elderly screen time guidelines

টিভি-মোবাইল দেখেই কাটছে সময়! বয়স্কদের ‘স্ক্রিন টাইম’ বৃদ্ধি কী কী সমস্যা ডাকছে, সমাধান কিসে?

সময়ের সঙ্গে বয়স্কের মোবাইল এবং টিভির প্রতি আসক্তি বেড়েছে। পর্দায় কাটানো সময় যত বাড়বে, ততই ক্ষতির আশঙ্কা, জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০২৫ ১০:৩৮
Increasing screen time in elderly individuals may lead to various health issues

বয়স্কদের মধ্যে মোবাইল আসক্তি বাড়ছে। ছবি: সংগৃহীত।

দৃষ্টান্ত ১

Advertisement

ছেলেমেয়েরা থাকেন বিদেশে। বাড়িতে একা সময় কাটাতে এক সময়ে ভরসা ছিল বই। এখন সুমনা রায়ের (নাম পরিবর্তিত) অবসর মানে মূলত মোবাইল ফোন। দিনের মধ্যে ওটিটিতে নানা জিনিস দেখছেন। সঙ্গে সমাজমাধ্যম। রাতে একের পর এক রিল এবং স্বল্প দৈর্ঘ্যের ভিডিয়ো না দেখলে তাঁর ঘুম আসে না।

দৃষ্টান্ত ২

নীলাঞ্জনা দত্তের (নাম পরিবর্তিত) অবসরযাপনের অন্যতম মাধ্যম ইউটিউব। সারা দিন চোখ ফোনের বিভিন্ন ওটিটি অ্যাপে। গভীর রাত পর্যন্ত মোবাইলে বিভিন্ন রান্না এবং বাড়িতে হাতে তৈরি শিল্পকর্মের টিউটোরিয়াল ভিডিয়ো দেখেন।

দৃষ্টান্ত ৩

আশির কোঠা পেরিয়েছেন সঞ্জয় গুপ্ত (নাম পরিবর্তিত)। সুস্থ থাকতে প্রাতর্ভ্রমণ এবং পরিমিত আহার করেন। তবে বিকেল থেকে তাঁর একটাই নেশা— বাংলা ধারাবাহিক। একের পর এক ধারাবাহিক দেখেন। রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি টিভির সামনে।

সমস্যাগুলি অনেকেরই হয়তো পরিচিত। চারপাশে চোখ রাখলে দেখা যাবে, এখন সিংহভাগ পরিবারে বয়স্কদের মোবাইল ‘আসক্তি’ পরিবারের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন সমীক্ষায় দাবি করা হচ্ছে, সময়ের সঙ্গে বয়স্ক নাগরিকদের ‘স্ক্রিন টাইম’ বেড়েছে। চলতি বছরে একটি সমীক্ষায় দাবি করা হয়েছে, গোটা বিশ্বে মানুষ প্রতি দিন গড়ে ৬ ঘণ্টা ৪০ মিনিট মোবাইলে সময় কাটায়, ২০১৩ সালের তুলনায় যা ৩০ মিনিট বৃদ্ধি পেয়েছে। ‘ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান চেম্বার্স অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি’ (এফআইসিসিআই)-এর সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে, মোবাইল ব্যবহার করার ক্ষেত্রে ভারত বিশ্বে চতুর্থ স্থানে রয়েছে। এখানে এক জন নাগরিক প্রতি সপ্তাহে গড়ে প্রায় ৩৪ ঘণ্টা মোবাইলে সময় কাটান। অর্থাৎ, প্রতি দিন এক জন ভারতীয় প্রায় ৫ ঘণ্টা মোবাইল ব্যবহার করেন। ২০২৪ সালের অন্য একটি সমীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে, মোবাইল, ল্যাপটপ এবং টিভি মিলিয়ে এক জন ভারতীয় প্রতি দিন গড়ে ৪ থেকে ৭ ঘণ্টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত সময় কাটান। বয়স্কদের ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান ‘স্ক্রিন টাইম’ একাধিক সমস্যা তৈরি করতে পারে বলেই জানাচ্ছেন, চিকিৎসকেরা।

রাজারহাটের এক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কর্মরত মানালি ঘোষ জানালেন, তাঁর বাবা-মা দিনের মধ্যে অনেকটা সময়ই মোবাইলে কাটান। তিনি বললেন, ‘‘মা-বাবা দু’জনেই সারা ক্ষণ মোবাইলে কিছু না কিছু দেখছেন। কখনও কখনও মনে হয়, তাঁরা এখন বয়সে আমাদের থেকে ছোট! ওটিটি বা সমাজমাধ্যমে ট্রেন্ডিং বিষয়গুলো বাবা-মা আমার থেকে আরও বেশি জানেন।’’ তিনি যোগ করলেন, ‘‘অনেক সময়ে মা ঠিকমতো ঘুমাতে পারেন না। আবার বাবাকেও দেখছি, দীর্ঘ দিনের মর্নিং ওয়াকের অভ্যাসে দাঁড়ি টানতে। কারণ, তখন তিনি হয়তো মন দিয়ে ফোনে কোনও ওয়েব সিরিজ়ের বাকি অংশ দেখতে ব্যস্ত!’’

