Relationship

নানা কারণে বাবার সঙ্গে সন্তানের দূরত্ব তৈরি হতে পারে! তা মেটাবেন কী ভাবে?

বাবার হাত ধরে হাঁটতে শেখা। সাইকেল চালানো, সাঁতার কিংবা কঠিন অঙ্কের জটিল সমাধান— সবই বাবার তত্ত্বাবধানে। কিন্তু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই সহজ সমীকরণ কারও কারও ক্ষেত্রে জটিল হয়ে যায়। সন্তানের সঙ্গে দূরত্বও তৈরি হয়। কত কিলোমিটার, কত মাইল, কত ক্রোশ পথ হাঁটলে সে দূরত্ব ঘুচবে?

Advertisement
অঙ্কিতা দাশ
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ জুন ২০২৪ ১৬:৫৭
How to overcome and repair the bridge between father and children

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

ছোট থেকেই অঙ্কে কাঁচা। বাবার সাহায্য ছাড়া পাটিগণিতে পিতা-পুত্রের বয়স সংক্রান্ত অঙ্ক কিছুতেই কষতে পারতেন না। মাধ্যমিক পরীক্ষার আগের রাতে চোখের জলে-নাকের জলে অবস্থা। সে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার একমাত্র ভরসাযোগ্য মানুষ ছিলেন বাবা। অথচ, বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই মানুষটাই কেমন যেন বদলে গেল। বাবার সঙ্গে সন্তানের সহজ সম্পর্কটা যেন বইয়ের অঙ্কের চেয়েও বেশি জটিল হয়ে গেল।

Advertisement

‘জেনারেশন গ্যাপ’!

খালি চোখে যতটা সহজ বা সাধারণ মনে হয়, বিষয়টা তেমন নয়। বাবার সঙ্গে সন্তানের বয়সে ফারাক থাকবে। পছন্দ-অপছন্দ কিংবা মানসিকতার ফারাক তৈরি হওয়াও অস্বাভাবিক নয়। চিঠি, ল্যান্ডলাইন থেকে মোবাইল, ইনস্টাগ্রাম কিংবা অনলাইন ডেটিং অ্যাপ— দূরত্ব তৈরি হওয়ার পিছনে প্রযুক্তির ভূমিকাও কম নয়। অনেক বাবা কর্মসূত্রে বাইরে থাকেন। তাই ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সে ভাবে সম্পর্ক গড়ে ওঠে না। আবার, এক বাড়িতে থেকেও সম্পর্কের সুতো আলগা হয়ে যাওয়ার উদাহরণও কম নেই। প্রত্যেকের ক্ষেত্রে কারণগুলি আলাদা।

দোকান থেকে পছন্দের আইসক্রিম, চিপ্‌স বা খেলনা কিনে না দিলেই যে শুধু বাবার সঙ্গে কথা বন্ধ হয়ে যায়, তা নয়। নিজের অপূর্ণ ইচ্ছার বীজ ছেলেমেয়ের মধ্যে রোপণ করতে না পারলেও কিন্তু সম্পর্কের রসায়ন বদলে যেতে পারে। আবার, আদর্শগত কিংবা পেশাগত কারণেও অনেক সময়ে বাবার সঙ্গে সন্তানদের দূরত্ব তৈরি হতে পারে। তেমন উদাহরণ রয়েছে ভূরি ভূরি।

