জ্যোতিরাদিত্য শিন্ডে এবং শিবরাজ সিংহ চৌহান (ডান দিকে)। ছবি: পিটিআই।
মধ্যপ্রদেশে বিজেপির জয় স্পষ্ট হতেই প্রচারের সব আলো শুষে নিচ্ছেন রাজ্যের বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহান, যিনি রাজ্য রাজনীতিতে ‘মামা’ নামে পরিচিত। তবে বিজেপির এই ‘অভাবনীয়’ সাফল্যের নেপথ্যে গোয়ালিয়রের মহারাজ জ্যোতিরাদিত্য শিন্ডেকেও কৃতিত্ব দিতে চাইছেন কেউ কেউ। ২০২০ সালের মার্চ মাসে অনুগত বিধায়কদের নিয়ে বিজেপিতে যোগ দিয়ে রাজ্যের কংগ্রেস সরকারের পতনের কারণ হয়েছিলেন তিনি। সে অর্থে বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর এটাই ছিল তাঁর প্রথম নির্বাচনী পরীক্ষা। নতুন দলে গিয়ে জ্যোতিরাদিত্য নিজের গড় ধরে রাখতে পারবেন কি না, তা নিয়ে বিজেপির অন্দরেই সংশয় ছিল। তবে ভোটের ফল বলছে, রাজ্য রাজনীতিতে নিজের গ্রহণযোগ্যতা ধরে রাখতে সফল ‘মহারাজ’।
কেবল নিজের প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখাই নয়, মধ্যপ্রদেশের রাজ্য রাজনীতিতে গোয়ালিয়র রাজপরিবার যে একটি বড় ভূমিকা রাখে, তা প্রমাণ করারও দায় ছিল জ্যোতিরাদিত্যের। এ যাত্রায় নিজের পরিবারেরও মান বাঁচাতে সফল কেন্দ্রীয় অসামরিক বিমান পরিবহণ মন্ত্রী। মধ্যপ্রদেশে গোয়ালিয়র-চম্বল অঞ্চলের রাজনীতি বেশ কয়েক ধরেই নিয়ন্ত্রণ করে জ্যোতিরাদিত্যদের পরিবার। ওই অঞ্চলে মোট ৩৪টি বিধানসভা আসন রয়েছে। ভোটের ফলাফল বলছে, ওই আসনগুলির মধ্যে ২০টি আসনেই এগিয়ে রয়েছে বিজেপি। কংগ্রেস এগিয়ে ১৩টি আসনে। আর মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি (বিএসপি) এগিয়ে একটি আসনে। নিজের এবং দলের সাফল্যের বিষয়টি স্পষ্ট হতেই আক্রমণের জবাব ফিরিয়ে দিয়েছেন জ্যোতিরাদিত্য। মধ্যপ্রদেশে ভোটপ্রচারে এসে জ্যোতিরাদিত্যের নাম না করেই তাঁকে ‘আকারে বামন কিন্তু ঔদ্ধত্যে লম্বা’ বলে কটাক্ষ করেছিলেন কংগ্রেসের প্রিয়ঙ্কা গান্ধী। শনিবার জ্যোতিরাদিত্য কটাক্ষের জবাব ফিরিয়ে দিয়ে বলেন, “গোয়ালিয়রের মানুষ বুঝিয়ে দিয়েছেন, কারা বামন আর কারা লম্বা।”
২০১৮ সালের বিধানসভা ভোটের সঙ্গে তুল্যমূল্য বিচার করলে দেখা যাবে, ওই ৩৪টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস জিতেছিল ২৬টি আসনে। বিজেপি জিতেছিল মাত্র সাতটি আসনে। রাজ্যে বিজেপিকে হারিয়ে স্বল্প ব্যবধানের জয়ে (২৩০ আসনের বিধানসভায় কংগ্রেস জিতেছিল ১১৪টি আসনে, বিজেপি ১০৯টিতে) জ্যোতিরাদিত্যের গোয়ালিয়র-চম্বল অঞ্চল যে বড় ভূমিকা রেখেছিল, তা স্বীকার করে নিয়েছিলেন কংগ্রেস নেতারা। কিন্তু প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি তথা রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী কমল নাথের সঙ্গে মতান্তরের জেরে ২২ জন অনুগত বিধায়ককে নিয়ে কংগ্রেস ছেড়েছিলেন জ্যোতিরাদিত্য। ওই কংগ্রেসত্যাগী ২২ জনের মধ্যে ১৬ জনই ছিলেন গোয়ালিয়র-চম্বল অঞ্চলের বিধায়ক। পরে উপনির্বাচন হলে দলের নিচুতলার আপত্তি উপেক্ষা করেই প্রত্যেককে টিকিট দিয়েছিলেন বিজেপি নেতৃত্ব। কংগ্রেস বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ তুললেও জ্যোতিরাদিত্য-ঘনিষ্ঠ ৯ জন পদ্ম প্রতীকে জিতে এসেছিলেন। ওই অঞ্চলে বিজেপির আসনসংখ্যা ১৬-তে পৌঁছেছিল।
