ফের পাকিস্তানের গালে তালিবানি থাপ্পড়! এ বার ইসলামাবাদের পরমাণু গবেষকদের অপহরণ করল তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান বা টিটিপি। ইতিমধ্যেই সমাজমাধ্যমে অপহৃতদের ভিডিয়ো প্রকাশ করেছে এই সশস্ত্র গোষ্ঠী। তাঁদের ছাড়তে শাহবাজ শরিফ সরকারের সামনে কড়া শর্ত রেখেছে তারা। অন্য দিকে এই ঘটনার পর পাকিস্তানের হাতে থাকা পরমাণু হাতিয়ারের সুরক্ষা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন।
পাক সংবাদ সংস্থাগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, অন্তত ১৬ জন পরমাণু গবেষককে অপহরণ করেছে টিটিপি। শুধু তা-ই নয়, অপহরণের সময়ে ইউরেনিয়ামের মতো তেজস্ক্রিয় পদার্থও লুঠ করে এই সশস্ত্র গোষ্ঠীর যোদ্ধারা। উল্লেখ্য, কয়েক দিন আগে টিটিপির বিরুদ্ধে পাকিস্তানের দক্ষিণ ওয়াজ়িরিস্তানে থানায় ঢুকে এক অফিসারকে অপহরণের অভিযোগ উঠেছিল।
টিটিপির হাতে বন্দি ১৬ গবেষককে পাকিস্তানের পরমাণু শক্তি কমিশন নিযুক্ত করছিলেন বলে জানা গিয়েছে। এঁরা প্রত্যেকেই ডেরা ইসমাইল খান এলাকার লক্কি মারওয়াতে কাবুল খেল পারমাণবিক খনি প্রকল্পে কর্মরত ছিলেন। অপহৃতদের মধ্যে কয়েক জন ইঞ্জিনিয়ার রয়েছেন। কবে এবং কখন তাঁদের অপহরণ করা হয়েছে, তা অবশ্য জানা যায়নি।
টিটিপির জারি করা ভিডিয়োয় অপহৃত পাক গবেষকদের শাহবাজ শরিফ সরকারের কাছে কাতর অনুনয় করতে দেখা গিয়েছে। নিজেদের জীবন রক্ষায় তাঁরা সশস্ত্র গোষ্ঠীটির যাবতীয় দাবি পূরণের অনুরোধ জানিয়েছেন। তবে এ ব্যাপারে পাক সরকারের তরফে এখনও কোনও প্রতিক্রিয়া মেলেনি।
অন্য দিকে বিজ্ঞানীদের জীবিত ছেড়ে দিতে শাহবাজ শরিফ সরকারের কাছে ইতিমধ্যেই একাধিক শর্ত রেখেছে টিটিপি। প্রথমত, অবিলম্বে পাক ফৌজকে তাঁদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বন্ধ করতে বলেছে তারা। দ্বিতীয়ত, পাক জেলে বন্দি টিটিপির নেতা এবং যোদ্ধাদের মুক্তির দাবিও পেশ করা হয়েছে।
গত বছরের (পড়ুন ২০২৪) ডিসেম্বর থেকে টিটিপি এবং পাক সরকারের মধ্যে লাগাতার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চলছে। এই সশস্ত্র গোষ্ঠীকে জঙ্গির তকমা দিয়েছে ইসলামাবাদ। পাক ফৌজের আরও অভিযোগ, আড়ালে থেকে টিটিপিকে ক্রমাগত সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে আফগানিস্তানের তালিবান শাসকেরা। দিচ্ছে আশ্রয়। ফলে ইসলামাবাদের সঙ্গে কাবুলের সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে বড় হামলা চালায় টিটিপি। সশস্ত্র গোষ্ঠীটির অতর্কিত আক্রমণে প্রাণ হারান পাক সেনার এক মেজর-সহ বেশ কয়েক জন জওয়ান। এর পরেই পরিস্থিতি জটিল হতে শুরু করে।
ওই ঘটনার প্রতিশোধ নিতে ২৫ ডিসেম্বর আফগানিস্তানের পাকতিকা প্রদেশে বিমান হামলা চালায় পাক বায়ুসেনা। সেখানে টিটিপি জঙ্গিদের গুপ্ত ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেওয়া গিয়েছে বলে দাবি করেন রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তারা। যদিও তা পত্রপাট খারিজ করে দেয় আফগানিস্তানের তালিবান সরকার।
উল্টে এই ঘটনায় বিবৃতি জারি করে কাবুল জানায়, পাক বিমান হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৪৭ জন নিরীহ নাগরিক। নিহতদের মধ্যে রয়েছে শিশু ও মহিলা। আফগানিস্তানে ঢুকে বিমান হামলার পরিণাম ইসলামাবাদকে ভুগতে হবে বলে ওই সময়ে হুঙ্কার দিয়েছিল তালিবান।
