
ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে উদ্বেগে ইজ়রায়েল। ঘুম উড়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও। আণবিক অস্ত্র তৈরির থেকে তেহরানকে সরিয়ে আনতে সে দেশে সরাসরি হামলার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। পারস্য উপসাগরের শিয়া মুলুকটির এই কর্মসূচি ভন্ডুল করতে গত কয়েক বছরে চেষ্টার ত্রুটি করেনি ইহুদিদের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ।

ইজ়রায়েল-ইরান সম্পর্ক যেমন সাপে নেউলে, ভারত-পাকিস্তানও ঠিক তাই। ইসলামাবাদ যাতে পরমাণু শক্তিধর হয়ে উঠতে না পারে, গত শতাব্দীতে সেই পরিকল্পনা করে ফলে ইহুদি সরকার। এ ব্যাপারে নয়াদিল্লির পূর্ণ সমর্থন পায় তেল আভিভ। কিন্তু, তার পরও নানা কারণে পাকিস্তানের পরমাণু কর্মসূচি বিনষ্ট করতে সক্ষম হয়নি ইজ়রায়েল এবং ভারত।

১৯৮০-র দশকে ইসলামাবাদ দ্রুত গতিতে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির দিকে এগোতে থাকে। পাক সেনার সদর দফতর রাওয়ালপিন্ডি সংলগ্ন কাহুতায় এই সংক্রান্ত গবেষণা চালাচ্ছিলেন সে দেশের প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। যদিও বিশ্লেষকদের বড় অংশই মনে করেন চিন এবং উত্তর কোরিয়া থেকে প্রযুক্তি চুরি করে আণবিক বোমা তৈরি করেছেন তাঁরা।

১৯৭১ সালের যুদ্ধে ভারতের হাতে পুরোপুরি পর্যুদস্ত হওয়ার পর পরমাণু হাতিয়ার নির্মাণে মনোনিবেশ করে পাক সরকার। ওই সময়ে এ ব্যাপারে তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তথা পাকিস্তান পিপল্স পার্টির (পিপিপি) প্রতিষ্ঠাতা জুলফিকার আলি ভুট্টো। তিনি বলেন, ‘‘প্রয়োজনে সবাই ঘাস-পাতা খেয়ে থাকবে, কিন্তু আমাদের আণবিক বোমা চাই।’’

সাবেক পাক প্রধানমন্ত্রী ভুট্টোর ওই মন্তব্যের পর প্রমাদ গোনে নয়াদিল্লি। ইসলামাবাদের পরিকল্পনা জানতে কোমর বেঁধে নেমে পড়ে ভারতের গুপ্তচর সংস্থা ‘রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং’ বা র। কাহুতায় কর্মরত প্রতিরক্ষা গবেষকদের চুলের নমুনা সংগ্রহ করেন তাঁরা। রাসায়নিক পরীক্ষায় তাতে ভারী মাত্রায় ইউরেনিয়ামের অস্তিত্ব মেলে। ফলে দু’য়ে দু’য়ে চার করতে ভারতীয় গুপ্তচরদের খুব একটা সমস্যা হয়নি।

পাকিস্তানের পরমাণু হাতিয়ার তৈরির বিষয়টিকে ভাল চোখে দেখেনি ইজ়রায়েলও। কারণ ইহুদিভূমিকে মান্যতা দিতেই রাজি নয় ইসলামাবাদ। শুধু তা-ই নয়, প্যালেস্টাইনের প্রবল সমর্থক রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তারা তেল আভিভকে শত্রু বলে মনে করেন। ফলে গাছ বড় হওয়ার আগেই তা কেটে ফেলার নীল নকশা ছকে ফেলে গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ।

১৯৮১ সালে ইরাকের ওসিরাক পারমাণবিক প্রতিষ্ঠান উড়িয়ে দেয় ইজ়রায়েল ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ)। ইহুদি বায়ুসেনার বিমানহানায় ধ্বংস হয় বাগদাদের আণবিক চুল্লি। আইডিএফ এই আক্রমণের নামকরণ করে ‘অপারেশন ব্যাবিলন’। ঠিক একই কায়দায় পাকিস্তানের কাহুতার পারমাণবিক গবেষণাকেন্দ্রটিকে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল ইহুদি গুপ্তচরদের।

ওই সময়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে ইজ়রায়েলের সঙ্গে ভারতের কোনও কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু, বিভিন্ন ইস্যুতে নয়াদিল্লি এবং তেল আভিভের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। সূত্রের খবর, কাহুতা ধ্বংসের পরিকল্পনায় প্রাথমিক ভাবে সবুজ সঙ্কেত দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। ফলে ভারতীয় ফৌজ এবং গুপ্তচরদের সঙ্গে কথাবার্তা বলা শুরু করেন আইডিএফের সেনাকর্তারা।

১৯৮২ সালে ওয়াশিংটন পোস্ট এবং ১৯৮৪ সালে এবিসি নিউজ়ের প্রতিবেদনে ভারত ও ইজ়রায়েলের যৌথ উদ্যোগে পাক পরমাণু কর্মসূচি ধ্বংসের পরিকল্পনা ফাঁস হয়। এই দুই সংবাদমাধ্যমের দাবি, ঝুঁকিপূর্ণ এই অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এফ-১৫, এবং এফ-১৬ যুদ্ধবিমান ব্যবহারের কথা ছিল আইডিএফের।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের সাংবাদিক অ্যাড্রিয়ান লেভি লেখেন, ‘অপারেশন ব্যাবিলন’-এর সাফল্যের পর ভারতীয় সেনা এবং গোয়েন্দাকর্তাদের একটি উচ্চ পর্যায়ের দল ইজ়রায়েল সফরে যান। সেখানেই পুরো অভিযানের যাবতীয় খুঁটিনাটি ঠিক করেন তাঁরা।

পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমগুলির দাবি, ইজ়রায়েলি লড়াকু জেটগুলির গুজরাতের জামনগরের বায়ুসেনা ঘাঁটি থেকে ওড়ার কথা ছিল। তবে সেখান থেকে সীমান্ত পেরিয়ে কাহুতায় হামলা চালাত না তারা। উল্টে সোজা কাশ্মীর উড়ে গিয়ে নিয়ন্ত্রণরেখা (পড়ুন লাইন অফ কন্ট্রোল বা এলওসি) পেরিয়ে রাওয়ালপিন্ডির দিকে যাওয়ার কথা ছিল তাদের।

ইজ়রায়েলি যুদ্ধবিমানের ভূস্বর্গ হয়ে আক্রমণ শানানোর নেপথ্যে ভারতীয় গুপ্তচরদের সুনির্দিষ্ট একটি পরিকল্পনা কাজ করেছিল। র’-এর যুক্তি ছিল এতে অতি সহজে পাক রাডারের নজর এগিয়ে কাহুতায় পৌঁছে যাবে ইহুদিদের লড়াকু জেট। দ্বিতীয়ত, পাহাড়ের আড়ালকে কাজে লাগিয়ে রাওয়ালপিন্ডির আকাশসীমায় ঢুকতে পারবেন আইডিএফের যোদ্ধা পাইলটেরা।

লেভির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৮৪ সালের মার্চে এই অভিযানের চূড়ান্ত ছাড়পত্র দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। ইজ়রায়েলের কুর্সিতে তখন ইৎজ়্যাক শামির। সূত্রের খবর, বিষয়টি নিয়ে একাধিক বার নয়াদিল্লির সঙ্গে কথা বলেন তিনি। তবে ইন্দিরার সঙ্গে সরাসরি এ ব্যাপারে তাঁর আলোচনা হয়েছিল কি না, তা স্পষ্ট নয়।

কাহুতা ধ্বংসের পরিকল্পনা যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, তখনই বাদ সাধে আমেরিকা। পাকিস্তানের কাছে সব কিছু ফাঁস করে দেয় মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ। ফলে এ ব্যাপারে আগাম সতর্কতা নিয়ে ফেলে ইসলামাবাদ। বাধ্য হয়ে হামলার পরিকল্পনা বাতিল করে ভারত ও ইজ়রায়েল। দু’টি দেশ অবশ্য সরকারি ভাবে কখনওই বিষয়টি স্বীকার করেনি।

১৯৯৮ সালের মে মাসে বালোচিস্তানের চাগাই জেলার রাস কোহ পাহাড়ে পরমাণু বোমার পরীক্ষা চালায় পাকিস্তান। ওই বছরই রাজস্থানের পোখরানে পাঁচটি আণবিক বোমা পরীক্ষা করে নয়াদিল্লি। ভারতের আগ্রাসী মনোভাবের পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসাবে পারমাণবিক হাতিয়ার তৈরি করা হয়েছে বলে ওই সময়ে যুক্তি দিয়েছিল ইসলামাবাদ।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে দুই দেশের পরমাণু অস্ত্র ভান্ডারের উপর একটি সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশ করে ‘স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট’। সেখানে বলা হয়েছে, ২০২৩ সাল থেকে আণবিক অস্ত্র বৃদ্ধির উপর জোর দিয়ে চলেছে দুই দেশ। বর্তমানে পাকিস্তানের হাতে রয়েছে ১৭০টি পারমাণবিক ওয়ারহেড। অন্য দিকে ভারতের হাতে থাকা আণবিক অস্ত্রের সংখ্যা ১৭২।

তবে পরমাণু হামলার সক্ষমতার নিরিখে পাকিস্তানের থেকে এগিয়ে রয়েছে ভারত। এ দেশের সেনা স্থল, জল, আকাশ এমনকি ডুবোজাহাজ থেকে আণবিক আক্রমণ চালাতে সক্ষম। ফৌজি পরিভাষায় একে ‘নিউক্লিয়ার ট্রায়েড’ বলা হয়। এই প্রযুক্তি এখনও তৈরি করতে পারেনি ইসলামাবাদ।

পাকিস্তানের ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলেও ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে পিছিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেকটাই সক্ষম হয় মোসাদ। ২০২০ সালের নভেম্বর তেহরানের শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানী মহসেন ফাখরিজ়াদেহকে গুলিতে নিকেশ করেন ইহুদি গুপ্তচরেরা। কিন্তু তার পরও আণবিক অস্ত্র নির্মাণের কর্মসূচি থেকে সরে আসেনি ইরান। পারস্য উপসাগরের তীরের শিয়া মুলুকটি বর্তমানে এই মারণাস্ত্র তৈরির খুব কাছাকাছি রয়েছে বলে একরকম নিশ্চিত আমেরিকা ও ইজ়রায়েল।
সব ছবি: সংগৃহীত।