আরও একটু পিছনে হাঁটলে দেখা যাবে, ২০১৮ সালের সাফল্য মাত্র ছ’মাসের ব্যবধানেই খুইয়ে ফেলেন জ্যোতিরাদিত্য। ‘রাজপরিবারের গড়’ গুনা লোকসভা কেন্দ্রে সওয়া এক লক্ষেরও বেশি ভোটে বিজেপি প্রার্থীর কাছে হেরে যান তিনি। তখনও অবশ্য তিনি কংগ্রেসে। রাজপরিবারের পুরনো রাজনৈতিক প্রভাব অক্ষুণ্ণ রয়েছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। তবে এ বারের ভোটের ফলাফল বলছে, গুনা লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত আটটি বিধানসভার মধ্যে পাঁচটিতেই এগিয়ে রয়েছে বিজেপি। তিনটিতে এগিয়ে কংগ্রেস। লোকসভায় এই ফলাফলের পুনরাবৃত্তি হলে গুনা নিয়ে আত্মবিশ্বাসী থাকতে পারেন জ্যোতিরাদিত্য।
রাজরক্ত, রাজনৈতিক উত্তরাধিকার, সুদর্শন চেহারা নিয়েও গোড়া থেকেই মুখ্যমন্ত্রিত্বের দৌড়ে নাম লেখাতে চাননি জ্যোতিরাদিত্য। অন্তত প্রকাশ্যে তেমনটাই দাবি করেছেন। প্রতিটি নির্বাচনী সভায় নিজেকে দলের ‘সেবক’ বলে পরিচয় দিয়ে জানিয়েছেন, তিনি মুখ্যমন্ত্রী হতে চান না। তবে কি লোকসভা ভোটকেই ‘পাখির’ চোখ করছেন মহারাজ? তার উত্তর কয়েক দিন পর পাওয়া যাবে। যখন মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর নাম চূড়ান্ত হয়ে যাবে।
কংগ্রেস অবশ্য এই কয়েক দিন আগে পর্যন্তও গোয়ালিয়র রাজপরিবারের ‘বিশ্বাসঘাতকতা’র ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। কংগ্রেসে রাজনৈতিক জীবন শুরু করেও কী ভাবে রাজমাতা বিজয়রাজে শিন্ডে (জ্যোতিরাদিত্যের ঠাকুমা) অনুগত বিধায়কদের নিয়ে কংগ্রেস ছেড়ে রাজ্যের ক্ষমতাসীন সরকারকে ফেলে দিয়েছিলেন, সে কথা বারংবার উল্লেখ করেছেন কংগ্রেস নেতারা। ইতিহাস অবশ্য বলছে, বার বার নিজেদের রাজনৈতিক আনুগত্য বদলেছে জ্যোতিরাদিত্যের পরিবার। জ্যোতিরাদিত্যের পিতা, প্রয়াত মাধবরাও সিন্ধিয়া মা বিজয়রাজের কথায় জনসংঘ (বিজেপির পূর্বসুরি)-এ যোগ দিলেও পরে রাজনৈতিক পথবদল করে কংগ্রেসে যোগ দেন। মাঝের কয়েক বছরের বিরতি বাদ দিয়ে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কংগ্রেসেই ছিলেন মাধবরাও। জ্যোতিরাদিত্য রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বাবার পদাঙ্কই অনুসরণ করে কংগ্রেসে যোগ দেন। ২০১৯ পর্যন্ত বাবার লোকসভা কেন্দ্র গুনার সাংসদ ছিলেন তিনি। তার পর অবশ্য ঠাকুমার মতোই অনুগত বিধায়কদের নিয়ে দল ছাড়েন তিনি। ঠাকুমার মতো তিনিও কংগ্রেস সরকার পতনের কারণ হয়ে ওঠেন।
নির্বাচনের ফলে স্পষ্ট, দলের ভিতরে-বাইরে ‘শহুরে নেতা’, ‘অহঙ্কারী’, ‘মাটির সঙ্গে সংযোগহীন’ বিবিধ অভিধা নিয়েই রাজ্য রাজনীতির ক্রিজে টিকে রইলেন জ্যোতিরাদিত্য। টিকিয়ে রাখলেন গোয়ালিয়র রাজপরিবারের প্রভাবকেও।