প্রশ্ন: মুক্তির আগে নিজেই লিখেছিলেন ওয়েব সিরিজ ‘রে’ নিয়ে দর্শকের একাংশ সমালোচনা করবে। কেন?
সৃজিত: প্রচার যখন চলছিল, তখন বলেছিলাম তাত্ত্বিকদের ভাল না-ও লাগতে পারে। কারণ, এখানে বদল হবে। মানুষের অন্ধকার দিক তুলে ধরা হবে। গল্পের সংযোজন খুবই র্যাডিক্যাল হবে। অবশ্য এর চেয়েও র্যাডিকাল কাজ আগে হয়েছে। যেমন ‘কিউ’-এর 'তাসের দেশ'। তবে সত্যজিৎ রায়ের ক্ষেত্রে এমন কাজ হয়নি। এই সমালোচনা নিয়ে নেটফ্লিক্স বা আমি কেউই অবাক হইনি। কিছু মানুষ সংযোজনের অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। কেউ বলছেন, না, কিছু জিনিস সংযোজন না করাই ভাল। মানুষ সিরিজটা দেখছে। তর্ক করছে। এটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যেই আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্ত, তসলিমা নাসরিন, প্রীতিশ নন্দী— অনেকেই তাঁদের মু্গ্ধতা জানিয়েছেন। আমার খুব প্রিয় পরিচালক বিশাল ভরদ্বাজ জানিয়েছেন ‘ফরগেট মি নট’ তাঁর সবচেয়ে ভাল লেগেছে। তা নিয়ে বিশদে আলোচনাও করতে চেয়েছেন। নেটফ্লিক্স জানিয়েছে, সাফল্যের পরিসংখ্যানের দিক থেকে তারা আপ্লুত। আর কী চাই?
প্রশ্ন: সন্দীপ রায় বলেছেন, এ বার থেকে ভেবেচিন্তে গল্পের স্বত্ব দেবেন। এটা কি ‘রে’ আসার পরে?
সৃজিত: সেটা জানি না। তবে এই বিষয়ে আমি একমত। বাবুদার (সন্দীপ রায়) কাছে স্বত্ব। তিনি কোথায় দেবেন, কাকে দেবেন, কতটা দেবেন, সেটা একদম তাঁর ব্যাপার। নেটফ্লিক্সের সঙ্গে বাবুদার কী কথা হয়েছিল জানি না। গল্প থেকে চিত্রনাট্য কতটা সরবে, সে বিষয়ে বাবুদা কতটা ওয়াকিবহাল ছিলেন, তা-ও আমি জানি না।
প্রশ্ন: আপনি তো অন্যের চিত্রনাট্যে প্রথম কাজ করলেন। কেমন লাগল?
সৃজিত: খুবই ভাল লেগেছে। করোনার জন্য ২-৩ পর্যায়ে শ্যুট হয়েছিল। বেশ কয়েক মাসের ব্যবধানে। অনেকে ‘রে’-র প্রসঙ্গে অজন্তা-ইলোরা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। আমার অজন্তাতেই শ্যুট করার কথা ছিল। কিন্তু অনেক মাসের পর অতিমারির জন্য এবং কিছু নিয়মাবলির জন্য ইলোরাতেই শ্যুট করতে হয়েছিল। অতিমারির জন্য ইচ্ছে থাকলেও অনেক কিছু করা যায়নি। খুব বড় একটা শিক্ষা আর অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেলাম এই কাজটা করতে গিয়ে।
প্রশ্ন: অনেকেই বলছেন, ‘রে’ আলি ফজলের শ্রেষ্ঠ কাজ।
সৃজিত: আমারও মনে হয়। যে অভিনেতা ‘গুড্ডু ভাইয়া’ করতে পারেন, আবার ‘রে’ করতে পারেন, তাঁর অভিনয়ের ব্যাপ্তি সম্পর্কে অবহিত দর্শক তো বারে বারে মুগ্ধ হবেই। তবে মূল গল্প থেকে সরে আসায় যাঁদের ‘রে’ পছন্দ হয়নি, তাঁরাও সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেছেন অভিনয়ের জায়গা থেকে এই ছবি অনবদ্য। সে শ্বেতা বসু প্রসাদ হোক, মনোজ বাজপেয়ী হোক, কে কে মেনন হোক বা গজরাজ রাও।
প্রশ্ন: ‘রে’-র ক্ষেত্রে গল্প থেকে সরে আসার ভাবনা ছিল। কিন্তু ফেলুদার বিষয় তো আপনি বেশ গোঁড়া...।
সৃজিত: হ্যাঁ। ফেলুদা বানানোর বিষয়ে তাত্ত্বিকরা আমার উপর খুবই সন্তুষ্ট। বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসে সংলাপ। অন্য দিকে সমালোচকেরা আবার বলেন, এ কী! এত সব কিছু মেনে চললে পরিচালকের নিজস্বতা কোথায়? এ ভাবেই চলবে আর কি। শাঁখের করাত!
