
জমে উঠেছে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ বা আইপিএল ২০২৫। ট্রফি জয়ের লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ১০টি দল। বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মা, মহেন্দ্র সিংহ ধোনি, নাকি অন্য কেউ, কার মাথায় উঠবে এ বার চ্যাম্পিয়নের মুকুট? কোন খেলোয়াড়ের ব্যাটে আসবে সবচেয়ে বেশি রান? সর্বাধিক উইকেট নেবেন কে? এ সব প্রশ্নে সরগরম দেশের ক্রিকেটদুনিয়া।

ফি-বছর আইপিএল থেকে বিপুল অর্থ রোজগার করে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড। প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া দলের নিয়ন্ত্রণকারী ফ্র্যাঞ্চাইজ়িগুলির পকেটেও আসে মোটা টাকা। কোনও দল পর পর ম্যাচ হারলেও তেমন প্রভাব পড়ে না মুনাফার অঙ্কে। ফলে স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, আইপিএল থেকে কী ভাবে অর্থ উপার্জন করে তারা? এ ক্ষেত্রে বোর্ডের হিসাবটাই বা কী?

এক মাস ধরে চলা ঘরোয়া টি-২০ লিগ থেকে বোর্ড ও ফ্র্যাঞ্চাইজ়িগুলির আয়ের বিষয়টি বুঝতে হলে আইপিএলের কাঠামো জানতে হবে। ২০০৮ সালে প্রথম বার ভারতে চালু হয় এই টুর্নামেন্ট। এ বছর এর ১৮তম সিজ়ন খেলা হচ্ছে। ২০২৫ সালের আইপিএলের মূল স্পনসর দেশের ঐতিহ্যবাহী শিল্প সংস্থা টাটা।

এ বারের আইপিএলে মোট ৭৪টি ম্যাচ খেলবে প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া ১০টি দল। দেশের ১৩টি শহরে এর আয়োজন করেছে বোর্ড। ২৫ মে হবে ফাইনাল। আর্থিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, আইপিএল কোনও সংস্থা হলে তার মূলধন দাঁড়াত ১,২০০ কোটি ডলার। প্রতিযোগিতাটির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়ায় এই টাকার অঙ্ক আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে।

আইপিএল থেকে মোট চারটি গোষ্ঠী বিপুল অর্থ উপার্জন করে থাকে। এই তালিকার একেবারে উপরে রয়েছে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড। দ্বিতীয় স্থানে ক্রিকেট দলগুলির ফ্র্যাঞ্চাইজ়িগুলিকে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া মিডিয়া স্বত্ব নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা এবং স্পনসর এই প্রতিযোগিতা থেকে মোটা অর্থ রোজগারের সুযোগ পায়।

কুড়ি-বিশের লিগে সর্বাধিক অর্থ আসে মিডিয়া ব্রডকাস্টিং থেকে। যে কোনও টিভি চ্যানেল বা ওয়েব প্ল্যাটফর্ম আইপিএলের ম্যাচ দেখাতে পারে না। সুনির্দিষ্ট একটি চ্যানেল এবং ওয়েব প্ল্যাটফর্মকে এই অধিকার দেয় বোর্ড। বিনিময়ে বিসিসিআইকে (বোর্ড অফ কন্ট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়া) বিপুল অর্থ প্রদান করে সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যম সংস্থা।

২০০৮ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত আইপিএলের খেলা দেখানোর অধিকার ছিল সোনির হাতে। এর জন্য ক্রিকেট বোর্ডকে ৮,২০০ কোটি টাকা দেয় তারা। ২০১৮ সালে থেকে পাঁচ বছরের জন্য এই লিগের সম্প্রচার স্বত্ব পায় স্টার স্পোর্টস। বোর্ডকে দেওয়া তাদের অর্থের পরিমাণ ছিল ১৬ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকা, যা সোনির দেওয়া অর্থের দ্বিগুণ।

২০২৩ থেকে ২০২৭ সালের মধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশে আইপিএল দেখানোর টিভি স্বত্ব কিনেছিল স্টার স্পোর্টস। ডিজিটাল স্বত্ব কিনেছিল ভায়াকম ১৮। ফলে টিভিতে স্টার স্পোর্টসের পর্দায় আইপিএল দেখতে পাচ্ছেন ক্রিকেটপ্রেমীরা। ডিজিটাল পর্দায় এত দিন আইপিএল দেখা যেত জিয়োসিনেমায়। যদিও পরে ভায়াকম ১৮-এর মালিক রিলায়্যান্স কিনে নেয় স্টারকে। তাই এখন জিয়োহটস্টারে খেলা দেখা যাচ্ছে। ডিজ়নি স্টার বোর্ডের থেকে সম্প্রচার স্বত্ব কিনেছিল ২৩,৫৭৫ কোটি টাকায়।

অন্য দিকে জিয়ো-হটস্টার ওয়েব প্ল্যাটফর্মে এ বারের ঘরোয়া কুড়ি-বিশের লিগ দেখতে পাচ্ছেন ক্রিকেটপ্রেমীরা। এর জন্য বোর্ডের সঙ্গে ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকার চুক্তি করেছে ভায়াকম ১৮। উল্লেখ্য, টিভি এবং ওয়েব প্ল্যাটফর্মে ম্যাচ দেখানোর সময়ে বিজ্ঞাপন চালিয়ে থাকে এই সমস্ত সংস্থা। সেখানে থেকে বিপুল আয় করে তারা।

ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউ জ়িল্যান্ডে আইপিএল ম্যাচ দেখতে ক্রিকেটপ্রেমীদের ভায়াকম ১৮-র চ্যানেলে চোখ রাখতে হচ্ছে। এ ছাড়া পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলিতে এই টি-২০ লিগের মিডিয়া সম্প্রচার স্বত্ব টাইম্স ইন্টারনেটকে দিয়েছে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড। এই দুই সংস্থার থেকেও বিপুল অর্থ নিচ্ছে বিসিসিআই।

আইপিএলের টাইটেল স্পনসরশিপ বিক্রি করেও মোটা টাকা রোজগার করে বোর্ড। ২০০৮ সালে মাত্র চার বছরের জন্য ডিএলএফের কাছে এটি বিক্রি করে বিসিসিআই। এর জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে ২০০ কোটি টাকা দিতে হয়েছিল। এ ছাড়া পেপসি, ভিভো, ড্রিম ইলেভেন এবং টাটার কাছে গিয়েছে এই টাইটেল স্পনসরশিপ।

এ বছরের আইপিএলের টাইটেল স্পনসর টাটার থেকে ২,৫০০ কোটি টাকা পাচ্ছে বোর্ড। অর্থাৎ গত ১৭ বছরে ১০ গুণের বেশি বেড়েছে টাইটেল স্পনসরশিপ বিক্রির অর্থ।

আইপিএলে অংশ নেওয়া দলগুলির ক্রিকেটারদের ব্যাট, গ্লাভস থেকে শুরু করে জার্সিতে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নাম ছাপা থাকে। এর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সংস্থাটি তার পণ্যের প্রচার করে থাকে। এই বিজ্ঞাপনের জন্য ফ্র্যাঞ্চাইজ়িগুলিকে অর্থ দিতে হয়। কুড়ি-বিশের ক্রিকেট লিগে রোজগারে এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।

এ ছাড়া মাঠের এলইডি স্ক্রিন থেকে শুরু করে বাউন্ডারি সীমানার বোর্ডেও বিভিন্ন সংস্থার বিজ্ঞাপন সাঁটানো থাকে। এ ক্ষেত্রেও বোর্ডকে টাকা দেয় সংশ্লিষ্ট সংস্থা।

আইপিএলের প্রতিটি দলের সমাজমাধ্যমে আলাদা আলাদা অফিশিয়াল পেজ রয়েছে। সেখানে কোনও সংস্থা বিজ্ঞাপন দিলে তার থেকে মোটা টাকা নিয়ে থাকে সংশ্লিষ্ট ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি। পাশাপাশি, জার্সি, টুপি বা লোগো আঁকা কফি মগ বাজারে বিক্রি করেও বিপুল অর্থ রোজগার করে কুড়ি-বিশের ঘরোয়া লিগে অংশ নেওয়া দলগুলি।

আইপিএল ম্যাচের টিকিট বিভিন্ন দামে বিক্রি করে থাকে ভারতীয় বোর্ড। সূত্রের খবর, এর থেকে কয়েক কোটি টাকা রোজগার করে বিসিসিআই। এই আয়কে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যে টিমের হোম গ্রাউন্ডে ম্যাচ হচ্ছে, তারা টিকিট বিক্রির অর্থের ৮০ শতাংশের অধিকারী। বাকি ২০ শতাংশ পাবে বোর্ড। উদাহরণ হিসাবে কলকাতা নাইট রাইডার্সের (কেকেআর) ম্যাচ ইডেন উদ্যানে হলে, টিকিট বিক্রি করে প্রাপ্ত অর্থের ৮০ শতাংশ পাবে সংশ্লিষ্ট দল।

আইপিএলের প্রথম ১০ বছরে বোর্ড এবং ফ্র্যাঞ্চাইজ়িগুলির আয়ের পরিমাণ ছিল ৮,২০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতি বছর ৮২০ টাকা করে রোজগার হয়েছিল তাদের। প্রথম দিকে ব্রডকাস্টিং থেকে প্রাপ্ত অর্থের ২০ শতাংশ যেত বোর্ডের তহবিল। বাকি ৮০ শতাংশ পেত প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া দলগুলি। পরবর্তী কালে একে সমান ভাগে ভাগ করে দেয় বিসিসিআই।

গত বছর আইপিএল থেকে বোর্ডের মূল আয়ের অঙ্ক ছিল ৭,১৪৩ কোটি টাকা। কিন্তু আইপিএল বিজয়ী টিম কেকেআর পুরস্কার বাবদ পেয়েছিল মাত্র ২০ কোটি টাকা। দ্বিতীয় স্থানে থাকা সানরাইজার্স হায়দরাবাদের প্রাইজ় মানি ছিল ১৩ কোটি টাকা।

তবে আইপিএলের ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলির বেশ কিছু খরচও রয়েছে। যেমন দল তৈরি করার জন্য নিলামে খেলোয়াড় কেনা, ম্যাচ খেলার জন্য বিভিন্ন শহরে যাতায়াত, সেখানে থাকা-খাওয়া এবং স্টেডিয়াম ভাড়া নেওয়ার খরচ। কিন্তু বিজ্ঞাপন বাবদ যে পরিমাণ অর্থ উপার্জন হয় তার খুব অল্প অংশই এতে ব্যয় করতে হয় তাদের।

আর্থিক সংস্থা জেফারিজ়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সালে আইপিএল থেকে ৬৪৫ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল বোর্ড এবং প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া সমস্ত ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি। ২০২২ সালের মধ্যে বোর্ডের আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮০ হাজার কোটি টাকা। ২০২৩ এবং ২০২৪ সালে সেটা আরও বৃদ্ধি পেয়ে ৩৩ হাজার কোটি দাঁড়িয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
সব ছবি: সংগৃহীত।