
একটা খাল কাটতে পারলেই বদলে যাবে সব হিসাব। দুই সাগরে যাতায়াতের জন্য মিলবে ‘বাইপাস’। শুধু কী তা-ই? তখন আর পণ্যবোঝাই জাহাজ নিয়ে সাত মুলুক ঘুরে যেতে হবে না গন্তব্যে। বাঁচবে সময়, সঙ্গে খরচও। আর তাই শত চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও এই খাল কাটতে মরিয়া হয়ে উঠেছে ড্রাগন। এতে তারা সাফল্য পেলে কতটা লাভ হবে ভারতের? না কি উল্টে বাড়বে বিপদ? উঠছে সেই প্রশ্নও।

দক্ষিণ তাইল্যান্ডের মালয় উপদ্বীপ। এই এলাকার উপর দিয়ে একটি খাল কাটার পরিকল্পনা করছে চিন। বেজিঙের হাত ধরে জলপথটি প্রাণ পেলে, তা তাই খাল বা ক্রা খাল নামে পাবে পরিচিতি। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটির গুরুত্ব সুয়েজ ও পানামা খালের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। খালটি কাটা গেলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সামুদ্রিক বাণিজ্যের নকশা পুরোপুরি বদলে যাবে। সেই সঙ্গে অর্থনীতিও।

প্রস্তাবিত তাই খাল আন্দামান সাগর এবং তাইল্যান্ড উপসাগরের মধ্যে সেতুবন্ধের কাজ করবে। ফলে কোনও জাহাজকেই মলাক্কা প্রণালী ঘুরে আন্দামান সাগরে আসতে হবে না। সামুদ্রিক যাতায়াতের ক্ষেত্রে একটা ‘শর্টকাট’ পাবে তারা। সিঙ্গাপুর থেকে বঙ্গোপসাগরে আসতে প্রায় ১,২০০ কিলোমিটার কম রাস্তা পাড়ি দিতে হবে সংশ্লিষ্ট জাহাজকে। ফলে সময় এবং জ্বালানি খরচের অনেকটাই হবে সাশ্রয়।

এ-হেন তাই খাল কাটার প্রস্তাব কিন্তু আজকের নয়। ১৬৭৭ সালে প্রথম এর পরিকল্পনা করেন তাইল্যান্ডের তৎকালীন রাজা নারাই। এর জন্য বিখ্যাত ফরাসি ইঞ্জিনিয়ার ডি লামারকে নিযুক্ত করেন তিনি। দায়িত্ব পেয়ে কোমর বেঁধে কাজে লেগে পড়েন লামার। মালয় উপদ্বীপের মানচিত্র এবং জমি জরিপের কাজ দ্রুত শেষ করেন তিনি। কিন্তু তার পরই পরিকল্পনা থেকে সরে আসেন নারাই।

জমি জরিপ করে লামার দেখেছিলেন, মালয় উপদ্বীপের অধিকাংশ জায়গা পাহাড়ি এবং ঘন জঙ্গলে ভরা। ফলে সেখান দিয়ে খাল কাটা এক রকম অসম্ভব। ১৯ শতকের গোড়ার দিকে দ্বিতীয় বার এই প্রকল্প নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। কিন্তু ভূ প্রাকৃতিক চ্যালেঞ্জের কারণে ইংরেজরাও শেষ পর্যন্ত রণে ভঙ্গ দেন। পরবর্তী সময়ে প্রকল্প নিয়ে আলোচনা হয়েছে বিস্তর। কিন্তু কেউই কাজ শুরু করার সাহস দেখাতে পারেনি।

