গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
শরীর-মন ভাল রাখতে যোগব্যায়াম জরুরি। ব্যস্ত জীবনে ক্রমশ গুরুত্ব বাড়ছে শরীরচর্চার। একই সঙ্গে প্রশ্ন উঠছে, শরীরচর্চার সেই সময়টা কোথায়? কর্পোরেট কর্মজীবন অনেকেরই জীবনের ঘড়িটাকে উল্টে দিয়েছে।
অনেকে বলেন, শরীরচর্চা করার সবচেয়ে ভাল সময় ভোরবেলা। এ দিকে মধ্যরাত পর্যন্ত কাজ করতে হয় অনেক কর্মব্যস্ত মানুষকেই। তার পর কি শরীর ভাল রাখতে ভোর পাঁচটায় ওঠা সম্ভব? সবচেয়ে বড় কথা, এতে আদৌ কি শরীরের ভাল হয়!
কোভিড পরিস্থিতি আমরা পেরিয়ে এসেছি ঠিকই, তবে সেই সময়ের কিছু বদল এখনও আমাদের জীবনের সঙ্গী। যেমন, অনলাইন ক্লাস। শুধু পড়াশোনা নয়, রান্না থেকে ব্যবসা, এমনকি যোগাসন প্রশিক্ষণের ক্লাসও হচ্ছে অনলাইনে।
অনেক সময় বেলার দিকে বা দুপুরের পরে একটু ফাঁকা সময় পেয়ে তখনই শরীরচর্চা করতে চাইছেন অনেকে। আদৌ সেটা ঠিক তো?
যোগসাধনার প্রাচীন রীতি বলছে, সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের সময়ই যোগাসনের পক্ষে আদর্শ। রাত থেকে ভোর এবং বিকেল থেকে সন্ধের এই সন্ধিক্ষণেই শরীর, মন কিছুটা শান্ত থাকে। কিন্তু ব্যস্তজীবনে ভোর ও সন্ধে ছাড়াও যোগ্যাভ্যাস করা যায় কি? প্রশ্ন আরও। সেই যোগব্যায়ামে আদৌ কি শরীর ও মনের সংযোগ স্থাপিত হয়, না কি হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা থাকে?
উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবিটিস, বিপাকহারজনিত সমস্যা কিংবা অস্থিসন্ধির ব্যথার মতো জীবনধারার সঙ্গে যুক্ত নানাবিধ রোগের সঙ্গে লড়াই করতে নতুন করে যোগচর্চার গুরুত্ব বেড়েছে। যোগব্যায়ামের পাশাপাশি প্রাণায়ামের অভ্যাসে ব্যস্তজীবনে একটু শান্তির খোঁজ করছে মানুষ। কারও লক্ষ্য, ওজন কমানো, কারও আবার সুস্থ থাকা। কেউ আবার যোগাসন করছেন শরীরের বিশেষ কোনও কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে।
এখন সময় মেপে চলেন অধিকাংশ মানুষ। তবু চাকরি করতে গিয়ে রাত বা দিনের হিসেব তাঁদের গুলিয়ে যায়। তার উপর দীর্ঘ ক্ষণ কম্পিউটারের সামনে বসে কাজ করায় অল্প বয়সে মাথাধরা, কোমরে ব্যথা, ঘাড়ের যন্ত্রণার সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মানসিক চাপ, ক্লান্তি, উদ্বেগও। দৈনন্দিন জীবনে সুস্থ থাকতে তাই অনেকেই যোগাসন করতে শুরু করছেন।
তবে শুধু শরীর ভাল রাখাই নয়, ত্বক থেকে চুলের স্বাস্থ্য ফেরাতে, প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যেঙ্গের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করার জন্য বিভিন্ন রকমের যোগাসন করতে আগ্রহী হচ্ছেন অনেকেই।
নিছক সমস্যার সমাধান করতে নয়, অনেকেই যোগব্যায়াম করেন যোগসাধনার প্রেমে পড়ে। যদিও সেই সংখ্যা হাতেগোনা। তবে নিয়মিত যাঁরা যোগাসন করেন, তাঁরা বলেন, যোগের দীর্ঘ অভ্যাসে মনোজগতে যে শান্তি আসে, সেই প্রশান্তি তাঁদের যোগাসন করতে উদ্বুদ্ধ করে।
ভোর ও সন্ধের মুহূর্তে যোগচর্চার রীতি প্রাচীন কাল থেকেই চলে আসছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, যিনি গভীর রাত পর্যন্ত জেগে অফিসের কাজ করছেন, তিনিই আবার ভোর পাঁচটায় উঠে যোগ্যাভ্যাস করবেন কী করে? সন্ধেয় হয়তো তাঁর হাতে অন্য কাজ। তাই মাহেন্দ্রক্ষণে যোগচর্চা করা যাবে না বলে কি তিনি যোগব্যায়াম করবেনই না!