প্রসঙ্গত, শুধু হুঁশিয়ারি দিয়েই চুপ করে থাকেনি আফগানিস্তানের বর্তমান শাসক গোষ্ঠী। সীমান্তে ১৫ হাজার যোদ্ধা পাঠিয়ে দেয় তালিবান। অন্য দিকে বিমান হামলার কয়েক দিনের মাথাতেই পাক সেনাবাহিনীর উপর প্রত্যাঘাত শানায় টিটিপি। সীমান্তে অন্তত দু’টি পাক চৌকি দখল করে তাঁরা। সমাজমাধ্যমে জারি হয় সেই ভিডিয়ো। চৌকিগুলি খালি ছিল বলে চাপের মুখে বিবৃতি দিয়েছিল ইসলামাবাদ।
এ বারের ঘটনাকে অবশ্য আরও বেশি ভয়াবহ বলে মনে করছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা। কারণ, পরমাণু বিজ্ঞানীদের অপহরণ করতে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় ইউরেনিয়াম খনিতে টিটিপি ঢুকেছিল বলে জানা গিয়েছে। সেখানকার যাবতীয় কাজ আপাতত বন্ধ রেখেছে ইসলামাবাদ।
এই ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আমেরিকা-সহ পশ্চিমি দুনিয়া। ‘ভয়েস অফ আমেরিকা’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে পাক বিজ্ঞানীদের অপহরণ করে টিটিপি। এর পর তাঁদের গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় তারা।
যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দাদের অনুমান, ইউরেনিয়ামের সাহায্যে এ বার শক্তিশালী বোমা তৈরির চেষ্টা করবে টিটিপি। সেই কারণেই খনি থেকে ওই তেজস্ক্রিয় পদার্থ লুট করেছে তারা। লম্বা সময় ধরে পরমাণু বোমা তৈরির সুপ্ত ইচ্ছা পোষণ করছেন বহু জঙ্গি নেতা। সেই রাস্তায় প্রাথমিক সাফল্য পেয়েছে টিটিপি।
জঙ্গি সংগঠনগুলি পরমাণু বোমা তৈরি করলে দুনিয়া জুড়ে শক্তির ভারসাম্য যে পুরোপুরি নষ্ট হবে, সেই আশঙ্কা করেছেন আমেরিকার গোয়েন্দারা। এর আগেও পাক সেনাবাহিনীর হাতে থাকা পারমাণবিক হাতিয়ারের সুরক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা। যুক্তরাষ্ট্রের অনেকেই ইসলামাবাদের কাছে আণবিক অস্ত্র থাকাকে অত্যন্ত বিপজ্জনক বলে মনে করেন।
পাক সেনাবাহিনী অবশ্য দাবি, টিটিপির হাতে বন্দি আট জনকে ইতিমধ্যেই উদ্ধার করা হয়েছে। অপহৃতদের সাধারণ খনি শ্রমিক বলে উল্লেখ করেছেন রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তারা। অন্য দিকে, তাঁদের পরিচয়পত্রের ছবি প্রকাশ করেছে টিটিপি। ফলে পাক ফৌজের বক্তব্যের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে।
২০০৭ সালে টিটিপি তৈরি করেন বাইতুল্লাহ মেহসুদ। পাশতুনভাষী একাধিক সশস্ত্র গোষ্ঠীকে এক ছাতার তলায় নিয়ে আসেন তিনি। প্রথম দিন থেকেই পাক সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামে টিটিপি। ইসলামাবাদে শরিয়া আইন চালু করাই এই কট্টরপন্থী সংগঠনটির লক্ষ্য।
গত ১৭ বছরে আফগানিস্তান লাগোয়া খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে বহু বার পাক সেনাকে নিশানা করেছে টিটিপি। ফৌজি স্কুলে ঢুকে নিরীহ শিশুদের হত্যার অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। ওই এলাকার উত্তর এবং দক্ষিণ ওয়াজ়িরিস্তানে রয়েছে টিটিপির শক্তি ঘাঁটি। সেখানে এক রকম নিজস্ব সরকার চালাচ্ছে এই সশস্ত্র গোষ্ঠী।
২০২১ সালে দ্বিতীয় বারের জন্য আফগানিস্তানে তালিবান সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে বেজায় খুশি হয়েছিল পাকিস্তান। তবে ইসলামাবাদের সেই আনন্দ বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। দুই দেশের মধ্যে আন্তর্জাতিক সীমান্ত ‘ডুরান্ড লাইন’ নামে পরিচিত। এই সীমান্তকে কোনও দিনই মান্যতা দেয়নি তালিবান। তাই আড়ালে থেকে টিটিপিকে সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে তারা।
সব ছবি: সংগৃহীত।