Mirzapur Season 3 review

এত রক্ত! ‘মির্জ়াপুর ৩’ দেখতে দেখতে গা গুলোয়, তার পর ভীষণ এক ক্লান্তি গ্রাস করে

আগের দুই সিজ়নের চেয়ে ‘মির্জ়াপুর ৩’-এ হিংস্রতার পরিমাণ অনেক বেশি। আর তারই ভারে হারিয়ে যায় আগের দু’পর্বে বলা কাহিনির সূত্র। এমনকি বাদ পড়ে কিছু চরিত্রও। সিরিজ়টি দেখল আনন্দবাজার অনলাইন।

Advertisement
দেবর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০২৪ ১৪:২৬
Image of web series Mirzapur season 3

সদ্য মুক্তি পেয়েছে ‘মির্জ়াপুর সিজ়ন ৩’। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

বিগত কয়েক বছরে ‘মির্জ়াপুর’ সিরিজ় হিসাবে যথেষ্ট নাম করেছে। কেন ভাল লেগেছে মানুষের এই সিরিজ়? এক কথায় বললে, নিষ্ঠুরতা, খুনোখুনি, মারামারির কারণেই মূলত ব্যাপক সমাদর পেয়েছে সিরিজ়টি। সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে ‘মির্জ়াপুর সিজ়ন ৩’।

Advertisement

ওটিটি বিপ্লবের শুরু থেকেই জনপ্রিয় বেশির ভাগ সিরিজ়েই যৌনতা আর হিংসার প্রাবল্য। উত্তরপ্রদেশের মির্জ়াপুরেও ক্ষমতাদখলকে ঘিরে বাহুবলীদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের এই গল্প। কিন্তু অন্য একাধিক জনপ্রিয় সিরিজ়ের মতোই প্রথম দু’টি পর্বের জনপ্রিয়তা তিন নম্বর পর্বে এসে অনেকটাই ফিকে। খুনের পর খুন আর ছিটকে আসা রক্ত দেখতে দেখতে এক এক সময় একঘেয়ে লাগে, ঘুম পায়, ক্লান্ত হয়ে যান দর্শক। প্রত্যেকটি এপিসোডের সময়সীমা প্রায় এক ঘণ্টার।

অজস্র চরিত্র, প্লট-সাব প্লটের জটিল নকশা দেখতে দেখতে মনে হয়, এত রক্ত কেন? মানুষের দাম কি তবে খাসির চেয়েও কমে গেল আজকের বাজারে?

Image of Ali Ali Fazal in Mirzapur 3

‘মির্জ়াপুর ৩’-এ আলি ফজ়ল। ছবি: সংগৃহীত।

অনুরাগ কাশ্যপের হাত ধরে নতুন ধারার বলিউড ছবির সূচনাকাল থেকেই ভারতীয় ছবিতে হিংসার রমরমা। তার অবশ্যই একটা প্রেক্ষিত, একটা রাজনীতি, একটা দর্শন ছিল। কিন্তু অতিমারির পর ওটিটি প্ল্যাটফর্মের বাড়বাড়ন্তের সুযোগে হিংসাই মুখ্য হয়ে উঠল এই সব সিরিজ়ে। অবশ্য খবরের কাগজ খুললে উত্তরপ্রদেশের এই সব বাহুবলীদের ছবি ভেসে ওঠে প্রায় রোজই। সেখানে ক্ষমতাদখলই মুখ্য হয়ে ধরা দেয় এদের মুখের আড়ালে। আর সে জন্য, পরিবার-বন্ধু-প্রেম সব কিছুকেই বিসর্জন দিতে পারে এরা।

নিষ্ঠুরতার চূড়ান্ত পর্যায়ে নিজেকেই নিজের লেজ থেকে খেতে থাকে। তার পর দপ করে ফেটে যায়...

কিন্তু ‘মির্জ়াপুর’-এর প্রথম দুই সিজ়নে হিংসার একটা সত্য ছিল। বলতে বাধ্য হচ্ছি, তিন নম্বর সিজ়নে এসে তার বেশির ভাগটাই আরোপিত বলে মনে হল। মহাভারতের মতো প্রায় একটা মহা আখ্যান নামাতে গিয়ে খেই হারিয়ে গিয়েছে যেন। পঙ্কজ ত্রিপাঠী অভিনীত কালীন ভাইয়া চরিত্রটিকে ঘিরে হিংসা ছড়াতে থাকে শুরু থেকেই। প্রথম দুই পর্বে দিব্যেন্দু শর্মা অভিনীত মুন্না চরিত্রটিকে বেশ ভাল লেগেছিল। বিশেষত এই হিংস্রতার মধ্যে খানিক ‘কমিক রিলিফ’ পাওয়া গিয়েছিল তাকে দেখে। কিন্তু তিন নম্বর পর্বে এসে তার অনুপস্থিতি মানতে অসুবিধে হয়। বদলে সারা ক্ষণ সবাই সবাইকে চমকে যাচ্ছে। দিন নেই, রাত নেই, স্রেফ চড়থাপ্পর! প্রশ্ন ওঠে, এরা খায় না? ঘুমোয় না? শুধুই লাশ কাটে? তবে, আলি ফজ়ল অভিনীত গুড্ডু চরিত্রটি প্রতি পর্বেই নিজের অভিনয় দক্ষতার ছাপ রাখে। কিছুটা সামঞ্জস্য রয়েছে তার মধ্যে। কাজেই তিন নম্বর পর্বে এসেও তার দিকেই তাকিয়ে থাকতে হয়েছে।

