ভারতে তৈরি প্রথম পরমাণু শক্তিচালিত ডুবোজাহাজ (নিউক্লিয়ার সাবমেরিন) আইএনএস অরিহন্ত থেকে পরমাণু অস্ত্রবহনে সক্ষম দু’টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা করল নৌসেনা। প্রতিরক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে যা অতি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ১৪ অক্টোবর বঙ্গোপসাগরের গভীরে অরিহন্ত থেকে ছোড়া ‘ডুবোজাহাজ থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র’ (সাবমেরিন লঞ্চড্ ব্যালিস্টিক মিসাইল বা এসএলবিএম) পূর্বনির্ধারিত নিশানায় নিখুঁত ভাবে লক্ষ্যভেদে সফল হয়েছে।
‘ভূমি থেকে ভূমি’ গোত্রের এই দু’টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রকে নৌ-সংস্করণ সমুদ্রের গভীর থেকে উৎক্ষেপণ করে মাটি বা জলে থাকা লক্ষ্যবস্তুকে নিশানা করা যায়। ক্ষেপণাস্ত্র দু’টির নাম হল কে-১৫ এবং কে-৪।
ভারতে তৈরি কে-১৫ সাবমেরিন লঞ্চড্ ব্যালিস্টিক মিসাইলটি সাগরিকা এবং বি-০৫ নামেও পরিচিত। ৭৫০ কিলোমিটার পাল্লার এই ক্ষেপণাস্ত্র ‘পো লোড’ হিসাবে ১,০০০ কিলোগ্রাম বিস্ফোরক বহন করতে পারে।
প্রয়োজনে পরমাণু অস্ত্রও বহন করতে পারে কে-১৫। ‘ডুবোজাহাজ থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য’, কঠিন জ্বালানি চালিত এই ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র সর্বোচ্চ ৭.৫ ম্যাক (প্রায় ৯,১৯০ কিলোমিটার) গতিবেগে আঘাত হানতে পারে শত্রুশিবিরে।
৩.৫০০ কিলোমিটার পাল্লার কে-৪ ভারতে তৈরি কে সিরিজের সেরা ক্ষেপণাস্ত্রগুলির অন্যতম। ভারতীয় প্রতিরক্ষা গবেষণা এবং উন্নয়ন সংস্থা (‘ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন’ বা ডিআরডিও)-র তৈরি এই ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন করে ‘ভারত ডায়নামিক্স লিমিটেড’।
প্রাথমিক ভাবে অরিহন্তে ব্যবহারের জন্য ১৭ মিটার দৈর্ঘ্যের অগ্নি-৩-এর কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু পরে ব্যবহারের সুবিধার কথা ভেবে বেছে নেওয়া হয় ১২ মিটার লম্বা কঠিন জ্বালানি চালিত কে-৪ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রকে।
পরমাণু অস্ত্রবাহী ‘ডুবোজাহাজ থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য’ দু’টি ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষার ফলে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চিনা নৌবাহিনীর মোকাবিলার ক্ষেত্রে ভারতীয় নৌসেনা অনেকটা সুবিধাজনক অবস্থানে গেল বলে মনে করছেন সামরিক পর্যবেক্ষকদের একাংশ।
কে-৪ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষার ফলে চিন এবং পাকিস্তানের অনেকগুলি বড় শহরই ভারতের নিশানায় চলে এল। পরমাণু চালিত অরিহন্তের অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে শত্রুপক্ষের সেনার নজরদারি ফাঁকি দিয়ে তাদের জলসীমায় ঢুকে আঘাত হানতে পারবে নৌসেনা।
আইএনএস অরিহন্ত ভারতীয় নৌসেনায় কমিশনড হয়েছিল ২০১৬ সালের অগস্টে। তার আগে দীর্ঘ ‘সি ট্রায়াল পর্বে’ সমুদ্রের তলা থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে প্রতিপক্ষের উপরে হামলা চালানোর মহড়াও সফল ভাবে সম্পন্ন করেছিল এই ‘নিউক্লিয়ার সাবমেরিন’।
পাশাপাশি আইএনএস অরিহন্তের এই সফল ক্ষেপণাস্ত্র হানাদারির পরীক্ষা ভারতীয় সামরিক বাহিনীর মর্যাদাকে অনেকটা বাড়িয়ে দিল বলে মনে করে প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা। বস্তুত, অরিহন্তের হাত ধরেই ভারতের ‘পরমাণু ত্রিশূল’ সম্পূর্ণ হওয়ার প্রক্রিয়ার শেষ হল।
স্থল, জল এবং অন্তরীক্ষ থেকে পরমাণু হামলা চালানোর ক্ষমতাকেই ‘পরমাণু ত্রিশূল’ বলা হয়। স্থলসেনার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং বায়ুসেনা পরমাণু বোমা ব্যবহারের পরিকাঠামোর পর এ বার ভারতীয় নৌসেনাও পরমাণু হামলার ক্ষমতা অর্জন করল।
২০০৯ সালে অরিহন্তকে আনুষ্ঠানিক ভাবে জলে নামানো হয়েছিল। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে ২০১৪ সালে সাবমেরিনটির ‘সি ট্রায়াল’ শুরু হয়। ২০১৮-র ৫ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা করেছিলেন, অরিহন্তের প্রথম ‘ডেটারেন্স পেট্রোল’ মহড়া সফল।
আইএনএস অরিহন্ত ভারতের প্রথম পরমাণু চালিত ডুবোজাহাজ নয়। রাশিয়ার কাছ থেকে ‘অ্যাকুলা ক্লাস নিউক্লিয়ার সাবমেরিন’ লিজ নিয়েছিল ভারত। আইএনএস চক্র নামে সেই পরমাণু শক্তিচালিত রুশ ডুবোজাহাজেই ভারতীয় নৌসেনার প্রশিক্ষণ হয়েছিল।
আইএনএস অরিহন্ত থেকে পরমাণু অস্ত্রবাহী ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর মারণক্ষমতাকে নিঃসন্দেহে নতুন মাত্রা দিল। তবে ‘প্রথমে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার না করার নীতির প্রতি ভারত এখনও দায়বদ্ধ’ বলে শুক্রবার প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের বিবৃতিতে বলা হয়েছে।