তুর্কি মেনুতে কতটা তৃপ্ত বাঙালির রসনা? —নিজস্ব চিত্র।
ধবধবে সাদা চতুষ্কোণে ঈষৎ সাদা ক্রিমের মতো স্তর। চামচ দিয়ে মুখে তুলতেই বেমালুম মিলিয়ে গেল। হালকা মিষ্টি, সঙ্গে নারকেলের স্বাদ। পোশাকি নাম সুলতান লোকমু। আদতে তুরস্কের প্রাচীন এক মিষ্টি জাতীয় পদ। সেই খাবারই এখন কলকাতায়!
সুলতান লোকমু থেকে রকমারি বকলাভা, ইস্তানবুলের তোপকাপি প্যালেসের সুলতান-হেঁশেলের এক সময়ের খাবারেই ইদানীং মন মজেছে কলকাতাবাসীর।
অতীত সাক্ষী, যে কোনও খাদ্যই আপন করে নিতে সময় নেয় না কলকাতা। সে সাহেবদের চপ-কাটলেট হোক বা মোগলদের বিরিয়ানি। বো ব্যরাকের কেক থেকে পার্সি ধনশাক কিংবা অওধি খানা, উদরপূর্তিতে বাদ নেই কোনওটিই।
সেই কলকাতা যে হাতের কাছে পেলে তুরস্কের খাবারকেও আপন করে নিতে পারে, তাতে আর সন্দেহ কী! সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে তুরস্ক যেতে না পারলেও মুঠোফোনের এক ক্লিকে এখন ঘরে বসেই মিলছে ‘মটন অওয়জি’ থেকে ‘সীস তাভুকের’ স্বাদ। উপহারে রসগোল্লা, সন্দেশের বদলে বাক্সবন্দি করে পৌঁছচ্ছে বকলাভা, বাসবুসা, মামুল কুকিজ।
সময় বদলেছে, এগিয়েছে যুগ। ওই যে শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন, ‘এ কলকাতার মধ্যে আছে আর একটা কলকাতা।’ এ যেন নতুন এক কলকাতা। যেখানে লেগেছে বিশ্বায়নের ছোঁয়া। তার হাত ধরেই পশ্চিম এশিয়ার বহু দেশের খাবার ঢুকে পড়েছে তিলোত্তমার অন্দরে।
কলকাতায় তুরস্কের মিষ্টি
রসগোল্লা থেকে সন্দেশের জন্য জগৎজোড়া খ্যাতি যে কলকাতার, সেখানে প্রথম বার পুরোটাই তুরস্কের মিষ্টি ও ডেজার্ট দিয়ে দোকান খুলেছিলেন বৎসল আগরওয়াল। ২০১৮ সালে কলকাতায় পথচলা শুরু হয় ‘দ্য বকলাভা বক্স’-এর। তুরস্কের বিখ্যাত মিষ্টি ‘বকলাভা’-র নামেই দোকান।
পাতলা ফিনফিনে ফিলো একটার পর একটা সাজিয়ে, স্তরে স্তরে পেস্তার কুচি দিয়ে বেক করে এই মিষ্টি তৈরি হয়। দেওয়া হয়, মধু ও চিনির রস। এর নামই বকলাভা।
এই বকলাভার জন্ম কোথায় এবং কী ভাবে, তা নিয়ে নানা মত আছে। তবে তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যে, সুলতানের তোপকাপি প্রাসাদেই যে বকলাভা খাওয়ার চল ছিল, তা নিয়ে দ্বিমত নেই।
