celebrity interview

‘যাঁদের সঙ্গে দেখা হয়, তাঁদের সিংহভাগ ছবি তৈরির বদলে নিজেদের পরিচিতি তৈরি করতে ব্যস্ত!’

চলতি সপ্তাহে মুক্তি পাচ্ছে ‘মানিকবাবুর মেঘ’। তার আগে আগে আনন্দবাজার অনলাইনকে তাঁর সফর এবং এই ছবির নেপথ্য আখ্যান শোনালেন পরিচালক অভিনন্দন বন্দ্যোপাধ্যায়।

Advertisement
অভিনন্দন দত্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০২৪ ১২:২৬
Image of director Abhinandan Banerjee

পরিচালক অভিনন্দন বন্দ্যোপাধ্যায়। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

কলেজের প্রথাগত শিক্ষা সম্পূর্ণ করেননি। ১৪ বছর বয়সে ছদ্মনামে সংবাদপত্রে নিয়মিত কলাম লিখতেন। লিটল ম্যাগাজ়িন নিয়ে ‘পাগলামি’, সাহিত্য জগতে অবাধ যাতায়াত। ১৭ বছর বয়সে নিজস্ব প্রকাশনা সংস্থার জন্ম। কাজ করেছেন শিল্পের একাধিক মাধ্যমে। সেখান থেকে ছবি পরিচালনা! অভিনন্দন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সফর আকর্ষণীয়। দেশ-বিদেশের একাধিক চলচ্চিত্র উৎসবে সম্মানিত হওয়ার পর অবশেষে বাংলায় মুক্তি পাচ্ছে তাঁর প্রথম ছবি ‘মানিকবাবুর মেঘ’। সম্প্রতি এক সন্ধ্যায় কফির আড্ডায় আনন্দবাজার অনলাইনের রেকর্ডারের সামনে অকপট পরিচালক।

Advertisement

চোখে ঘুম নেই। শেষ মুহূর্তে ছবির পোস্ট প্রোডাকশনের ব্যস্ততা চলছে। ইতিমধ্যেই ‘মানিকবাবুর মেঘ’ নিয়ে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া অভিনন্দনের মনোবল বাড়িয়েছে। বলছিলেন, ‘‘দেখছি, অনেকেই ছবিটার বিষয়ে জানেন। আবার অনেকেই জানিয়েছেন যে, তাঁরা নাকি ছবিটার মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছেন।’’

বারাসতের ছেলে অভিনন্দন। মুম্বইয়ের রিজ়ভি কলেজ অফ আর্কিটেকচারে পড়াশোনা। সেখান থেকে পরিচালনায় চলে এলেন কী ভাবে? অভিনন্দন হেসে বললেন, ‘‘আমি তো ভেবেছিলাম, বাংলা অনার্স নিয়ে পড়ব আর লেখালিখি করব। কয়েকটা বই হবে। তার পর এক দিন মরে যাব।’’ ছোট থেকেই সাহিত্য অনুরাগী। পরিচালকের মতে, সাহিত্য তাঁর পরিচালনায় আসার নেপথ্যে অন্যতম অনুপ্রেরণা। অভিনন্দনের কথায়, ‘‘সবাই যখন খেলাধুলো নিয়ে মেতে থাকত, আমার সময় কাটত ডিজ়াইনিং সফ্‌টঅয়্যার নিয়ে। তাই এক সময় ডিজ়াইনিংয়ের কাজ, আঁকা, বইয়ের প্রচ্ছদ তৈরি— সবই করেছি।’’

image of Chandan Sen

‘মানিকবাবুর মেঘ’ ছবির একটি দৃশ্যে চন্দন সেন। ছবি: সংগৃহীত।

ছোট থেকেই বন্ধুবান্ধব কম। লেখালিখি এবং পড়াশোনা নিয়ে নিজের স্বতন্ত্র জগৎ তৈরি করেছিলেন অভিনন্দন। ‘মানিকবাবুর মেঘ’ যে অনেকাংশে তাঁর নিজের জীবনের বিচ্ছিন্ন ঘটনা দ্বারা অনুপ্রাণিত, সে কথা স্বীকার করে নিলেন পরিচালক। বললেন, ‘‘শুধুই মেঘের সঙ্গে একজন মানুষের সম্পর্ক নয়, স্কুলজীবনে টিফিনের সময় আমবাগানে একা একা সময় কাটানো থেকে শুরু করে প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক— সবটাই এই ছবির অনুপ্রেরণা।’’