দীর্ঘ দিন ধরে যোগচর্চা করেন মধুরিয়া রায়। নিজের শারীরিক কিছু সমস্যার সমাধান করতে গিয়েই যোগচর্চার প্রতি উৎসাহ জন্মায় তাঁর। একের পর এক ‘কোর্স’ করে এখন তিনি রীতিমতো দক্ষ যোগ প্রশিক্ষক হয়ে উঠেছেন। প্রায় গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন তাঁর ছাত্র এবং ছাত্রী। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আসে, যে হেতু ভারতের সঙ্গে অন্য দেশের সময়ের ফারাক রয়েছে, তা হলে কি দিনের বেলা বা বেলার দিকেও ক্লাস করান তিনি? সকাল ও সন্ধে ছাড়া অন্য সময় তা হলে যোগাভ্যাস করা যায়? ‘‘সূর্য উঠে গেলে, বেলা বেড়ে গেলে কখনও যোগাভ্যাস করা উচিত নয়’’, বলছেন মধুরিয়া। তাঁর কথায়, ‘‘দেহের নিজস্ব ঘড়ি অনুযায়ী সূর্য যখন মধ্যগগনে, শরীর তখন স্বাভাবিক ভাবেই সক্রিয় থাকে। তাই সেই সময় ব্যায়াম করলে, রক্তপ্রবাহ আরও বেড়ে যেতে পারে। আমি বাইরের দেশের জন্যেও এমন সময় বেছে নিই, যখন সেখানে বিকেল।’’
কিন্তু কর্পোরেট সেক্টর? সেখানে তো কেবলই ব্যস্ততা। বেলার দিকে কাজের ফাঁকে যদি কেউ আলাদা কোনও ঘরে গিয়ে আসন বা প্রাণায়ম করতে পারেন, তেমন কি হতে পারে? কর্পোরেটদের জন্য সেশন একেবারেই আলাদা বলে জানালেন তিনি। মধুরিয়া বললেন, ‘‘বেলার দিকে সেশন হলে, সেখানে সাধারণত শরীরের সমস্যা অনুযায়ী বিশেষ কিছু ভঙ্গি অভ্যাস করানো হয়। রক্তচাপ বৃদ্ধি পেতে পারে, এমন কোনও আসনই সেই সময়ে আমরা করাই না। সকাল ও বিকেলের আসনেও কিন্তু ফারাক থাকে।’’
শরীর অনেকটা যন্ত্রের মতো। দিনের শুরুতে কোনও যন্ত্রই একেবারে সাবলীল ভাবে কাজ করতে পারে না। তাকে আগে থিতু হতে হয়। গরম হতে হয়। মধুরিয়ার কথায়, ‘‘সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর শরীর খানিকটা ঝিমিয়ে থাকে। ধীরে ধীরে শরীরকে সক্রিয় করে তুলতে হয়। আবার, সন্ধ্যায় যোগাসন করলে শরীরকে ততটা ঝক্কি পোহাতে হয় না।’’
দুপুরের দিকে যোগাসন যে একেবারেই করা যায় না, তেমনটা অবশ্য বলছেন না চিকিৎসক সুবর্ণ গোস্বামী। মধুরিয়ার মতো সুবর্ণ গোস্বামীও স্পষ্ট করে দিচ্ছেন, ভরাপেটে যোগব্যায়াম হয় না। খাওয়ার অন্তত ২-৩ ঘণ্টা পর ব্যায়াম করা যেতে পারে। পাশপাশি সুবর্ণ গোস্বমী বলছেন, ‘‘গরমের দিনে দুপুরে ঘরে এসি না থাকলে একেবারেই শারীরিক কসরত করা উচিত নয়। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। প্রবল গরমে শরীরচর্চা করতে গিয়ে হিট স্ট্রোক হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এমন ঘটনা ঘটছেও। সব ধরনের যোগব্যায়াম সকলে করতে পারেন না। এক এক জনের শরীরের ক্ষমতা এক এক রকম। সেই অনুযায়ী কোন ব্যায়াম, কত ক্ষণ করবেন, সেটি যেন প্রশিক্ষকের নির্দেশ অনুযায়ী করা হয়।’’
সকালেই যোগাভ্যাস করা সবচেয়ে ভাল, বলছেন পুষ্টিবিদ পম্পিতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কারণ, ভরাপেটে শরীরচর্চা করা যায় না। সে ক্ষেত্রে দুপুরে যোগব্যায়াম করার পক্ষপাতী তিনি নন। তবে পম্পিতা বলেন, ‘‘একান্তই কেউ দুপুরের কোনও সময় যোগাসন করতে চাইলে তাঁকে হালকা খাবার খেতে হবে। নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধান মেনে চলতে হবে। এ ভাবে দিনের মাঝে কোনও একটি সময় ব্যায়াম করলেই যে উপকার পাওয়া যাবে, তেমনটা কিন্তু নয়। কেন যোগাভ্যাস করছেন, সেটি বুঝে সেই অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট সময় ঠিক করে নেওয়াই ভাল।’’
চিকিৎসক, যোগ প্রশিক্ষক ও পুষ্টিবিদ্ সকলের কথাতেই স্পষ্ট, সকাল ও বিকেলই যোগাভ্যাসের জন্য উপযুক্ত সময়। বর্তমান কর্মসংস্কৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে যদি দিনের অন্যান্য সময়ে যোগব্যায়াম করতেই হয় সে ক্ষেত্রে কার শরীর কী ভাবে প্রতিক্রিয়া করছে, তা বোঝাটা খুব জরুরি। মানতে হবে অন্যান্য শর্তও।