‘দ্য বকলাভা বক্স’-এর মালিক বৎসল আগরওয়াল জানালেন, তিনি নিজে একাধিক বার তুরস্ক ও পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন দেশে গিয়েছেন। সেখানেই বিভিন্ন রকমের মিষ্টি খাবার চেখে তাঁর মনে হয়েছিল, মিষ্টিপ্রেমী বাংলায় কেন এমন খাবার হতে পারে না? এখানে এখন বকলাভাই মিলছে ৩০-৪০ রকমের। রয়েছে নানা রকম কুকিজ়, চকোলেটও। সব মিলিয়ে তুরস্কের ২০০-র বেশি মিষ্টি খাবার পাওয়া যায় কাঁকুরগাছির দোকানটিতে।
প্রশ্ন আসে, তুরস্কের স্বাদ সত্যি কি কলকাতায় পাওয়া সম্ভব? জানা গেল, শেফ এসেছেন খাস তুরস্ক থেকে। সেখানকার স্বাদ-গন্ধই তুলে ধরার চেষ্টা হয়েছে। বৎসল বললেন, ‘‘শুরুর দিকে লোকে নামই জানতেন না। কোভিডের সময়ে অনলাইনে বিক্রি শুরু করেছিলাম। এখন ভারতের সব বড় শহরেই আমাদের মিষ্টির চাহিদা। কলকাতার মানুষও এখন মিষ্টির স্বাদ পেতে দোকানে ভিড় করছেন। অনুষ্ঠানে উপহার হিসাবে দিচ্ছেন রকমারি মিষ্টি বকলাভা, বাসবুসা থেকে কুকিজ় ।ফিঙ্গার ও পিরামিড বকলাভা সবেচেয়ে বেশি পছন্দ করছেন।’’
তুরস্কের মিষ্টি মিলছে কলকাতার অন্য প্রান্তেও। ২০২২ সালে খুলেছে ‘টার্কিস্ক’। শুরুটা করেছেন এক ‘তরুণ তুর্কি’। সাউথ সিটি-র কাছেই একটি দোকানের পাশাপাশি লেক মলে রয়েছে আরও একটি দোকান। সেখানেই থরে থরে সাজানো রকমারি খাবার। কোনওটি চতুষ্কোণ, কোনওটি পাখির বাসার মতো, কোনওটি রোল, আবার কোনওটি আঙুলের মতো। এক পাশে রকমারি চকোলেট, অন্য পাশে কুকিজ়। দেখলেই মনে হয়, চেখে দেখা যাক। এই সব কুকিজ়, চকোলেট ও মিষ্টির সঙ্গে গত কয়েক বছরে কিছুটা হলেও পরিচিত হয়েছে কলকাতা। অনেকে এসেই কর্মীদের কাছে জানতে চাইছেন মিষ্টির বিবরণ। কিনছেনও।
আসলে কলকাতার ছানার মিষ্টির চেয়ে একেবারেই ভিন্ন স্বাদের এই সব মিষ্টি। যেমন, স্কোয়্যার বকলাভা। হালকা মিষ্টির সঙ্গে মুচমুচে ভাব। কামড় বসালেই জিভে ঠেকে পেস্তার কুচি। পিস্তা বুলবুল নেস্ট থেকে ফিঙ্গার, কাজু স্কোয়্যার, কাজু বুলবুল নেস্ট। এই যে এত রকমের বকলাভা, এরা কি আকারেই আলাদা, না কি স্বাদেও! প্রশ্ন শুনে টার্কিস্কের মালিক আদিত্য বিক্রম সাহা বললেন, ‘‘প্রতিটি বকলাভা তৈরির পদ্ধতি ও স্বাদ আলাদা। কোনওটিতে ফিলোর স্তর বেশি, কোনওটিতে রয়েছে পেস্তার কুচি, কোনওটি কাজুর। কোনওটি বেশি রসালো, কোনওটি একটু বেশি মুচমুচে। কোথাও আবার মালাইয়ের স্তর দেওয়া হচ্ছে। সবটাই বেকড।’’ বাসবুসা, রুমুস, মামুল কুকিজ-সহ এখানে মেলে রকমারি মিষ্টি। কোনওটি সুজি ও নারকেলের, কোনওটির ভিতরে থাকে খেজুরের পুর।