‘মানিকবাবুর মেঘ’ অন্য ধারার ছবি। চলচ্চিত্রের অন্য ভাষা সেখানে বুনে দিয়েছেন পরিচালক। প্রথম ছবিতেই এই সিদ্ধান্তের নেপথ্যে আরও এক আখ্যান রয়েছে। অভিনন্দন বললেন, ‘‘আমি মাধ্যমটার প্রতি সৎ থাকতে চেয়েছিলাম। আমার মতে, পৃথিবীতে দু’ধরনের পরিচালক রয়েছেন। এক জন সিনেমা তৈরি করতে চান, অন্য জন চলচ্চিত্র নির্মাতা হতে চান। নব্বই শতাংশই কিন্তু দ্বিতীয় ভাগে থাকেন।’’ শিল্পীর সাফল্য যে তাঁর পরিশ্রমের ফসল সে কথা মেনে নিচ্ছেন অভিনন্দন। এ ক্ষেত্রে প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘প্রাণের দায়ে লিখি’ মন্তব্য বা ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ অভিনন্দনের অনুপ্রেরণা। বললেন, ‘‘কে কী বলছেন, তার তোয়াক্কা না করে একের পর এক ছবি এঁকে গিয়েছেন ভ্যান গঘ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সত্যজিৎ রায়ও কিন্তু তা-ই করেছিলেন।’’

প্রথম ছবিতে অনেকেই তারকাদের নিয়ে কাজ করতে চান। অভিনন্দন সে পথে অগ্রসর হননি। তাঁর ছবির প্রধান চরিত্রে চন্দন সেন। পরিচালক বললেন, ‘‘দর্শক সব সময়েই চমক পছন্দ করেন। আর যাঁকে আগে কখনও এক্সপ্লোর করা হয়নি, তিনি সুযোগ পেলে কিন্তু নতুন কিছু দিতে পারেন। চন্দনদার ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছে।’’ বিশ্বের দরবারে প্রতিভার বিচারে সম্মান আসে। তারকা সেখানে গৌণ বলেই মনে করেন অভিনন্দন। কথাপ্রসঙ্গেই কান চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কারজয়ী অনসূয়া সেনগুপ্তের নাম উল্লেখ করলেন তিনি।

ছবিটির প্রযোজক বৌদ্ধায়ন মুখোপাধ্যায়। তাঁর সঙ্গে অভিনন্দনের আলাপও বেশ অন্য ভাবে। বৌদ্ধায়নের দাদা কবি আর্যনীল মুখোপাধ্যায়। অভিনন্দনের কথায়, ‘‘কলেজ ছেড়ে দেওয়ার পর কী করব বুঝতে পারছি না। তখন আর্যনীলদার সূত্রেই বৌদ্ধায়নদার সঙ্গে আমার পরিচয়।’’ বৌদ্ধায়নের প্রথম বাংলা ছবি ‘তিনকাহন’-এর অন্যতম চিত্রনাট্যকার অভিনন্দন। তাঁর কথায়, ‘‘আমার তখন মাত্র ১৯ বছর বয়স। বৌদ্ধায়নদা সেই সময় আমাকে ছবি পরিচালনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন! সত্যি বলছি তিনি এবং মোনাদি (বৌদ্ধায়নের স্ত্রী মোনালিসা) না থাকলে আমি ছবিটা তৈরি করতে পারতাম না।’’

চলচ্চিত্রের ভাষার প্রতি দায়বদ্ধ থাকলেও বক্স অফিসের গুরুত্ব বোঝেন অভিনন্দন। এই ছবি থেকে কী রকম প্রত্যাশা তাঁর? বললেন, ‘‘ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ারের আগে আমার মনেও সন্দেহ ছিল। কিন্তু তার পর থেকে দর্শকের প্রতিক্রিয়া দেখে সাহস বেড়েছে। অনেক বই পড়ি, কিন্তু পরে মনেও থাকে না। তবে দু’-চারটে বই কিন্তু আজীবনের জন্য বইয়ের তাকে রয়ে যায়। এই ছবিটাও আমার কাছে খুবই পার্সোনাল।’’

image of Chandan Sen and Abhinandan Banerjee

‘মানিকবাবুর মেঘ’ ছবির সেটে চন্দন সেনকে শট বুঝিয়ে দিচ্ছেন অভিনন্দন। ছবি: সংগৃহীত।

‘মানিকবাবুর মেঘ’ অন্য ধারার ছবি। কিন্তু মূলধারার কাহিনিচিত্র অভিনন্দনের অত্যন্ত পছন্দের। তাঁর কথায়, ‘‘একটা ‘গুপী গাইন’ বা ‘পাতালঘর’ আজও সামনে পেলে দেখে ফেলতে পারি।’’ একই সঙ্গে জানালেন, ঘনাদাকে নিয়ে ছবি তৈরির স্বপ্ন দেখেন এখনও। তবে গত এক-দু’বছর কাজের ব্যস্ততায় সেই ভাবে বাংলা ছবি দেখার সময় পাননি তিনি। শেষ দেখা পছন্দের বাংলা ছবি অতনু ঘোষের ‘বিনিসুতোয়’।

