
কাশ্মীরে ঘুরতে গিয়েছিলেন। মঙ্গলবার দুপুরের ঠিকানা ছিল কাশ্মীরের ‘মিনি সুইৎজ়ারল্যান্ড’ হিসাবে পরিচিত সবুজে ঢাকা বৈসরন উপত্যকা। জাফরান, আখরোট, আপেলের বাগান আর জঙ্গলে ঢাকা, পাহাড়ে ঘেরা ওই ‘বুগিয়াল’ বসন্ত-গ্রীষ্মের পর্যটন মরসুমে ভিড়ে ঠাসা থাকে। মঙ্গলবার দুপুরেও তার অন্যথা হয়নি। কিন্তু পর্যটকেরা তখনও জানতেন না তাঁদের জন্য কী অপেক্ষা করছে!

ঘোড়ায় চড়ে কিংবা পায়ে হেঁটে পর্যটকেরা নৈসর্গিক দৃশ্য ঘুরে দেখছিলেন। অনেকে আবার স্থানীয় হোম স্টে লাগোয়া ছোট রেস্তোরাঁগুলিতে ভিড় জমিয়েছিলেন ভেলপুরি, পাপড়ি চাটের জন্য। বৈসরন ময়দান ও আশপাশের পাইন বনে ঘোড়সওয়ারি করছিলেন। এমন সময়ই আগমন হল স্বয়ংক্রিয় রাইফেলধারী মৃত্যুদূতদের।

প্রত্যক্ষদর্শী এক পর্যটক জানিয়েছেন, হামলাকারীরা সংখ্যায় ছিল চার থেকে ছ’জন। হঠাৎই তারা রাইফেল উঁচিয়ে এলাকা ঘিরে ফেলে পর্যটকদের এক এক করে পরিচয় জানতে শুরু করে।

একটি নির্দিষ্ট ধর্মের মানুষ ছাড়া বাকিদের উপর নির্বিচারে শুরু হয় গুলিবর্ষণ। ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয় কয়েক জন পর্যটককে। তাদের হাত থেকে বিদেশিরাও বাদ যাননি। পর্যটকদের অনেককেই পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে গুলি করে মারা হয়। পালাতে গিয়ে গুলির শিকার হন অনেকে। শতাধিক রাউন্ড গুলি চালিয়ে জঙ্গলে গা-ঢাকা দেয় জঙ্গিরা।

সেই নৃশংস জঙ্গি হামলায় রক্তাক্ত কাশ্মীরের পহেলগাঁও। অজ্ঞাত বন্দুকধারীদের গুলিতে এখনও পর্যন্ত সেই ঘটনায় ২৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই পর্যটক। আহতও হয়েছেন অনেকে। হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে তাঁদের।

নিহত পর্যটকদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দারাও রয়েছেন। রয়েছেন গুজরাত, মহারাষ্ট্র, কর্নাটক, তামিলনাড়ু এবং ওড়িশার বাসিন্দারাও। পহেলগাঁওয়ে জঙ্গি হামলার ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন বাংলার তিন বাসিন্দা। তাঁদের মধ্যে সমীর গুহ এবং বিতান অধিকারীর বাড়ি কলকাতায়। তৃতীয় জন মণীশরঞ্জন মিশ্র পুরুলিয়ার ঝালদার বাসিন্দা।

সেনাকর্তারা নিশ্চিত করেছেন যে, বৈসরন উপত্যকায় বেড়াতে আসা পর্যটকদের একটি দলকে লক্ষ্য করে এই হামলা চালানো হয়েছে। মর্মান্তিক সেই ঘটনার অনেক ছবি ইতিমধ্যেই প্রকাশ্যে এসেছে।

ছবিগুলিতে দেখা গিয়েছে, রাস্তার বিভিন্ন জায়গায় কী ভাবে নিহত পর্যটকদের রক্ত এবং দেহ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। ছবিগুলি যেন অসহায়তা এবং নৃশংসতার জ্বলন্ত দলিল।

সেই জঙ্গি হামলায় কেউ স্বামীকে হারিয়েছেন, কেউ পুত্রকে! মাত্র কয়েক মিনিটের তাণ্ডবের নেপথ্যে ছিল মাত্র চার থেকে ছ’জন জঙ্গি। তাঁরাই গুলি চালিয়ে খুন করেছেন পর্যটকদের।

স্থানীয় সূত্রে খবর, জঙ্গিদের পরনে ছিল পুলিশের পোশাক। কেউ কেউ আবার সেনার পোশাক পরেও এসেছিল। সকলের হাতে ছিল একে-৪৭। এই ঘটনায় দেশ জুড়ে হইচই পড়ে গিয়েছে। শুরু হয়েছে তদন্ত।

পহেলগাঁওয়ে জঙ্গিহানার জেরে সৌদি আরব সফর কাটছাঁট করে বুধবার সকালে ভারতে পৌঁছোন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। দিল্লি বিমানবন্দরে নেমেই কাশ্মীরের পরিস্থিতি নিয়ে জরুরি বৈঠকে বসেন তিনি।

সেই বৈঠকে ছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল, কেন্দ্রীয় বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এবং অন্য আধিকারিকেরা। মঙ্গলবার রাতে সৌদির রাজার নৈশভোজ অনুষ্ঠানে যোগ না দিয়েই নয়াদিল্লির বিমান ধরেন মোদী।

পহেলগাঁও জঙ্গি হামলার নিন্দায় সরব হয়েছেন দেশের অন্য রাজনৈতির নেতারাও। জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ সেই হামলাকে ‘জঘন্য’ মন্তব্য করে শোকপ্রকাশ করেছেন। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতিও নৃশংসতার নিন্দা করেছেন।

উল্লেখ্য, মঙ্গলবারের জঙ্গি হামলার দায় স্বীকার করেছে ‘দ্য রেজ়িস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (টিআরএফ)। টিআরএফের উত্থান হয় ২০১৯ সালে। তখন সবে সংবিধান থেকে ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপ হয়েছে। জম্মু ও কাশ্মীরের ‘বিশেষ মর্যাদা’র অবলুপ্তি হয়েছে। ঠিক সেই রাজনৈতিক পরিস্থিতির মাঝেই পাক জঙ্গিগোষ্ঠী লশকর-ই-ত্যায়বার ‘ছায়া সংগঠন’ হিসাবে উঠে আসে টিআরএফ।

সেই সংগঠনেরই পাঁচ-ছ’জন আচমকাই মঙ্গলবার দুপুরে পহেলগাঁওয়ে হামলা চালায়। হামলাকারীদের শনাক্ত করতে ইতিমধ্যেই তদন্ত শুরু হয়েছে। অপরাধীদের খুঁজে বার করার লক্ষ্যে নিরাপত্তা বাহিনী ওই অঞ্চলে তাদের অনুসন্ধান অভিযান জোরদার করেছে।
সব ছবি: পিটিআই।