২১ শতকে নতুন করে তাই খাল কাটার ব্যাপারে গুরুত্ব সহকারে চিন্তাভাবনা শুরু করেছে চিন। বেজিং সামুদ্রিক বাণিজ্যের এই রাস্তাটিকে প্রাচীন রেশম পথের (সিল্ক রুট) অংশ বলে বিবেচনা করে। ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় দীর্ঘ দিন ধরেই বেসামরিক সামুদ্রিক অবকাঠামো তৈরি করে চলেছে ড্রাগন। এরই নাম ‘স্ট্রিং অফ পার্লস’। মালয় উপদ্বীপে খাল কাটার প্রকল্পটি তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা।

প্রস্তাবিত তাই খালটি আকারের দিক থেকে সুয়েজ এবং পানামা খালের সমতুল্য হবে বলে জানা দিয়েছে। ১৮৫৯ থেকে ১৮৬৯ সালের মধ্যে কাটা মিশরের সুয়েজ খালটি ১৯২ কিলোমিটার লম্বা। অন্য দিকে পানামা খালের দৈর্ঘ্য ৭৭ কিলোমিটার। ১৯০৪ সালে শুরু হয়ে এর নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৯১৪ সালে। পরিকল্পনায় থাকা তাই খালটি ১২৮ কিলোমিটার লম্বা হবে বলে জানা গিয়েছে।

বিশ্লেষকেরা মনে করেন, তিনটি খালের মধ্যে সুয়েজকে কাটা ছিল সবচেয়ে সহজ। কারণ, সমতল মরুভূমিতে এটিকে খনন করা হয়েছিল। অন্য দিকে পাহাড়ি ভূখণ্ডের বুক চিরে তৈরি হয় পানামা খাল। সেখান দিয়ে জাহাজ চলাচল মোটেই সহজ ছিল না। পানামার প্রযুক্তিকে মাথায় রেখে তাই খাল কাটতে হবে বলে স্পষ্ট করেছেন তাঁরা।

শতবর্ষ আগে আটলান্টিক এবং প্রশান্ত মহাসাগরকে জুড়তে তৈরি করা পানামা খালকে আজও ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের অন্যতম বিস্ময় বলে গণ্য করা হয়। এতে সামুদ্রিক ভ্রমণের সময় অন্তত এক সপ্তাহ কমানো গিয়েছে। তাই খাল কিন্তু অতটা সময় সাশ্রয় করতে পারবে না। এটি বাস্তবের মুখ দেখলে দুই থেকে তিন দিন কমবে সমুদ্রযাত্রার সময়।

তাই খালের সম্ভাব্য করিডোর হিসাবে ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি রুট বেছে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ছোট রাস্তাটির দৈর্ঘ্য ৪৪ কিলোমিটার। কিন্তু এই রাস্তায় জাহাজকে পাথুরে উপদ্বীপের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। জায়গাটি মালয়ের ক্রা এলাকার স্থলসন্ধিতে অবস্থিত। এখান থেকেই ক্রা খাল নামটি নেওয়া হয়েছে।

প্রস্তাবিত খালের দ্বিতীয় সংক্ষিপ্ত রাস্তাটির নাম ‘ডিপ সাউথ’। তবে আইনগত দিক থেকে এই রাস্তাটিকে চালু করা বেশ কঠিন। কারণ, জায়গাটি দক্ষিণ তাইল্যান্ডের তিনটি প্রদেশের সীমানাবর্তী এলাকায় অবস্থিত। ‘ডিপ সাউথ’ দিয়ে জাহাজ নিয়ে যেতে হলে তাইল্যান্ডকে কৃত্রিম সীমান্ত তৈরি করতে হবে। আন্তর্জাতিক আইন মেনে সেটা কতটা সম্ভব, তা নিয়ে যথেষ্ট ধোঁয়াশা রয়েছে।

আর তাই খাল কাটার ক্ষেত্রে ইঞ্জিনিয়ারদের সবচেয়ে পছন্দের রাস্তার নাম ‘নাইন-এ’। আন্দামান উপকূলের ক্রাবি প্রদেশ থেকে তাইল্যান্ড উপসাগরের সোংখলা প্রদেশ পর্যন্ত খালটি কাটতে চাইছেন তাঁরা। বিশেষজ্ঞদের কথায়, এই রুটে ক্রা-র স্থলসন্ধি পড়বে না। তাই জলপথটির নামকরণ তাই খাল হওয়াই বাঞ্ছনীয়।