কলকাতাবাসী কতটা পছন্দ করছে তুরস্কের মিষ্টি? আদিত্য বললেন, ‘‘সাড়া বেশ ভালই। প্রথম দিকে মানুষ সে ভাবে নাম না জানলেও এখন চাহিদা অনেকটাই বেড়েছে। অনলাইনেও লোকজন কিনছেন। বিশেষত দীপাবলি, ইদের মতো অনুষ্ঠানে মিষ্টি, চকোলেট, কুকিজ়ের বাক্স উপহার হিসাবে দিচ্ছেন অনেকেই।’’
তুরস্কের রান্না
তুরস্কের কবাব থেকে রকমারি খাবারের খ্যাতিও কিন্তু কম নয়। কলকাতার কোথায় তুরস্কের খাবার মেলে, ‘গুগল’ বাবাজিকে প্রশ্ন করলে শুরুতেই নাম আসে ‘কবিরস্’-এর। চাঁদনি চক মেট্রো স্টেশন থেকে বেরিয়ে গণেশচন্দ্র অ্যাভিনিউয়ের উপরেই ছিমছাম রেস্তরাঁ। ঢোকার মুখে কাচের শো-কেসে সাজানো রকমারি মিষ্টি পদ। ‘সুলতান লোকমু’, ‘সির ক্ষুরমা’, ‘বকলাভা রোল’ থেকে রকমারি পদ। মেনু টেনে নিয়ে পড়তে গেলে দাঁত ভাঙার জোগাড় হয়। ‘মটন মনীশা কেবাপ’, ‘তাভুক চিজ কেবাপ’, ‘তাভুক সিস কেবাপ’, ‘ব্যাগেট’, ‘মটন অওজি রাইস’, ‘মটন আদানা কেবাপ ইয়েমেক’ তালিকা অনেক দীর্ঘ। এই খাবারই এখন হাত চেটে খাচ্ছে কলকাতার বাঙালি। মধ্যমগ্রামের বাসিন্দা শর্মিষ্ঠা বসু দত্ত দিন কয়েক আগেই এই রেস্তরাঁয় গিয়ে খেয়ে এসেছেন চিকেন কেপসা রাইস, মটন টেস্টি। বলছিলেন, ‘‘তুরস্কের খাবারের প্রতি প্রেম আমার ম্যাগনিফেসন্ট সেঞ্চুরি নামে তুরস্কের ঐতিহাসিক সিরিজ় দেখে। ইস্তানবুলের তোপকাপি প্যালেসে সুলতানকে নানা রকম খাবার পরিবেশন করা হত। সিরিজ়েই বেশ কয়েকটি খাবারের নাম শুনি ও দেখি। ইস্তানবুল, সেখানকার খাবার সম্পর্কে আগ্রহ থেকেই এই রেস্তরাঁয় আসা।’’ নতুন ধরনের খাবার খেয়ে খুব খুশি তিনি। জানালেন, অন্যান্য খাবার চেখে দেখতে আবার আসবেন।
কলকাতার রেস্তরাঁয় তুরস্কের রান্না! ভারতীয় খাবার, ‘কবিরস্-এর মেনুতে থাকলেও এখানে তুরস্কের রকমারি খাবার খেতেই লোকে আসেন। জানা গেল, ‘তাভুক’ হল মুরগির মাংস। তা দিয়ে তৈরি নানা ধরনের কবাব বেশ জনপ্রিয়। এই যেমন সিস কবাব। এক সময়ে সৈনিকেরা তরোয়ালের ফলায় মাংস গেঁথে পুড়িয়ে তা খেতেন। সময়ের বদলে তুরস্কের রাজধানী ইস্তানবুলে এখন কাঠিতে বা স্কিউয়ারে গেঁথে সেই খাবার তৈরি করা হয়। সে ভাবেই কলকাতাতেও পরিবেশন হয়।
