Altitude sickness

সান্দাকফু গিয়ে ফেরা হল না দমদমের তরুণীর, এক বছরে তিন পর্যটকের মৃত্যু, নেপথ্যে কোন কারণ?

সান্দাকফু গিয়ে ২৮ বছরের তরুণীর মৃত্যু নাড়িয়ে দিয়েছে অনেককেই। কেন সেখানে গিয়ে পরপর মৃত্যু হচ্ছে? কী বলছেন পর্বতারোহী থেকে চিকিৎসক?

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৯:৩৬
সান্দাকফুতে গিয়ে পরপর পর্যটকের মৃত্যু কেন?

সান্দাকফুতে গিয়ে পরপর পর্যটকের মৃত্যু কেন? ছবি: সংগৃহীত।

কথা ছিল, সান্দাকফু ঘুরে বৃহস্পতিবারই বাড়ি ফিরবেন। শেষ পর্যন্ত ঘরে ফিরল ২৮ বছরের অঙ্কিতা ঘোষের নিথর দেহ। বেড়াতে গিয়ে দক্ষিণ দমদমের তরুণীর মৃত্যু নাড়িয়ে দিয়েছে অনেককেই।

Advertisement

শুধু অঙ্কিতা নন, সান্দাকফু গিয়ে গত নভেম্বরেই মৃত্যু হয়েছিল ভবানীপুরের বাসিন্দা বছর ৫৮-এর আশিস ভট্টাচার্যের। গত মে মাসে সেখানে গিয়ে মারা গিয়েছিলেন উত্তর দিনাজপুরের এক বাসিন্দাও।

ভারত-নেপাল সীমান্তে অবস্থিত সান্দাকফু বেড়াতে যান অসংখ্য পর্যটক। কেউ ট্রেক করে সেখানে পৌঁছন। কেউ বেছে নেন গাড়ি। ছোট থেকে বড়, বিভিন্ন বয়সিরা থাকেন সেই দলে। সান্দাকফু যাওয়ার জন্য বিশেষ পরিকল্পনা বা শারীরিক পরীক্ষার কথা কেউ ভাবেননি এতদিন। তবে কি এ বার ভাবার সময় এসেছে? ১১ হাজার ৯৩০ ফুট উচ্চতায় সান্দাকফু ভ্রমণে গিয়ে পরপর মৃত্যুতে পর্যটক মহলে অনেকেরই প্রশ্ন, তা হলে কি সান্দাকফু যাওয়ার আগে অনেক বেশি ভাবনাচিন্তা দরকার?

৫৮ বছরের আশিস ভট্টাচার্যের মৃত্যুর ক্ষেত্রে কেউ কেউ বয়স এবং অসুস্থতার দিকে আঙুল তুললেও, ২৮ বছরের তরুণীর মৃত্যুতে কাকে ‘খলনায়ক’ করা যায়, ভেবে পাচ্ছেন না কেউ। জানা গিয়েছে, তিন সহকর্মীর সঙ্গে সান্দাকফু ঘুরে টুমলিঙে নেমে এসেছিলেন অঙ্কিতা। সেখানেই একটি হোম স্টেতে ছিলেন। সূত্রের খবর, মঙ্গলবার রাতে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। হাসপাতালে নিয়ে গেলেও বাঁচানো যায়নি তাঁকে।

ঠিক কী ভাবে অঙ্কিতার মৃত্যু হয়েছিল, তা তদন্তসাপেক্ষ। ময়নাতদন্তে মৃত্যুর কারণ জানা যাবে। তবে অল্পবয়সি মেয়েটির মৃত্যু নাড়িয়ে দিয়েছে গোটা পর্যটক মহলকেই। মৃতার পরিবারের দাবি, মেয়ের তেমন কোনও অসুস্থতা চোখে পড়েনি। তা হলে, কেন এমনটা হল বা হতে পারে? বিপদ কোথায়, কী বলছেন চিকিৎসক থেকে পর্বতারোহী, ট্রেকাররা?

এভারেস্টজয়ী মলয় মুখোপাধ্যায় বহু ছেলেমেয়েকে নিয়ে পর্বতারোহন অভিযানে যান। তাঁর কথায়, এই বিষয়টি নেহাত দুর্ঘটনা হতে পারে। হতে পারে, মেয়েটির কোনও অসুস্থতা ছিল। তবে একই সঙ্গে তিনি বলছেন, সমাজমাধ্যমে ভ্লগ, ভিডিয়ো বা রিল্‌স দেখে কোনও প্রস্তুতি ছাড়া হুজুগে পড়ে উঁচু এলাকায় ট্রেকিং বিপদ ডেকে আনছে। লাদাখের চাদর ট্রেকিংয়ের সময় এমন অভিজ্ঞতাও হয়েছে তাঁর। অন্য একটি দলের কমবয়সি দু’টি ছেলেকে অসুস্থ হয়ে পড়তে দেখেছেন এক দিনেই।

মলয়ের কথায়, উঁচু স্থানে ভ্রমণে বা ট্রেকিংয়ে প্রস্তুতির অভাব, অজ্ঞতা বিপদ ডেকে আনতে পারে। উচ্চতার সঙ্গে শরীরকে খাপ খাওয়াতে হয়। ৬০০০ ফুট থেকে আচমকা ১০ বা ১১ হাজার ফুট উচ্চতায় একেবারে উঠলে পরিবেশের সঙ্গে শরীর খাপ খাইয়ে নিতে পারে না। হেঁটে উঠলে তবু সমস্যা কিছুটা কম হয়, কারণ তাঁকে ধাপে ধাপে উঠতে হয়। কিন্তু গাড়িতে এক ধাক্কায় কয়েক হাজার ফুট উঠলে সমস্যা হতে পারে।

হিমালয়ান নেচার অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশনের কো-অর্ডিনেটর অনিমেষ বসু বলছেন, ‘‘সান্দাকফুতে যে হেতু এখন গাড়ি চলে যাচ্ছে অনেকেই সমতল থেকে এক দিনে সান্দাকফু বা তার কাছাকাছি স্থানে পৌঁছনোর পরিকল্পনা করছেন। যা অত্যন্ত বিপজ্জনক প্রবণতা।’’

ট্রেকিং বা পাহাড়ে বেড়ানোর ক্ষেত্রে কোন কোন সতর্কতা জরুরি?