প্রশ্ন: আপনি অনায়াসে আপনাকে নিয়ে সমালোচনার জায়গাগুলো বলছেন। লোকে কিন্তু বলে আপনি সমালোচনা নিতে পারেন না!
সৃজিত: না, বিষয়টা তেমন নয়। ব্যক্তিগত আক্রমণ বা নোংরা ইঙ্গিতপূর্ণ আক্রমণ ছাড়া সবকিছুই আমি গ্রহণ করি। গ্রহণ করেও আসছি। এখন তো দেখি জাতীয় স্তরের সমালোচকরাও নোংরা ইঙ্গিতপূর্ণ ব্যক্তিগত আক্রমণ করছেন! এ সব বাদ দিয়ে মানুষ নিজের পরিধিতে প্রতিক্রিয়া তো জানাবেই। সেটা তো বাদ দেওয়া যায় না। আমার পরিধিতে এসে মাতব্বরি করলে আমি তা মানব কেন? সমালোচনা অবশ্যই থাকবে। এ রকমও হয়েছে যে, একজন লিখেছেন কাজের জন্য আমার অস্কার পাওয়া উচিত। আবার আরেকজন লিখেছেন, আমায় ফাঁসি দেওয়া উচিত। দুটোকে যদি মিলিয়ে দেখি, তা হলে হাতে অস্কার নিয়ে আমার মৃতদেহ ঝুলছে...অন্যরকম দৃশ্যপট তৈরি হবে।
প্রশ্ন: আপনার পারিবারিক দৃশ্যপটে খানিক আঁচড় লেগেছিল? জামাইষষ্ঠীতে নাকি ‘সমস্যা মিটেছে’?
সৃজিত: এটা অসম্ভব হাস্যকর খবর! করোনায় মানুষের কাজ কম। তাই প্রত্যেক দিন কোনও না গুজব চলতেই থাকে। শুনতে শুনতে আমি ক্লান্ত। রোজই নতুন নাম পাই। প্রত্যেক সপ্তাহে আমাকে জড়িয়ে কোনও না কোনও নাম দেখি। এখন গুজবের কোনও মাথামুণ্ডু নেই। হাসিই পায়। আর এমন ভাব যেন প্রেম, দাম্পত্যকলহ নিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করা যায় না। সে রকম কিছু হলে নিশ্চয় বলতাম। মিথিলার সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে বলতাম! শুধু শুধু জামাইষষ্ঠীর মেনু কেন টেনে আনা হল?
প্রশ্ন: নতুন প্রজন্মের প্রেম নিয়ে ছবি করছেন তো?
সৃজিত: শুক্রবার, ২ জুলাই থেকে ‘এক্স ইক্যুয়াল্স টু প্রেম’-এর কাজ শুরু। নতুন এক ঝাঁক অভিনেতাকে নিয়ে কাজ করছি। অর্জুনের (চক্রবর্তী) সঙ্গে প্রথম কাজ। সঙ্গীত পরিচালক সপ্তকও নতুন। কলকাতায় করোনা-পরবর্তী পরিস্থিতিতে ছোট বাজেটের ছবি হচ্ছে। নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করতে হবে।
প্রশ্ন: আর মুম্বইয়ে কী দেখলেন?