মোবাইল বা টিভির প্রতি আসক্তি থেকে পরিবারে যে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে, তার প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শহরের এক ব্যবসায়ী জানালেন, বাড়িতে তাঁর ঠাকুরমা সারা ক্ষণ টিভি বা মোবাইলে নানা কনটেন্ট দেখে সময় কাটান। তিনি বললেন, ‘‘বাড়িতে টিভি না চললে বা ইন্টারনেটের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেই ফোন আসে। রিচার্জ করে দিতে হবে। সব সময়েই ঠাকুরমা যেন আতঙ্কে রয়েছেন। যদি আর কনটেন্ট না চলে!’’

কেন মোবাইল নির্ভরতা

বয়স্কদের ক্ষেত্রে মোবাইল আসক্তির নেপথ্যে একাধিক কারণের মধ্যে অনেকেই ‘একাকিত্ব’ কে দায়ী করছেন। বয়সজনিত রোগের চিকিৎসক চিন্ময়কুমার মাইতি। তিনি বলেন, ‘‘স্ক্রিন টাইম বাড়ার ফলে বয়স্কদের ক্ষেত্রে অনিদ্রা এখন একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রচুর রোগী এই সমস্যা নিয়ে আসছেন।’’ অনেক সময়ে মোবাইল বয়স্ক দম্পতির সাংসারিক ঝগড়ার কারণও হয়ে দাঁড়াচ্ছে বলে জানা যাচ্ছে। চিন্ময় বললেন, ‘‘আগে বয়স্করা হাঁটতেন বা সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে দাবা তা তাস খেলতেন। পারস্পরিক আদানপ্রদানের ফলে মনও সুস্থ থাকত। কিন্তু এখন সেখানে কোপ বসিয়েছে টিভি এবং মোবাইল।’’

কী কী সমস্যা হতে পারে?

চক্ষুরোগ চিকিৎসক তনুশ্রী চক্রবর্তী জানালেন, মোবাইল আসক্তির কারণে বয়স্কদের চোখে নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। বয়সের সঙ্গে চোখের রেটিনার কোষের শক্তি কমে আসে। ফলে চোখের জল শুকিয়ে আসে। চোখে জ্বালাভাব দেখা দেয়। আবার অনেকের ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় ধরে ডিজিটাল পর্দায় তাকিয়ে থাকলে চোখ থেকে অনবরত জল কাটতে শুরু করে। রাতে মোবাইলের পর্দায় তাকিয়ে থাকার ফলে অনেক সময়েই ভাল ঘুম আসে না। ফলে দীর্ঘ সময়ের পর অনিদ্রা রোগ দেখা দিতে পারে।

Increasing screen time in elderly individuals may lead to various health issues

স্ক্রিন টাইম বাড়ার ফলে বয়স্কদের নানা সমস্যায় ভুগতে হচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত।

বয়সের সঙ্গে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতাও ধীর গতিতে হয়। বেশি ক্ষণ মোবাইল ব্যবহার করার ফলে বয়স্কদের চিন্তাশক্তি বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা প্রভাবিত হতে পারে। মোবাইলে অনেকেই ‘মাল্টি টাক্সিং’ (একসঙ্গে একাধিক কাজ) করে থাকেন। ক্রমাগত একাধিক ট্যাব, পপ আপ এবং নোটিফিকেশন কোনও নির্দিষ্ট কাজের একাগ্রতা নষ্ট করতে পারে। তনুশ্রীর কথায়, ‘‘মোবাইলের ছোট্ট পর্দায় উজ্জ্বল আলো এবং ছোট হরফ চোখের উপর চাপ সৃষ্টি করে। তুলনায় টিভি বা ল্যাপটপে ক্ষতির আশঙ্কা কিছুটা কম। কিন্তু তার মানে কেউ ঘণ্টার পর ঘণ্টা টিভি বা ল্যাপটপে সময় কাটাচ্ছেন, সেটাও ঠিক নয়।’’

স্ক্রিন টাইম কমানোর উপায়

তনুশ্রীর মতে, মোবাইল-পূর্ব যুগে বাড়িতে বয়স্করা অবসর যাপনের জন্য নানা উপায় অবলম্বন করতেন। তিনি বললেন, ‘‘মোবাইল ছাড়া বই পড়া বা বাগান করার মতো অন্য কোনও উপায়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখা যেতে পারে।’’ রাত্রে ঘুমোনোর আগে মোবাইল থেকে নিজে দূরে রাখার চেষ্টা করতে হবে। তনুশ্রীর কথায়, ‘‘দিনের মধ্যে কত ক্ষণ মোবাইল বা টিভি দেখবেন, সেটা ঠিক করে নেওয়া উচিত। তা হলে খেয়াল থাকবে।’’ স্ক্রিন টাইম কমানোর জন্য এখন স্মার্ট ফোনে বিশেষ ফিচার দেওয়া হয়েছে।

বয়স্কদের ক্ষেত্রে সারা দিনে আদর্শ স্ক্রিন টাইম কত ক্ষণ হওয়া উচিত, তা নিয়ে কোনও নির্দিষ্ট নির্দেশিকা নেই। তবে চিকিৎসকদের একাংশ মনে করছেন, সারা দিনে ২-৩ ঘণ্টার বেশি পর্দায় চোখ রাখা উচিত নয়। সে ক্ষেত্রেও ৩০ মিনিট থেকে প্রতি ১ ঘণ্টা অন্তর বিরতি নিতে পারলে ভাল হয়।

Advertisement
আরও পড়ুন