Arun Mukherjee and Sujan Neel Mukherjee

বাবা অরুণ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সুজন মুখোপাধ্যায়।

প্রবীণ নাট্যব্যক্তিত্ব অরুণ মুখোপাধ্যায় এবং অভিনেতা ও নাট্যকার সুজন মুখোপাধ্যায়। শোনা যায়, বাবা-ছেলের মধ্যে নাট্যদল ‘চেতনা’ নিয়ে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল এক সময়ে। সেই সময়ে দলের মূল কান্ডারি অরুণ চেয়েছিলেন, ছোট পুত্র সুজন তাঁদের দল অর্থাৎ, ‘চেতনা’য় অভিনয় করুন। কিন্তু সুজন মন দিয়েছিলেন টেলিভিশনে। তাই বাবার ‘চেতনা’র সঙ্গে কোনও রকম সম্পর্ক ছিল না বহু বছর। সুজন বলেন, “পেশাগত দূরত্ব তৈরি হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু কথা বন্ধ হয়নি কোনও দিন। তবে এ কথা সত্যি যে, শুধু নাটক করলে সেই সময়ে সংসার চালাতে পারতাম না।” আবার, আদর্শগত কারণেও অরুণবাবুর সঙ্গে মনোমালিন্য হয়েছিল ‘চেতনা’র বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্ত সুজনের। সুজনের কথায়, “খুবই সামান্য বিষয়। বাজারের কথা মাথায় রেখে আমি বলেছিলাম, টিকিটের দাম একটু বাড়াতে। বাবা তা চাননি। তা নিয়ে একটু দূরত্ব তৈরি হয়েছিল।” তবে সেই জল দু’জনের কেউই বেশি দূর গড়াতে দেননি। একটু সময় লেগেছিল বটে। সেই দূরত্ব নিজেরাই মিটিয়ে নিয়েছিলেন। এখন বাবা-ছেলে, অর্থাৎ ‘চেতনা’র প্রাক্তন এবং বর্তমান অভিভাবকের মধ্যে দলের ভালমন্দ নিয়ে প্রায়ই কথা হয়।

এ তো গেল বড়দের কথা। ছোটদের ক্ষেত্রেও বিষয়টি ফেলনা নয়। ‘বাবা জানলে বকুনি দেবে’— অনেক সময়ে এই সাধারণ ভয় থেকেও সন্তানের সঙ্গে বাবাদের দূরত্ব তৈরি হয়। সরাসরি বাবাকে বলার চেয়ে মায়ের সাহায্য নিলে হয়তো কাজটি সহজ হয়ে যাবে। এমন ধারণাও কিন্তু সন্তানদের মধ্যে থাকে। মনোবিদ দেবশীলা বসু বলছেন, “এই সমস্যার শিকড় কিন্তু বেশ গভীরে। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে কোনও শিশুই বাবার কাছে খাবার চায় না। আবার বন্ধুর বাড়িতে রাত কাটানোর অনুমতি বাবাকে ছাড়া পাওয়া যায় না। অদৃশ্য এই বিভাজন থেকেও কিন্তু বাবার সঙ্গে ছেলেমেয়েদের দূরত্ব তৈরি হয়।”

বাবার সঙ্গে সন্তানের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হওয়ার নেপথ্যে অনেকগুলি কারণ কাজ করে। এক এক জনের ক্ষেত্রে কারণগুলি এক এক রকম। কোনও ক্ষেত্রে দেখা যায় সন্তান কর্মসূত্রে দীর্ঘ দিন বিদেশে রয়েছেন বলে বাবার সঙ্গে অদ্ভুত ভাবে সম্পর্কের রসায়ন বদলে যায়। আবার, বাড়ির ভিতরে ক্ষমতার হস্তান্তর নিয়েও ছেলের সঙ্গে বাবার মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন, “প্রতিটি সন্তানের সঙ্গে তার বাবার বা মায়ের সম্পর্কের রসায়ন, ইতিহাস আলাদা। তাই দু’জনের মধ্যে যদি কোনও দূরত্ব তৈরি হয়ে থাকে এবং তাই নিয়ে যদি কোনও সমস্যা সৃষ্টি হয়, সে ক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিৎসকের সাহায্য নিতে হবে।” তবে, এই ধরনের সমস্যার কোনও একরৈখিক নিদান হয় না বলেই মনে করেন তিনি।

Advertisement
আরও পড়ুন