পুষ্টিবিদের পরামর্শ না নিয়ে ইচ্ছেমতো উপোস করে রোগা হওয়া ভাল? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
ইনস্টাগ্রামে বন্ধুর করা ‘রিল’ দেখে রান্না করতে, প্রসাধনী কিনতে কিংবা ঘর সাজাতে ভালবাসেন অনেকে। শরীরচর্চা বা ডায়েটের মতো কাজগুলি অন্য কারও পরামর্শ শুনে বা দেখে করা যায়? না করা উচিত?
প্রশ্নটা মাথায় প্রথম এসেছিল জয়ন্তের কথা শুনে। নাদুসনুদুস ঢলঢলে চেহারার জয়ন্তকে কলেজে মজা করে সকলে ‘আলুভাতে’ বলে সম্বোধন করতেন। কিন্তু ১৫-২০ বছর পর সেই চিত্রটা পুরো উল্টে গিয়েছে। সহকর্মী, বন্ধুর পরামর্শে ‘ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং’ ডায়েট করে সে একেবারে ছিপছিপে, যুবা হয়ে উঠেছে। কিন্তু তার মেয়াদ কত দিন? প্রত্যেকের শরীরের গঠন, কার্যকারিতা আলাদা। সকলের খাওয়ার ধরন, শরীরের খনিজের প্রয়োজনও এক রকম নয়। তা হলে ডায়েটই বা এক রকম হবে কেন? নিজের ইচ্ছেমতো উপোস করে পরবর্তী কালে শারীরিক কোনও সমস্যা হবে না তো?
পরিশ্রমের কোনও বিকল্প নেই। এ কথা সকলেই জানেন। তবু রোগা হওয়া বা মেদ ঝরানোর বিষয়ে প্রায় সকলেই তুলনামূলক ভাবে সহজ ‘শর্টকাট’ পন্থা বেশি পছন্দ করেন। জয়ন্ত বলেন, “শুধুমাত্র তিন মাস এই ডায়েট করেই আমি প্রায় ৮ কেজি ওজন ঝরিয়েছি। আর ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং করা তো বেশ সহজ। খাবার নিয়ে তেমন কোনও বিধিনিষেধ নেই। নির্দিষ্ট ১২ বা ১৪ ঘণ্টা কিছু না খেলেই হল।”
এই হুজুগে গা ভাসিয়েছেন অনেকেই। বন্ধুর পরামর্শে কিংবা সমাজমাধ্যমে ‘রিল’ ঘেঁটে শরীরচর্চা বা ‘ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং’ করার প্রবণতা ইদানীং বেড়েছে। রোগা হওয়ার লক্ষ্যপূরণে এই অভ্যাস কারও কাজে লাগছে। কারও আবার হিতে বিপরীত হচ্ছে।
যেমন তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার কর্মী সপ্তপর্ণা। আবার, শখের ভ্লগারও। ইনস্টাগ্রামে হাজার হাজার ছবি। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই কোনও না কোনও ক্যাফে বা রেস্তরাঁয় খেতে যান। সেই সব খাবার খেয়ে দেখে, তার মান কেমন, তা সকলকে জানানোই তাঁর কাজ। প্রায়ই যে তাঁকে এত বাইরের খাবার খেতে হয়, তা সপ্তপর্ণার চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই। বন্ধুরা তাঁর এই ছিপছিপে শরীরের গোপন রহস্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমি তো উপোস করে থাকি।” এত খাবার খেয়েও যে মানুষ কী করে উপোস করেন, তা-ও একটা রহস্য! অথচ, সপ্তপর্ণার কথা শুনে ১২ ঘণ্টা উপোস করে অফিসের মধ্যেই মাথা ঘুরে, বমি করে ‘ব্ল্যাকআউট’ হয়ে গিয়েছিলেন তাঁরই এক সহকর্মী। এমন বহু নজির রয়েছে।