সৃজিত: দারুণ কাজ হচ্ছে! আমি খুব উত্তেজিত! ‘সাবাশ মিঠু’-র শ্যুট-পূর্ববর্তী কাজও প্রায় শেষ। তবে মুম্বই যে কাজ করতে চারদিন নেয়, কলকাতা দু’দিনে সেই কাজ করে। কলকাতার পয়সা কম। দ্রুত কাজ করতে শিখে গিয়েছে।
প্রশ্ন: তাপসীকে (পান্নু) কেমন লাগল?
সৃজিত: দারুণ! প্রথমে তো ক্রিকেট নিয়ে অনেক কথা হল। ব্যাটিং পদ্ধতি। কভার ড্রাইভ। মিতালি রাজের যা যা বৈশিষ্ট্য।
প্রশ্ন: এত নায়িকাকে নিয়ে কাজ করেছেন। তাপসী কোথায় আলাদা?
সৃজিত: নিঃসন্দেহে ভাল অভিনেত্রী। তবে ও যে ভাবে চরিত্র নির্বাচন করে সেটা দেখার মতো। নিজেকে একঘেয়ে হতে দেয় না। চরিত্র নির্বাচনে সুপরিকল্পিত চিন্তা আছে ওর।
প্রশ্ন: মিথিলাকে নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কী? মিথিলা কিন্তু বলেছেন, ‘সৃজিত ওর বউকে ছবিতে নেবে না...।’
সৃজিত: এটা একেবারেই ভুল কথা। ওকে এখনও আমার ছবিতে নিইনি। তাই ওর হয়তো এমন মনে হয়েছে। ’৭১-এ মিথিলার অভিনয় আমার সবচেয়ে ভাল লেগেছে। মিথিলার টেলিফিল্মও দেখেছি। ওর কমিক টাইমিং খুব ভাল। ওর মতো চরিত্র থাকলে নিশ্চয় আমার ছবিতে ও কাজ করবে।
প্রশ্ন: ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি’-তে জয়তী চক্রবর্তীর গায়ন পদ্ধতিকে নাকি আপনি পুরো ভেঙেচুরে দিয়েছেন?
সৃজিত: আমি রেকর্ডিংয়ে থাকি সব সময়। গায়ককে চরিত্র বোঝাবার জন্য। এই ছবিতে মুসকান জুবেরির গলায় গান গেয়েছে জয়তী। মুসকান জুবেরির মানসিক অবস্থান, পরিস্থিতির বিষয় ওকে মাথায় রাখতে বলেছিলাম। ফলে জয়তীর গায়কিতে একটা ছমছমে ছকভাঙা গায়ন পদ্ধতি এসেছে।
প্রশ্ন: আপনার তো বাংলাদেশে শ্যুট করার কথা ছিল...।
সৃজিত: সেটাও করোনার জন্য হল না। তবে বাঁধনকে নিয়ে কাজ করতে পেরেছি। ওকে বললাম, আমি তোমার ক্ষেত্রে সৌভাগ্যের কারণ। আমার সঙ্গে কাজ করার পরেই বাঁধনের কাজ ‘কান’ চলচ্চিত্র উৎসবে পৌঁছে গেল।
প্রশ্ন: এ বছর বাংলা ছবি সৃজিতময়। কাকাবাবু, ফেলুদা, প্রেম, থ্রিলার...আপনি কিছুই বাদ দেননি।
সৃজিত: আরে, সব কাজ তো জমে আছে! ‘কাকাবাবু’ কি আজকের! গত দু’বছর বাড়ির বাইরে গিয়ে কোনও কাজ করিনি।
প্রশ্ন: আপনি তো করোনার সময় অক্সিজেন সরবরাহ থেকে, সেফ হোমে কাজ— করোনা নিয়ে যাবতীয় তথ্য দিয়ে আসছেন।
সৃজিত: হ্যাঁ, তা করেছি।
প্রশ্ন: তৃতীয় ঢেউ আসছে। সেই আবহে প্রেক্ষাগৃহে ‘কাকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’-এর মুক্তি।
সৃজিত: আমি তো লিখেইছিলাম, ‘থার্ড ওয়েভ উইলিং...ফিঙ্গার্স ক্রসড’। সবটাই তৃতীয় ঢেউয়ের ওপর নির্ভর করছে। তবে তৃতীয় ঢেউ আসছে ভেবে পরিকল্পনা করা উচিত নয়। এলে পরিকল্পনা বদলাতে হবে।