হুমায়ুন কবীর। —ফাইল চিত্র
অনুপ্রবেশের কারণে মালদহ ও মুর্শিদাবাদে জনবিন্যাস বদলাচ্ছে না। এমনটাই মনে করেন তৃণমূল বিধায়ক হুমায়ুন কবীর। তাঁর মতে, জনবিন্যাস যদি বদলে গিয়ে থাকে, মুসলিম পরিবারে বেশি জন্মহারই তার কারণ। মুর্শিদাবাদের ভরতপুরের বিধায়কের মন্তব্য, ‘‘মুসলিম পরিবারে দেখা যায়, কারও চারটে, কারও পাঁচটা, কারও আবার ছ’টা করে সন্তান রয়েছে! ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, বাড়িতেই সন্তান প্রসব করছেন প্রসূতিরা।’’ যা নিয়ে নতুন করে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, বিজেপি নেতারা ‘জনবিন্যাস বদলে’ যাচ্ছে বলে এত দিন ধরে যে দাবি করে আসছিলেন, সে বিষয়ে নিজের মতামত দিতে গিয়ে হুমায়ুন কি তাতেই কার্যত মান্যতা দিলেন?
তৃণমূল অবশ্য হুমায়ুনের মতকে গুরুত্ব দিতে নারাজ। দলের মুখপাত্র তথা প্রাক্তন রাজ্যসভা সাংসদ শান্তনু সেন বলেন, ‘‘কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্থা ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেল্থ সার্ভের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের হার ৭৫ থেকে বেড়ে ৯৫ শতাংশের বেশি হয়েছে। ফলে হুমায়ুন কবীর যে কথা বলেছেন, তার সঙ্গে বাস্তব তথ্যের কোনও মিল নেই।’’ অন্য দিকে, তৃণমূল বিধায়ক হুমায়ুনের মন্তব্য নিয়ে ইতিমধ্যেই কটাক্ষ করতে শুরু করেছে বিজেপি।
অনুপ্রবেশের কারণে জনবিন্যাস বদলে যাচ্ছে বলে অভিযোগ তুলে বিহারের তিন জেলার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মালদহ ও মুর্শিদাবাদকে জুড়ে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গড়ার দাবি সংসদে জানিয়েছিলেন গোড্ডার বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে। তাঁর দাবিকে প্রকাশ্যেই সমর্থন করেছেন মুর্শিদাবাদ জেলার দুই বিজেপি বিধায়ক— মুর্শিদাবাদের গৌরীশঙ্কর ঘোষ এবং বহরমপুরের সুব্রত মৈত্র। তার প্রেক্ষিতে পাল্টা বিজেপির বিরুদ্ধে ‘বিভাজনের রাজনীতি’র অভিযোগ তুলে সরব হয়েছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ‘‘বাংলা ভাগ করতে এলে দেখিয়ে দেব কী করে রুখে দিতে হয়!’’
সেই বিতর্কে মুখ খুলতে গিয়ে অন্য বিতর্ক উস্কে দিলেন হুয়ায়ুন! বিজেপির ‘অনুপ্রবেশ তত্ত্ব’ খারিজ করতে গিয়ে মুসলিম পরিবারে জন্মহার নিয়ে বিতর্ক টেনে এনেছেন তিনি। বুধবার বিধানসভার বাইরে দাঁড়িয়ে হুমায়ুন বলেন, ‘‘কোটিতে এক-দু’জন অনুপ্রবেশ করে থাকতে পারেন। কিন্তু আমরা যাঁরা মালদহ-মুর্শিদাবাদে সক্রিয় রাজনীতি করি, তাঁরা এ রকম কোনও মানুষকে পাইনি। জনবিন্যাস বদলে যাচ্ছে অন্য কারণে। বিবাহিত মুসলিম মহিলাদের মাত্র ১০ শতাংশ চিকিৎসকের কাছে যান। চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে হাসপাতালে গিয়ে তাঁরা সন্তান প্রসব করেন। সিজ়ার করানো হয়। বাকি ৯০ শতাংশ মুসলিম মহিলা এখনও বাড়িতেই সন্তান প্রসব করেন। তাঁদের কারও চারটে, কারও পাঁচটা, কারও আবার ছ’টা করে সন্তান হয়!’’
