অতীত ও ভবিষ্যৎ যে কোনও সরকারের প্রিয়, বর্তমান বড় একটা নয়। তাতে সুবিধা অনেক: অতীতে যে সরকার ছিল তার সঙ্গে তুলনা টেনে এই আমলের গৌরবপ্রতিষ্ঠা করা যায়, অতঃপর ভবিষ্যতের দিকে নজর ঘুরিয়ে দিলেই নিশ্চিন্তি— এই সময়ে দেশে ঠিক কী ঘটছে তার উপর আলো পড়ে কম। দিল্লিতে নার্কোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরো (এনসিবি)-র সভায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সাম্প্রতিক ভাষণও সাক্ষ্য দেবে, ভারতে মাদক পাচার ও মাদক-সন্ত্রাসের অতীত ও ভবিষ্যৎ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার যত ‘হোমওয়ার্ক’ করেছে, ঘটমান বর্তমান নিয়ে তত নয়। ২০১৪-র আগের দশ বছরে দেশে যে পরিমাণ মাদক উদ্ধার হয়েছিল, পরের দশ বছরে সেই পরিমাণ বেড়েছে সাত গুণ, ধ্বংস হওয়া মাদকের অর্থমূল্যের পরিমাণও বেড়েছে তদ্রূপ, এ-হেন হিসাবে সেই ভাষণ পরিকীর্ণ। বাকিটা ভবিষ্যৎ-কথা: এনসিবি, রাজ্য সরকারগুলি ও তাদের পুলিশের ইতিকর্তব্য কী হবে, মাদক চক্রের প্রসারে ডার্ক ওয়েব, ক্রিপ্টো-কারেন্সি ও ড্রোনের চ্যালেঞ্জ কী করে মোকাবিলা করতে হবে। এর অনেকটাই যে অনাগত কালের গর্ভে তা স্পষ্ট, মাদক চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা ‘নেওয়া হবে’, কেন্দ্র-রাজ্যের সমন্বয়ে ও বিশেষজ্ঞ-সহায়তায় সমাধান ‘খুঁজতে হবে’ ইত্যাদি।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষণ শুনলে, তদুপরি সরকারি প্রেস রিলিজ়টি পড়লে এই প্রত্যয় জাগতে পারে, দেশে এখন মাদকের অভিশাপ তত নেই। এক ২০২৪-এই প্রায় ১৬,৯১৪ কোটি টাকা মূল্যের মাদক বাজেয়াপ্ত হয়েছে মানে তো কেন্দ্রীয় সরকার চমৎকার কাজ করছে! শুধু এই তথ্যটিই যুগপৎ আশা ও আশঙ্কা জাগায়। এই বিপুল পরিমাণ ও অর্থমূল্যের মাদক বাজেয়াপ্ত করা নিশ্চয়ই কাজের কাজ, কিন্তু এও ভাববার, তা হলে কী পরিমাণ মাদক এখনও, এই সময়েও ভারতের ‘বাজার’-এ ছড়িয়ে আছে! স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ২০১৪-পূর্ব দশ বছরে কত কম মাদক ধরা পড়েছিল তার হিসাব দিয়ে এই আমলের গুণ গাইলেন, কিন্তু তাঁর সরকারের দশ বছরে বাজারে মাদক বেড়েছে কত গুণ, সেই হিসাব বা তার অনুমানও কি তাঁর কাছে আছে? এটা অস্বীকারের কোনও উপায় নেই যে এই সময়ের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সুবিধা নিচ্ছে ভারতের মাদকচক্রগুলিও, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ডার্ক ওয়েব ক্রিপ্টো-কারেন্সি ইত্যাদির উল্লেখেও তা স্পষ্ট। এ-হেন প্রকৌশলের হাত ধরে মাদকের কারবার ও আর্থিক লেনদেন যে স্তরে পৌঁছতে পারে তা পুলিশি ধরাছোঁয়ার বাইরে। কেন্দ্র তা নিয়ে কী ভাবছে?
মুখে না বললেও আসল সত্যটি হল, ভারতে মাদক এখনও এক মহামারি। এনসিবি তথা কেন্দ্রের সাম্প্রতিক নানা তথ্য ও বিবৃতি তার সাক্ষ্য দেবে। দিল্লি পঞ্জাব হরিয়ানা জম্মু ও কাশ্মীর উত্তরপ্রদেশ হিমাচল প্রদেশ উত্তরাখণ্ড প্রভৃতি রাজ্য ও অঞ্চলের মাদকচক্র নিয়ে তবু কথা হয়, উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলি সেই আলোচনায় আসে কই! আরও কম কথা হয় অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রসঙ্গে, মাদকের কারবার ও চক্রের সঙ্গে যা প্রবল ভাবে যুক্ত— জাতীয় নিরাপত্তা। বস্তুত এনসিবি-র সাম্প্রতিক সভার শিরোনামেও বিষয়টি ছিল, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও তাঁর ভাষণে এ নিয়ে কিছু কথা বলেছেন। উচিত ছিল এই বিষয়টির সবিশেষ গুরুত্ব দেশের সামনে তুলে ধরা, এবং মাদক যে এই মুহূর্তে একটা বড় সঙ্কট তার অকপট স্বীকার। সমস্যাকে সমস্যা বলে স্বীকার করাটা প্রথম কাজ, সমাধান পরের কথা।