সূত্রের খবর, ৪০০ মিটার চওড়া এবং ৩০ মিটার গভীর করে কাটা হবে ওই খাল। ফলে আর্থিক খরচের পাশাপাশি এটি তৈরি করার পরিবেশগত চ্যালেঞ্জও রয়েছে। খাল কাটার সময়ে যে প্রচুর পরিমাণে মাটি উঠবে, তা অন্যত্র স্থানান্তরিত করতে হবে। এর জন্য আস্ত একটা দ্বীপের প্রয়োজন হতে পারে।

মালয় উপদ্বীপের জঙ্গলে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা নেহাত কম নয়। খাল কাটতে গেলে ধ্বংস হবে অরণ্যের কিছু অংশ। এতে সেখানকার জীববৈচিত্র্য মারাত্মক ভাবে ধাক্কা খাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাইল্যান্ড-সহ গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে এর মূল্য চোকাতে হতে পারে।

চলতি বছরে খালটি কাটার ব্যাপারে একটি সমীক্ষার নির্দেশ দিয়েছে তাইল্যান্ড সরকার। তৈরি হয়েছে ‘তাই ক্যানাল অ্যাসোসিয়েশন ফর স্টাডি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ নামের একটি কমিটি। তাঁদের প্রাথমিক রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রস্তাবিত প্রকল্পটির কাজ শুরু হলে সরাসরি ১০ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান হবে।

তবে এই খাল কাটার দায়িত্ব ব্যাঙ্কক শেষ পর্যন্ত চিনের হাতে তুলে দেবে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অধিকাংশ দেশের সঙ্গে বেজিঙের সম্পর্ক ভাল নয়। নানা ভাবে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলিকে উত্ত্যক্ত করার অভিযোগ রয়েছে ড্রাগনের বিরুদ্ধে। তাই এ ব্যাপারে এখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি তাই সরকার।

মালয় উপদ্বীপ দিয়ে খাল কাটার ব্যাপারে চিনের আগ্রহের নেপথ্যে একাধিক কারণ রয়েছে। দীর্ঘ দিন ধরেই মলাক্কা প্রণালী এড়িয়ে সমুদ্র বাণিজ্যের দ্বিতীয় রাস্তা খুঁজে চলেছে বেজিং। সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হওয়ায় ড্রাগনের এর প্রয়োজনীয়তা আরও বেড়েছে।

বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন, ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার প্রভুত্ব নিয়ে আগামী দিনে আমেরিকাকে কড়া টক্কর দেওয়ার রাস্তায় হাঁটবে ড্রাগন। সে ক্ষেত্রে বেজিংকে শায়েস্তা করতে যুদ্ধজাহাজ দাঁড় করিয়ে মলাক্কা প্রণালী বন্ধ করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। এতে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে চিনা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য। আর তাই এখন থেকে বিকল্প রাস্তার খোঁজ চালাচ্ছেন সেখানকার প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।

বিশ্লেষকেরা জানিয়েছেন, প্রস্তাবিত তাই খাল কাটা হলে সমুদ্র বাণিজ্যের দিক থেকে দিল্লিরও লাভ হবে। মলাক্কা প্রণালীকে বাদ দিয়ে আরও একটি যাতায়াতের রাস্তা পাবে ভারতীয় পণ্যবোঝাই জাহাজ। তবে এটি চিনের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএর নৌবাহিনী ব্যবহার করা শুরু করলে আন্দামান সাগরে রক্তচাপ বাড়বে নয়াদিল্লির। কারণ, এই এলাকায় একচ্ছত্র প্রভাব রয়েছে ভারতীয় নৌসেনার।
সব ছবি: সংগৃহীত।