মুসলিম পরিবারে জন্মহার বেশি হওয়ায় দেশে হিন্দুরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়ছে বলে বহু বার দাবি করতে দেখা গিয়েছে বিজেপি নেতাদের। তা নিয়ে অতীতে জাতীয় রাজনীতিতে বিতর্ক হয়েছে। হুমায়ুনের মন্তব্যে সেই বিতর্কের আঁচ কি এ বার বাংলাতেও এসে পড়বে, সেই প্রশ্ন উঠছে। মুসলিম পরিবারে জন্মহার নিয়ে বলতে গিয়ে নিজের পরিবারের কথাও টেনে এনেছেন হুমায়ুন। তিনি বলেন, ‘‘আমার বাড়িতেই দেখুন। আমার বাবার আট সন্তান। পর পর পাঁচ ভাইয়ের জন্ম হয়েছিল। ভাইদের মধ্যে আমিই সবচেয়ে ছোট। আজ আমার দুই সন্তান। এক ছেলে, এক মেয়ে। আমার মেয়েরও দুটো সন্তান। আমার ছেলেরও হয়তো দুটো হবে।’’
তৃণমূল বিধায়কের মন্তব্যের প্রেক্ষিতে বিজেপি নেতা সজল ঘোষ বলেন, ‘‘ভোটব্যাঙ্কের জন্য অনুপ্রবেশকারীদের নিজেদের সন্তান বানিয়ে নিতে পারেন একমাত্র তৃণমূল নেতারাই। কারও চার বা পাঁচটা সন্তান হলে তো আমার কিছু বলার নেই, তিনিই মানুষ করবেন। কিন্তু অনুপ্রবেশ যে হচ্ছে না, এটা প্রমাণ করার জন্য এই দাবি কখনওই গ্রহণযোগ্য নয়। এই অনুপ্রবেশের ফলে আদতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন মুর্শিদাবাদের মূল বাসিন্দারা। কাজের সন্ধানে তাঁদের বাইরে যেতে হচ্ছে।’’
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে চিঠি দিয়ে উত্তরবঙ্গের কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলিকে উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রকল্পগুলির অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার। তা থেকেই নতুন করে বঙ্গভঙ্গ সংক্রান্ত বিতর্কের সূত্রপাত হয়। এর পরেই পশ্চিমবঙ্গের বিভাজন চেয়ে সংসদে সরব হন ঝাড়খণ্ডের গোড্ডার সাংসদ নিশিকান্ত। নিশিকান্ত লোকসভার শূন্য প্রহরে বক্তব্য রাখতে গিয়ে মূলত জনবিন্যাসের ভারসাম্য এবং দেশের নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে বিহারের কিষাণগঞ্জ, আরারিয়া ও কাটিহারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মালদহ ও মুর্শিদাবাদের মতো সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গড়ে তোলার সওয়াল করেন। তাঁর অভিযোগ, ধারাবাহিক অনুপ্রবেশের ফলে বিহার ও পশ্চিমবঙ্গের ওই পাঁচ জেলার জনবিন্যাস পাল্টে গিয়েছে। ওই জেলাগুলিতে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) চালু করার দাবিও তোলেন তিনি।
এই পরিস্থিতিতে বিজেপির বিরুদ্ধে পাল্টা সুর চড়িয়েছে তৃণমূল। সংসদে দুবের মন্তব্যের জবাব দিল্লিতেই দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। ‘বঙ্গভঙ্গ’ রোধের ডাক দিয়ে অভিযোগ করেছিলেন, ভোট না পাওয়ায় বাংলায় ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতি নিয়েছে বিজেপি। বিধানসভাতেও মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘ভোট চলে গেলেই ভাগাভাগি ইস্যুকে নিয়ে আসা হয়। এক জন বলছেন, মুর্শিদাবাদ-মালদহ ভেঙে দাও। কেউ বলছেন, অসমের তিনটি জেলাকে নিয়ে নতুন কিছু করো। কেউ আবার উত্তরবঙ্গকে উত্তর-পূর্বের সঙ্গে যুক্ত করে দিতে বলছেন। চার মন্ত্রী বলেছেন উত্তরবঙ্গ ভাগের কথা। আমি ধিক্কার জানাই। আসুক বাংলা ভাগ করতে, কী করে রুখতে হয় দেখিয়ে দেব।’’ মমতার সংযোজন ‘‘বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আলোচনা হোক বিধানসভায়। ভোটাভুটি হোক। বিধানসভাকে এড়িয়ে বাংলা ভাগ করার কথা বলা যাবে না।’’
বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী অবশ্য আগেই জানিয়েছিলেন, উত্তরবঙ্গের বিজেপি নেতৃত্বের একাংশ রাজ্য ভাগের যে ডাক দিয়েছেন, তা দলের অবস্থান নয়। একই কথা বলেছেন দলের রাজ্য সভাপতি সুকান্তও।