টলিপাড়ায় সেই ভাবে এখনও বন্ধু নেই অভিনন্দনের। হেসে বললেন, ‘‘আমার আবাঙালি বন্ধু বেশি। যেমন নাতেশ (‘পেদ্রো’ ছবির পরিচালক নাতেশ হেগড়ে) বা রীতেশ (‘ঝিনি বিনি চাদরিয়া’ ছবির পরিচালক রীতেশ শর্মা)।’’ তবে বাংলার ঈশান ঘোষ (‘ঝিল্লি’ ছবির পরিচালক) ও প্রসূন চট্টোপাধ্যায়ের (‘দোস্তজী’ ছবির পরিচালক) কথাও উল্লেখ করলেন তিনি।

মুম্বইয়ে থাকেন পেশার তাগিদে। কিন্তু শহর হিসেবে এখনও কলকাতায় পালিয়ে আসতে পারলে হাঁপ ছাড়েন অভিনন্দন। আগামী দিনে আবারও বাংলা ছবি পরিচালনা করার ইচ্ছে রয়েছে বলেই জানালেন তিনি। কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে নেটপ্যাক পুরস্কার জয়ের পর টলিপাড়া থেকেও অভিনন্দন অল্পবিস্তর প্রস্তাব পেয়েছেন। কিন্তু তিনি অপেক্ষা করতে রাজি। তাঁর কথায়, ‘‘অনেকেই আমাকে বলেছেন নিজের পরিচিতি তৈরি করতে তিনটে এ রকম ছবিই তৈরি করতে! আমি কিন্তু ভাল কাজ করতে চাই। তার বেশি কিছু ভাবতে চাই না।’’

বাংলা ছবিকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে পৌঁছে দিতে নির্মাণশৈলীর উপরে আরও গুরুত্ব আরোপ করতে হবে বলে জানালেন অভিনন্দন। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে চিত্রনাট্য যেন ‘উৎপাদন’ করা হচ্ছে বলেই মনে করছেন তিনি। অভিনন্দনের আক্ষেপ, ‘‘মুশকিলটা হল, যাঁদের সঙ্গে দেখা হয়, তাঁদের সিংহভাগ সিনেমা তৈরির পরিবর্তে পরিচালক হিসেবে নিজেদের পরিচিতি তৈরি করতে ব্যস্ত!’’ কোনও রকম লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে কাজ করার ব্যাপারে আপত্তি রয়েছে অভিনন্দনের। তাঁর কথায়, ‘‘পুজোর ছবি আমিও তৈরি করতে চাই, কিন্তু সেটা কনটেন্টের প্রেমে পড়ে। বরং চেষ্টা করব, ছবিটা যেন পুজো বা গরমের ছুটিতে মুক্তি পায়।’’

অভিনন্দনের মতে, চারপাশে মধ্যমেধার বাড়বাড়ন্ত। কারণ, কেউ প্রতিবাদ করেন না। তবে সিনেমার ক্ষেত্রে ‘দর্শক দেখছে না’-গোছের মন্তব্যকে ‘অজুহাত’ হিসেবেই উল্লেখ করতে চাইছেন তিনি। অভিনন্দনের কথায়, ‘‘দোষ তো আমাদের! ভাল ছবি দর্শককে না দিতে পারলে, তাঁরা বুঝবেন কী ভাবে যে, কোনটা ভাল আর কোনটা খারাপ।’’ বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে ‘বেঙ্গল ইজ় পাস্ট, সাউথ ইজ় প্রেজ়েন্ট’ শুনে ক্লান্ত অভিনন্দন। তাঁর মতে, কোনও এক জনের পক্ষে সম্পূর্ণ পরিস্থিতি বদলে দেওয়া কঠিন। অভিনন্দন বললেন, ‘‘অন্তত চার-পাঁচ জন যদি সেই প্রেমেনবাবুর মতো ‘প্রাণের দায়ে’ কাজ করতে পারি, তা হলে নিশ্চয়ই ভাল সময় ফিরবে।’’

এই মুহূর্তে বেশ কিছু হিন্দি প্রজেক্টের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন অভিনন্দন। পাশাপাশি, নিজের পরিচালনায় স্বল্পদৈর্ঘ্যের দু’টি বাংলা ও একটি হিন্দি অ্যানিমেশন ছবির কাজও এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। বছরের শেষে অভিনন্দন একটি হিন্দি ছবি ও একটি ওয়েব সিরিজ় পরিচালনার কাজ শুরু করবেন।

আরও পড়ুন
Advertisement