাজনীতিতে নিজেদের সর্বাধিক গুরুত্ব অর্জনের লক্ষ্যে জোটে এসেছে। কী ভাবে সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্য জায়গা ছেড়েও কংগ্রেসের সীমিত রাজনৈতিক শক্তির সবচেয়ে বেশি মূল্য অর্জন করা সম্ভব, সেটাই কংগ্রেসের প্রধান বিবেচ্য হওয়ার কথা ছিল।
অরবিন্দ কেজরীওয়ালের আপ-এর কাছে যেমন দিল্লির গুরুত্ব সর্বাধিক। অন্য দিকে, অন্তত দেড় দশক আগে অবধি দিল্লিতে কংগ্রেসেরও জোর ছিল যথেষ্ট— তার কত আনা এখনও অবশিষ্ট আছে, তা অবশ্য প্রশ্নযোগ্য। সে রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে দু’দলের কেউই অপরকে জায়গা ছাড়তে রাজি নয়। ভুললে চলবে না, কয়েক মাস আগেই হরিয়ানায় কংগ্রেসের জেতার স্পষ্ট সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আপ প্রার্থী দিয়েছিল। এখন প্রশ্ন হল, প্রতিশোধ বা প্রত্যক্ষ সংঘাত ব্যতীত অন্য কোনও পথ কি কংগ্রেসের সামনে রয়েছে? এমন কিছু, যার প্রণোদনায় আপ-এর মতো দল নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থ অতিক্রম করে সত্যিই জোট শরিকের মতো আচরণ করতে পারে? কংগ্রেসের যদি সত্যিই নিজের জোরে লোকসভায় অন্তত দেড়শো আসন জেতার ক্ষমতা থাকত, তা হলে এই প্রশ্নের উত্তরটি স্বতঃসিদ্ধ হত। কিন্তু, সে জোর যে-হেতু নেই, কংগ্রেসকে ভিন্নতর উত্তর খুঁজতে হবে।
তার পাশাপাশি, কংগ্রেস যা একেবারেই নয়, তা হয়ে ওঠার চেষ্টা করতে হবে— অর্থাৎ, প্রকৃত অর্থে একটি রাজনৈতিক দল। রাহুল গান্ধী যখন ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’য় বেরিয়েছিলেন, তখন তাঁর পক্ষে জনসমর্থনের যে ঢল নেমেছিল, তাকে রাজনৈতিক পুঁজিতে পরিণত করতে কংগ্রেস সম্পূর্ণ ব্যর্থ। তার বহু কারণ— প্রধান কারণটি সম্ভবত এই যে, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ববিদীর্ণ এই দলে রাজনৈতিক পুঁজি তৈরি হলে সেই লাভটি শেষ অবধি কার ঘরে উঠবে, সেই প্রশ্নের কোনও স্পষ্ট জবাব নেই। ফলে, কোনও নেতাই নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থ ভুলে দলের কথা ভাবেন না। মল্লিকার্জুন খড়্গে দলের সভাপতি হয়েছেন বেশ কিছু দিন হল, কিন্তু পরিবারের বাইরে কংগ্রেস তাকাতে পেরেছে কি? রাজ্যে রাজ্যে সংগঠন মজবুত করার কাজও শুরু হয়েছে? সামান্যতম প্রলোভনেই দলত্যাগের প্রবণতা বন্ধ করার কোনও পথ মিলেছে কি? উত্তরগুলি কংগ্রেস কর্তারাও জানেন, বিরোধী দলগুলিও জানে। ফলে, আপ-ই হোক বা এনসিপি, ইন্ডিয়া জোটের কোনও শরিকই কংগ্রেসকে ছেড়ে কথা বলে না। কারণ, কংগ্রেস আর যা-ই হোক, গুরুত্বপূর্ণ নয়।