লোকসভা ভোটের প্রচারে অধীর চৌধুরী এবং মহম্মদ সেলিম। ছবি: পিটিআই।
সিপিএমের সঙ্গেই হয়তো জোট করে বাংলার রাজনীতিতে এগোবে এআইসিসি। সোমবার এআইসিসির সঙ্গে বৈঠকের পর এমনটাই মনে করছেন পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস নেতারা। মঙ্গলবার দিল্লির এআইসিসির দফতরে আয়োজিত বৈঠকে ছিলেন রাহুল গান্ধী ঘনিষ্ঠ নেতা কেসি বেণুগোপাল, এআইসিসির দায়িত্বপ্রাপ্ত পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেসের পর্যবেক্ষক গোলাম মির ও বিপি সিংহ। সেই আলোচনায় লোকসভা ভোটের ফলাফল নিয়ে প্রথমে একত্রে, এবং পরে পৃথক ভাবে নেতাদের সঙ্গে কথা বলেন বেণুগোপাল-সহ কংগ্রেস হাইকমান্ডের নেতারা।
সেই বৈঠকেই এআইসিসির নেতাদের কাছে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূলের বিরুদ্ধে অনেক নেতা অভিযোগ করেছেন। তবে লোকসভা নির্বাচনে সিপিএমের সঙ্গে জোট করে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে কোনও অভিযোগ করেননি নেতারা। এআইসিসির নেতারাও পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমের সঙ্গে পথ না চলার বার্তা দেননি। শীর্ষ নেতৃত্বের এ হেন মৌনতাকেই তাঁদের সম্মতি হিসাবে ধরছেন বাংলার কংগ্রেস নেতারা। উল্লেখ্য, লোকসভা ভোটের পর সিপিএমের যে পর্যালোচনা রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে তাতে রয়েছে বাংলায় জাতীয় কংগ্রেস সুষ্ঠু ভাবে বোঝাপড়া করেই চলেছে। নির্বাচনে কংগ্রেসের ভুমিকার প্রশংসাও করা হয়েছে সিপিএমের নথিতে।
কেরলের রাজনীতিতে কংগ্রেস-সিপিএম পরস্পর বিরোধী হলেও, জাতীয় রাজনীতিতে বিজেপিকে রুখতে একজোট এআইসিসি এবং সিপিএম। এমনকি কংগ্রেসের লোকসভার দলনেতা রাহুল কেরলের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নকে আক্রমণ করলেও, সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি দিল্লি সেই আক্রমণের জবাব দেন না। বরং এআইসিসির একটি সূত্র জানাচ্ছে, বিজেপিকে জবাব দিতে রাহুল বহু ক্ষেত্রেই সীতারামের পরামর্শ নেন। তা ছাড়া বাংলা ও ত্রিপুরায় কংগ্রেসের সঙ্গে পথ চলতে সিপিএমের কোনও সমস্যা নেই বলেই মনে করে এআইসিসি। তাই বাংলা কংগ্রেস নেতাদের ধারণা, আগামী বিধানসভা নির্বাচনে সিপিএমের সঙ্গে জোট করেই লড়াই হতে পারে।
২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে প্রথম বারের জন্য সিপিএম-কংগ্রেস জোট হয়। কিন্তু সেই ভোটে ৪৪ আসন পেয়ে বিধানসভার প্রধান বিরোধী দল হয় কংগ্রেস। বিরোধী আসন থেকে রাজ্যের তৃতীয় শক্তিতে পরিণত হয় সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট। কিন্তু সেই ভোটের পর জোট ভেঙে যায়। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে জোটের চেষ্টা হলেও, রায়গঞ্জ ও মুর্শিদাবাদ আসন নিয়ে দু’পক্ষের দড়ি টানাটানিতে শেষ মুহূর্তে জোট ভেঙে যায়। সেই ভোটে প্রতীকী জোট করে পরস্পরের বিরুদ্ধে দু’টি করে আসনে প্রার্থী দেয়নি দু’দল। বহরমপুরের প্রার্থী অধীর চৌধুরী ও মালদহ দক্ষিণে আবু হাসেম খান চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রার্থী না দিয়ে তাদের সমর্থনে প্রচারে নামে সিপিএম। আবার বাঁকুড়া ও যাদবপুর আসনে সিপিএমের বিরুদ্ধে প্রার্থী দেয়নি কংগ্রেস। কিন্তু তাতেও জোটের তাল কেটে গিয়েছিল। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের জোটে নতুন গঠিত দল ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টকে (আইএসএফ) নিয়ে তৈরি হয় সংযুক্ত মোর্চা। মেরুকরণের সেই ভোটে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস শূন্যে নেমে যায়। সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী হিসাবে একমাত্র জয় পান ভাঙড়ের আইএসএফ প্রার্থী নওশাদ সিদ্দিকি। যদিও, তাঁর দলের সঙ্গে ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে জোট হয়নি সিপিএম-কংগ্রেসের।
তবে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের মধ্যে জোট হয়েছিল। সেই জোটের একমাত্র প্রতিনিধি হিসাবে মালদহ দক্ষিণ কেন্দ্রে জয়ী হয়েছেন কংগ্রেস প্রার্থী ঈশা খান চৌধুরী। সে অর্থে বাংলার রাজনীতিতে খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে দু’দল তাই পরস্পরের হাত ছাড়তে নারাজ বলেই মনে করা হচ্ছে। এআইসিসি নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠকে উপস্থিত এক নেতার কথায়, ‘‘বাংলার ভোটে সিপিএমের সঙ্গে আমাদের জোটের ফল যাই হোক, আমরা দু’দলই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছি তৃণমূল ও বিজেপি দু’পক্ষের বিরুদ্ধে। মালদহ দক্ষিণ আসন জিততে আমরা সিপিএমের সাহায্য পেয়েছি। তাই আগামী দিনে যদি সিপিএমের সঙ্গে জোট করে এআইসিসি এগোতে চায়, তা হলে তা আমরা মাথা পেতে মেনে নেব। কারণ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে তারাই। তবে সিপিএমের সঙ্গে পথ চলতে আমাদের কর্মীরা বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।’’
তবে ভিন্ন মত পোষণ করেছেন যুব কংগ্রেসের রাজ্য সভাপতি আজহার মল্লিক। তিনি বলেছেন, ‘‘আগে আমরা নিজেদের পায়ের জমি শক্ত করি। ২০১১ সাল থেকে তো কোনও না কোনও দলের সঙ্গে আমরা জোট করেই এগিয়েছি। তাতে আমাদের শক্তিক্ষয় হয়েছে। যদি আমরা নিজেদের শক্তিতে ২৯৪ আসনে প্রার্থী দেওয়ার মতো শক্তি তৈরি করতে পারি, তা হলে যে কোনও পরিস্থিতিতেই আমরা ভাল ফল পাব। তবে এআইসিসি যে সিদ্ধান্তই নিক, যুব কংগ্রেস সেই সিদ্ধান্তের সঙ্গে রয়েছে।’’ আর এআইসিসি মুখপাত্র মিতা চক্রবর্তী বলেন, ‘‘জোটের কথা ভোটের সময় হবে। সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় ও রাজ্য নেতৃত্ব নেবেন। তাঁরা যে সিদ্ধান্তই নেবেন আমাদের মেনে নিতে হবে। তবে ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটের আগে আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত কংগ্রেসের সংগঠনকে জোরদার করা।’’