Image of Rasika Dugal in Mirzapur 3

‘মির্জ়াপুর ৩’-এ রসিকা দুগ্গল। ছবি: সংগৃহীত।

সমাজের কোন স্তর থেকে শুরু হয় এই ক্ষমতাদখলের লড়াই? কোথায়ই বা শেষ? ‘মির্জ়াপুর’ দেখতে দেখতে সবটাই ঘেঁটে যেতে পারে। ঘর, সংসার, কলেজ, অন্দরমহল, যৌনতা, বিবাহ, বার্ধক্য, সমাজের নানা স্তর— কোনও হিংসাই বাদ রাখেনি ‘মির্জ়াপুর’। প্রথম দুই সিজ়ন দেখতে দেখতে একটা সময় নিজেকেই নিজের সন্দেহ হতে শুরু করে। মনে হতে থাকে, বন্দুকই কি তবে শেষ কথা?

তৃতীয় পর্বে গুড্ডু যখন ঘোষণা করে, এই বন্দুকের জন্যেই সমস্ত মান-সম্মান তার, তখন চারপাশের লুম্পেন সমাজটাকেই যেন রাং ধরে রক্তাক্ত ঝুলতে দেখি মাংসের দোকানে। যখন সেই হিংসা ক্রমশই বংশবিস্তার করে, পরিবারের উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বা আইন প্রশাসনের চোরাগোপ্তা বাঁকে যখন সমাজবিরোধীদের সঙ্গে গোপন আঁতাঁতগুলি একে একে উন্মুক্ত হয়, তখন কে অপরাধী আর কে আইনরক্ষক গুলিয়ে যায়। এই গুলিয়ে দেওয়াই উদ্দেশ্য ছিল মির্জ়াপুরের। কিন্তু শেষ পর্বে তা অতিরিক্ত চরিত্র ও কাহিনির ভারে নিজেকে সামলে উঠতে পারে না। যেন কাহিনিবিন্যাস ক্রমেই জটিল থেকে জটিলতর আখ্যান নির্মাণ করতে করতে আদত গল্পের আখ্যানটিই গুলিয়ে ফেলে…

‘মির্জ়াপুর’-এর নামের সঙ্গে এক হয়ে আছে পঙ্কজ ত্রিপাঠীর নাম। অথচ শেষ পর্বে পঙ্কজকে প্রায় অনুপস্থিত রাখা হল। এ বড় অদ্ভুত! তবু বলা যেতে পারে পঙ্কজ ছাড়াও এই পর্বে রসিকা দুগ্গল ও আলি ফজ়লের অভিনয় বিশেষ ভাবে দাগ কেটে গেল।

Review of web series Mirzapur season 3 starring Pankaj Tripathi and Ali Fazal

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

এমন একটা সমাজে রোজ আমরা বাঁচি, যেখানে হিংসাই ভিত্তি, হিংসাই ভবিষ্যৎ। তা প্রযুক্তির হিংসা হোক বা কর্পোরেটের, হিংসা অনিবার্য। কিন্তু হিংসা দেখতে দেখতে, তার সঙ্গে প্রাত্যহিক সমঝোতা করতে করতে, উত্তরণ কোথায় তা-ও তো দর্শকের জানতে ইচ্ছে করতে পারে!

সারা দুনিয়ায় আজ ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ ছবির কদর বাড়ছে, কারণ এই সব পাশবিক আচরণ মানুষের একঘেয়ে লাগতে শুরু করেছে। মাংসের দোকান কখনওই ভবিষ্যৎ হতে পারে না। মানুষও স্রেফ কসাই হতে চায় না। মানুষ অন্য রকম গল্প আজ বেশি দেখতে চাইছে। মানুষ ভাল থাকতে চায়। রোজকার ছোট জীবনেই সে চায়, এ সব পাঁকের মধ্যেও সন্তান যেন দুধেভাতে থাকে। সে গল্প ছবিতে না দেখালে, মানুষ কত দিন এই ‘শিল্প’ দেখবে? আর কেনই বা পাশে দাঁড়াবে, প্রশ্ন থেকেই গেল!

আরও পড়ুন
Advertisement