১. জায়গাটির উচ্চতা, ঠান্ডা, পরিবেশ সম্পর্কে জানা জরুরি।

২. পরিবেশ অনুযায়ী পোশাক, ওষুধ থাকা দরকার।

৩. ট্রেকিংয়ের জন্য শরীরিক সক্ষমতা থাকা দরকার। গুরুত্বপূর্ণ হল, শারীরিক এবং মানসিক প্রস্তুতি। প্রতি দিন হাঁটাহাটি, ব্যায়াম করলে পাহাড়ে ট্রেকিংয়ে খুব বেশি অসুবিধা হবে না।

৪. পাহাড়ে ওঠার সময়ে জল খাওয়া জরুরি। শুধু ট্রেকিং নয়, গাড়িতে বেড়ালেও তা প্রয়োজন। জলের ঘাটতি উচ্চ স্থানে অসুস্থতার কারণ হতে পারে।

৫. সঙ্গে অক্সিজেনের ছোট ক্যান রাখতে পারলে সুবিধা।

৬. ট্রেকিংয়ে গেলে অভিজ্ঞ কেউ থাকা দরকার।

প্রশাসনিক সূত্রে জানা গিয়েছে, অঙ্কিতা এবং তাঁর সহকর্মীরা উচ্চতার সঙ্গে মানিয়ে নিতে সান্দাকফু যাওয়ার সময় একদিন নীচে থেকে গিয়েছিলেন। ফেরার সময়েও ছিলেন। তা হলে কী এমন সমস্যা হল? চিকিৎসক সুবর্ণ গোস্বামী বলছেন, ‘‘তরুণীর কোনও অসুখ ছিল কি না, পরিবারে আচমকা মৃত্যুর কোনও অতীত ইতিহাস আছে কি না, তা গুরুত্বপূর্ণ। উচ্চতার সঙ্গে শরীর ঠিকমতো মানিয়ে নিয়েছিল কি না, অনেক কিছুই দেখার রয়েছে।’’ তাঁর কথায়, বয়স কম হলেও, অনেক সময়ে চিহ্নিত হয়নি এমন কোনও অসুখ বিপদের কারণ হতে পারে। একই সঙ্গে তিনি অতীতে কোভিডের কথাও মনে করাচ্ছেন। চিকিৎসক বলছেন, ‘‘কোভিড পরবর্তী সময়ে আচমকা মৃত্যু নিয়ে আইসিএমআর মাল্টিসেন্ট্রিক স্টাডি রয়েছে। তাতেই দেখা গিয়েছে, আচমকা প্রচুর পরিমাণে মদ্যপান, অভ্যাস ছাড়াই আচমকা দীর্ঘ শারীরিক কসরত, কোভিডে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের ক্ষতি বিপদ ডেকে আনছে। এর সঙ্গে জুড়ছে, পরিবারে আচমকা মৃত্যুর ইতিহাস।’’ তরুণীর মৃত্যুর নেপথ্যে অনেক কারণই থাকতে পারে।

সান্দাকফু যেতে শারীরিক পরীক্ষা জরুরি?

প্রশাসন সূত্রের খবর, একাধিক পর্যটকের মৃত্যুর পরে মানেভঞ্জনে শারীরিক পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ফিট সার্টিফিকেট নিয়ে তবেই পর্যটকদের যাওয়ার ছাড়পত্র দেওয়া হবে। তা কতটা জরুরি? পর্বতারোহী মলয় মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘বিদেশে বিভিন্ন অভিযানে শারীরিক পরীক্ষা বাধ্যতামূলক। এ ক্ষেত্রে এখন যখন সমস্যা হচ্ছে পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া ভাল।’’

কিন্তু কোন পরীক্ষা? রক্তচাপ মাপলেই কি চলবে? চিকিৎসকের কথায়, হিমগ্লোবিনের মাত্রা, রক্তচাপ দেখে নেওয়া প্রয়োজন। হার্ট, কিডনি, ফুসফুস সংক্রান্ত সমস্যা থাকলে সতর্ক হতে হবে।

বিপদ এড়াতে পরামর্শ

পাহাড়ের নিয়মকানুন জানতে এবং মানতে হবে। উচ্চতাজনিত স্থানে মদ্যপান, ধূমপান এড়িয়ে চলা প্রয়োজন। মাথা ধরা, অস্বস্তি, বুকে চাপ— যে কোনও কষ্ট হলেই দ্রুত সেই ব্যক্তিকে নীচে নামিয়ে আনতে হবে। অনিমেষ বসুর বক্তব্য, পাহাড়ে অসুস্থ হয়ে পড়ার একটি কারণ হল অক্সিজেন সরবাহের ঘাটতি। সে কারণে, বিপদ এড়াতে মানেভঞ্জন, টুংলু, টুংলিং, কালীপোখরি, সান্দাকফুতে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্যবস্থা থাকা উচিত। মানেভঞ্জনে একটি ভাল চিকিৎসা কেন্দ্রের ব্যবস্থা করলেও পর্যটকদের, ট্রেকারদের সুবিধা হবে বলে মনে করেন তিনি।

Advertisement
আরও পড়ুন