নানা ব্যস্ততার মাঝে প্রতি দিন যাঁরা শরীরচর্চা করার সময় পান না, তাঁদের কাছে এই ফাস্টিং একেবারে হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো। হলিউড তো বটেই, ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং করেন বা করেছেন বলিউডের এমন অভিনেতাদের তালিকাও বেশ দীর্ঘ। অভিনেত্রী মালাইকা অরোরা থেকে আলিয়া ভট্ট, কঙ্কনা সেনশর্মা। কৌতুকশিল্পী ভারতী সিং থেকে নৃত্য প্রশিক্ষক লিজ়ি রেমো ডিসুজ়া— সকলেই এই ডায়েট করে ওজন ঝরিয়েছেন। এই ডায়েটে সুবিধা হল, খাবার নিয়ে তেমন কোনও বারণ থাকে না। শুধু সারা দিনের মধ্যে নির্দিষ্ট ১৪ থেকে ১৬ ঘণ্টা উপোস করে কাটাতে হয়। বাকি সময়টুকু প্রায় সব কিছুই খাওয়া যায়। ক্যালোরি মেপে কিংবা বেছে খাওয়ার চাইতে এই পদ্ধতি অনেক সহজ। তাই এর গ্রহণযোগ্যতাও বেশি।
কিন্তু পুষ্টিবিদের পরামর্শ ছাড়া, শরীরের ভালমন্দ চিন্তা না করে শুধুমাত্র অন্যের কথার ভিত্তিতে এই ধরনের ডায়েট করা কি ঠিক? পুষ্টিবিদ এবং যাপন সহায়ক অনন্যা ভৌমিক বলেন, “ডায়েট বা ডাক্তারি কোনওটিই ইন্টারনেট ঘেঁটে শেখা যায় না। প্রতিটি মানুষের শরীর আলাদা। ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং করে বন্ধু রোগা হয়েছেন বলে আমারও সেই পদ্ধতি কাজে লাগবে, এমনটা কিন্তু নয়। আমি বলছি না সমাজমাধ্যমে এই ধরনের ডায়েট নিয়ে যা যা বলা হচ্ছে, তার সবটা ভুল। তবে কার ক্ষেত্রে কোনটা উপযুক্ত, তা এক জন চিকিৎসকের পক্ষেই বোঝা সম্ভব।”
মডেলিং জগতে তো বটেই, ছোট পর্দার বেশ পরিচিত মুখ রণজয় বিষ্ণু। বাঙালি খাবার খেতে ভালবাসেন। কিন্তু তাঁর চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই যে, তিনি এত খাদ্যরসিক। অভিনয় ছাড়াও তাঁর টান টান ‘সিক্স প্যাক’, মেদহীন ছিপছিপে চেহারা নিয়ে সকলেরই কৌতূহল রয়েছে। অভিনেতারা নানা ধরনের ডায়েট কিংবা শরীরচর্চা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই থাকেন। তবে রণজয় বলেন, “ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং আমার জন্য নয়। আমাদের কাজের যে ধরনের শিডিউল, তাতে ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং করলে শরীরটা থাকবে না। ১২ বা ১৬ ঘণ্টার যে খাওয়ার গ্যাপ, সেটা বজায় রাখতে গেলে হয় সকালের খাবার, নয় দুপুরের খাবার, না হয় ডিনার— কিছু না কিছু বাদ পড়বে। তার জেরে শরীর খারাপ হতেই পারে। কাজের ধরন এবং শরীরের প্রয়োজন— এই দু’টি বিষয় মাথায় রেখে ডায়েট নির্বাচন করতে হয়।”
আবার, একই পেশায় থেকে বিগত ৮-৯ বছর ধরে টানা ‘ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং’ করছেন অভিনেত্রী দেবলীনা কুমার। অভিনয়ের পাশাপাশি, তাঁর ফিটনেস নিয়েও অনুরাগী মহলে যথেষ্ট চর্চা হয়। শরীরচর্চা করেন এমন অনেকের কাছেই তিনি অনুপ্রেরণা। ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং করে অনেকেই ক্লান্ত বোধ করেন, অসুস্থ হয়ে পড়েন। অ্যাসিডিটি বা গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা বেড়ে যাওয়ার প্রবণতাও দেখা যায়। কিন্তু দেবলীনা বলেন, “উল্টে আমার হজম প্রক্রিয়া আরও ভাল হয়ে গিয়েছে। এই বিষয়টা আসলে নিজেকে বুঝতে হবে। আমার জন্য কোনটা ভাল আর কোনটা নয়। বাড়ি ফিরে রাতে খাবার না খেলে আমার ঘুম হয় না। যত রাতেই ফিরি না কেন একটু কিছু খেতেই হয়। রাত করে খেলে বেশি সকালে খাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। তাই সকালের জলখাবার না খেয়ে আমি দুপুরে একেবারে ভারী খাবার খেয়ে নিই। অবশ্যই ক্যালোরি বুঝে।”
বন্ধুর কথা শুনে ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং করতে শুরু করেছে অভিনব পুততুণ্ড। সংক্ষেপে ‘পুট’। ছোট থেকে এত শীর্ণ চেহারা ছিল যে, সকলেই তাঁকে ‘পুট’ বলে সম্বোধন করতেন। কিন্তু মাধ্যমিক পাশ করার পর থেকে সেই ‘পুট’ হাওয়া ভরা চিপসের প্যাকেটের মতো ক্রমশ ফুলতে শুরু করে। ইদানীং বান্ধবীর চাপে পড়ে তেলমশলা, ফ্যাট ছাড়া সেদ্ধ খাবার খেতে শুরু করেছিল। কিন্তু বেশি দিন টানতে পারেনি। শেষমেশ ‘ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং’ ডায়েটে এসে থিতু হয়েছেন। অভিনব বলেন, “এক দিকে ভালই হয়েছে। ডায়েট মানেই তো এটা বারণ, সেটা বারণ। ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং করলে সেই ধরনের কোনও সমস্যা থাকে না। রাত থেকে টানা ১২ বা ১৪ ঘণ্টা কিছু খাই না। আর আমি তো বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকি। তাই খুব একটা অসুবিধে হয় না।” সকালের জলখাবার খাওয়ার চল তো বিদেশে বেশি। কারণ, সে সব দেশে বেশি রাত করে খাবার খাওয়ার চল নেই। কিন্তু আমাদের দেশে তো তেমনটা নয়। বেশির ভাগ বাঙালি বাড়িতে ১১-১২টার আগে রাতে খাওয়ার পর্ব মেটে না। সে ক্ষেত্রে পরের দিন সকাল ৮টায় জলখাবার খাওয়া অনর্থক। চিকিৎসক রিজ়ওয়ান সাদিক বলেন, “এখন আমরা প্রায় সকলকেই শর্ট উইন্ডো পিরিয়ড অনুসরণ করার পরামর্শ দিই। অর্থাৎ, সকাল ১০টা নাগাদ খাওয়ার জানলা খুলবেন। এবং রাত ৮টার মধ্যে সেই জানলা বন্ধ করে দেবেন। তাতে তো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তবে, তার আগে দেখে নিতে হবে ওই ব্যক্তির শরীরে নির্দিষ্ট কোনও সমস্যা রয়েছে কি না। সে ক্ষেত্রে এটি তার জন্য প্রযোজ্য নয়।”
নিজে নিজে ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং করে বিপদে পড়ে শেষে অনেকেই পুষ্টিবিদের শরণ নিয়েছেন। মাথা ঘোরা, হজমের সমস্যা, কোষ্ঠকাঠিন্য, রক্তচাপ কিংবা রক্তে শর্করা কমে যাওয়ার মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে। ভুল ডায়েট করে হৃৎস্পন্দনের হার কমে যেতে পারে। তাই শরীর নিয়ে এই ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করার পরামর্শ দিচ্ছেন সকলেই। সমাজমাধ্যমে ডায়েট, শরীরচর্চা নিয়ে কে কী বলছেন বা আমাদের চারপাশে কী ঘটছে, সে সব দেখে-জেনে রাখা অবশ্যই ভাল। কিন্তু নিজের উপর তা প্রয়োগ করার আগে অবশ্যই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।