যাদবপুরকাণ্ডে ধৃতের বাবা-মা এবং গ্রেফতার সত্যব্রত রায় (বাঁ দিক থেকে)। —নিজস্ব চিত্র।
ভারত-আয়ারল্যান্ডের টি-টোয়েন্টি ম্যাচ চলছিল টিভিতে। তার ফাঁকে বার বার নিউজ় চ্যানেলগুলোতে নজর রাখছিলেন সত্যব্রতের বাবা-মা এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্য। তাঁদের বাড়ির ছেলে সত্যব্রতও যে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। তিনিও তো ওই মেন হস্টেলের আবাসিক। ছাত্রমৃত্যুর ঘটনায় গত এক সপ্তাহ ধরে যে ক্যাম্পাস উত্তাল। শুক্রবার রাত তখন ১০টা ১৩ মিনিট। যেন আকাশ ভেঙে পড়ল ভাঙা অ্যাসবেস্টারের ছাউনি দেওয়া এক কামরার ঘুপচি ঘরের দুই সদস্যের মাথায়। ছেলে গ্রেফতরা! খবর দেখেই জ্ঞান হারালেন সত্যব্রত রায়ের মা রুমা রায়। বাবা তখন দিশাহারা। কী করবেন কিছুই ভেবে উঠতে পারছেন না তিনি। যাদবপুরকাণ্ডে ধৃত কম্পিউটার সায়েন্সের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র সত্যব্রতের বাবা শনিবার বলেন, ‘‘তিন দিন আগেই ছেলে ফোনে বলেছিল, এখন বাড়ি আসতে পারবে না।’’
যাদবপুরকাণ্ডে শুক্রবার মোট তিন জন গ্রেফতার হন। তাঁদের মধ্যে এক জন সত্যব্রত। তাঁর বাড়ি নদিয়ার হরিণঘাটা পুরসভার দশ নম্বর ওয়ার্ডের সন্তোষপুর এলাকায়। সত্যব্রতের বাবা প্রদীপ রায় বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সামনে ঠেলাগাড়িতে পেয়ারা বিক্রি করেন। ছেলের পড়াশোনার খরচ চালাতে সেলাইয়ের কাজ করেন সত্যব্রতের মা রুমা। হতদরিদ্র পরিবার। তবে ছেলেকে বেসরকারি কনভেন্ট স্কুলে পড়িয়েছেন রায় দম্পতি। ছেলেও বরাবর স্কুলের প্রথম তিন জনের মধ্যে এক জন থেকেছেন। উচ্চ মাধ্যমিকে নজরকাড়া ফল করেছিলেন সত্যব্রত। যাদবপুরে পড়তে গিয়ে ছেলে হস্টেলে জায়গা পেতে স্বস্তি পেয়েছিলেন প্রদীপ। ভেবেছিলেন, যাক! অনেকটা খরচ কমবে। কিন্তু সেই হস্টেলেই যে এমন একটা ঘটনা ঘটবে, কল্পনা করতে পারেননি সত্যব্রতের বাবা-মা। শনিবার সকালে বাড়ির বারান্দায় বসে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সত্যব্রতের বাবা। সত্যব্রতের মা কাঁদতে কাঁদতে বলছেন, ‘‘ছেলের পড়ার খরচ জোগাতেই হিমশিম খাচ্ছিলাম। এখন কোর্টের খরচ পাব কোথা থেকে?’’
শুক্রবার রাতে টিভি চ্যানেলে ‘ব্রেকিং নিউজ়’ দেখে পড়শিরা ভিড় করতে শুরু করেন সত্যব্রতের বাড়িতে। প্রতিবেশীদের বক্তব্য, ‘‘বরাবর মুখচোরা, আপাত শান্ত ছেলেটি কী ভাবে এমন ঘটনায় যুক্ত থাকতে পারে!’’ গত ৯ অগস্ট যাদবপুরে প্রথম বর্ষের ছাত্রের মৃত্যুর পরেও বেশ কয়েক বার বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা হয়েছে সত্যব্রতের। ছেলেকে আবার বাড়িতে আসতে বলেছিলেন বাবা। কিন্তু রাজি হননি সত্যব্রত। বলেছিলেন, ‘‘বাড়ি গেলে সমস্যা হতে পারে। এখন ফেরা যাবে না। সবাই সন্দেহ করবে।’’ সত্যব্রতের মায়ের কথায়, ‘‘যাদবপুরের ছাত্রমৃত্যুর ঘটনা নিয়ে বার বার ছেলের কাছে জানতে চাই। ও বলে, ‘বিচারাধীন বিষয় নিয়ে বেশি প্রশ্ন কোরো না।’” ছেলের সঙ্গে শুক্রবার রাত্রি ৯টায় শেষ বার কথা হয়েছে মায়ের। সত্যব্রত মাকে বলেন, ‘‘জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ ডেকে পাঠিয়েছে। আমি নির্দোষ। তুমি চিন্তা কোরো না। যা জানি, সব বলে দেব।’’
কল্যাণীর একটি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বেশ কিছু দিন পড়াশোনা করেছিলেন সত্যব্রত। কিন্তু সেখানকার খরচ চালাতে না পেরে মুর্শিদাবাদের একটি কলেজে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা করেন। করোনা পরিস্থিতিতে লকডাউনের সময় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়ার লক্ষ্যে প্রস্তুতি শুরু করেন। বাড়ির কাছে বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েও যাদবপুরের পড়ার হাতছানি এড়াতে পারেননি তিনি। পড়াশোনা চলছিল ঠিকঠাক। এটাই ছিল শেষ বছর। ছেলে নিজের পায়ে দাঁড়ালেই এত দিনের কষ্ট সফল হবে। এই ভাবনাতেই দিন গুনছিলেন সত্যব্রতের বাবা-মা। কাঁদতে কাঁদতে সত্যব্রতের মা বলেন, ‘‘মেসে থেকে পড়তে চেয়েছিল। আমরা দেখলাম হস্টেলে খরচ কম, তাই ওকে হস্টেলে দিলাম। সেই হস্টেলে থাকা যে কাল হবে, বুঝতে পারিনি।’’
তুতো ভাই সৌরনীলের জন্মদিন উপলক্ষে শেষ বার সত্যব্রত বাড়ি এসেছিলেন ৩০ জুলাই। ৩১ জুলাই কলকাতা ফিরে যান সত্যব্রত। উল্লেখ্য, এই সত্যব্রতই ছাত্রমৃত্যুর ঘটনার রাতে ডিন অফ স্টুডেন্টস রজত রায়কে ফোন করে জানিয়েছিলেন যে, হস্টেলে ‘পলিটিসাইজ়ড’ হচ্ছে। ব্যাখ্যা দিয়ে জানিয়েছিলেন, হস্টেল থেকে এক ছাত্রকে ঝাঁপ দিতে বলা হচ্ছে। তার পরে খবর পেয়েছিলেন হস্টেল সুপার। ওই সুপার অভিযোগ করেছেন, সত্যব্রতদের ‘ভয়ে’ নাকি তিনি হস্টেলে যাননি। কারণ, তাঁরা খুব খারাপ ব্যবহার করতেন।