রেস্তরাঁর মেনুতে পদের নাম দেখে যে হেতু খাবার বোঝা সম্ভব নয়, তাই প্রতিটি পদের নীচে ছোট্ট বিবরণ দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। জানতে চাইলে বুঝিয়েও দিচ্ছেন কর্মীরা। এই যেমন মটন মনীশা কবাব, মটন আলনাজিক কবাব। দু’টিই মটন কিমা দিয়ে তৈরি হলেও প্রথমটি পরিবেশন করা হয় এক ধরনের রুটি, বার্বিকিউ স্যালাড দিয়ে। আলনাজিক কবাবে ব্যবহার করা হয় টক দই ও বেগুন। দই বেগুনের স্তরের উপর মটন কিমা থাকে।
রেস্তরাঁরকর্মী ও ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ভোজনরসিক বাঙালিকে নতুনত্বের স্বাদ এনে দিতেই তুরস্কের খাবার মেনুতে রাখার ভাবনা। ‘তাভুক চিজ কেবাপ’, ‘ইয়েমেক’-সহ ‘বাকলাভা’, ‘লোকমু’ লোকে খুব পছন্দ করে। রেস্তরাঁ তো বটেই, অনলাইনেও ক্রমশ বিক্রি বাড়ছে। লোকে জানতে চাইছেন কোন খাবার কেমন। যেমন ইয়েমেক, কিছুটা ইরানি চেলো কবাবের সঙ্গে মিল রয়েছে। তবে স্বাদ অলাদা। রাইস, কাবাব, ডিমের পোচ ও সব্জির একটি পদ দিয়ে এটা পরিবেশন করা হয়। মটন টেস্টি খুব ধীরে দীর্ঘ ক্ষণ ধরে রান্না করা হয়।
কেন তুরস্কের খাবার নিয়ে উৎসাহ?
বছর দুই আগে সমাজমাধ্যমের একটি খাবারের গ্রুপে ‘কবিরস্’–এর কথা শুনে, খাবারের ছবি দেখে রেস্তরাঁয় গিয়েছিলেন কল্যাণীর শান্তনু ঘোষ। জানালেন, তিনি এমনিতেই খাদ্যরসিক। ইস্তানবুল গিয়ে তো আর খাওয়া যাবে না। তাই নতুন স্বাদের, নতুন পদের কথা শুনে এসেছিলেন। ইয়েমেক, কবাব, লোকমু ভালই লেগেছিল।
সমাজমাধ্যমে লেখালিখি থেকেই তুরস্কের মিষ্টির কথা জেনেছিলেন নমামি চক্রবর্তী। লোকজনের বর্ণনা শুনে মিষ্টি চেখে দেখার ইচ্ছাও ছিল। পরে তাঁরই এক আত্মীয় বাকলাভা বক্স উপহার দিয়েছিলেন। নমামি বললেন, ‘‘মিষ্টির স্বাদ অন্য রকম। মিষ্টিও অতিরিক্ত নয়। ভালই।’’
আসলে খাদ্যপ্রেমী বাঙালি সব সময়েই নতুন স্বাদের খোঁজে থাকে। তেমন কিছুর সন্ধান পেলে চেখে দেখার লোভ সামলাতে পারেন না অনেকেই। তা থেকেই ক্রমশ চর্চায় উঠে আসছে ‘তুর্কি মেনু’। এক জনের কাছে খাবারের নাম ও প্রশংসা শুনে ভোজনরসিক কলকাতাবাসীও নতুন স্বাদ আস্বাদনে ছুটছে। কারও লাগছে ভাল। কেউ আবার কৌতূহল বশে গিয়ে কিছু খেয়ে আসছেন। কলকাতায় তুরস্কের খাবার আগে যে একেবারেই মিলত না, তা নয়। তবে পুরোপুরি তুরস্কের খাবারকেই প্রাধান্য দিয়ে রেস্তরাঁ বা দোকান হাতেগোনা। স্বাদ, পছন্দ বদলাচ্ছে বলেই ভাবনাও বদলাচ্ছে। টার্কিস্কের আদিত্যই জানালেন, আগামী দিনে আরও তিনটি দোকান খুলতে চলেছেন তাঁরা।