‘তালমার রোমিয়ো জুলিয়েট’ ওয়েব সিরিজ়ের একটি দৃশ্যে দেবদত্ত রাহা এবং হিয়া রায়। ছবি: সংগৃহীত।
বার বার ঘুরে ফিরে আসে ওরা। বছরের পর বছর প্রেম আর তার মর্মান্তিক পরিণতির গল্প শুনিয়ে যায় দু’টি চরিত্র— রোমিও আর জুলিয়েট। ১৫৯৭ সালের ইংল্যন্ডে তাদের জন্ম দিয়েছিলেন শেক্সপিয়র। কিন্তু যুগে যুগে তারা ফিরে এসেছে বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপটে।
এ বার শীতে আরও একবার বাংলায় সেই প্রেমের আদি আখ্যান আসছে ঘুরে ফিরে, একেবারে বাংলার জলহাওয়ায়। মুক্তি পাচ্ছে নতুন ওয়েব সিরিজ় ‘তালমার রোমিও জুলিয়েট’। এ সিরিজ়ে অভিনেতা অনির্বাণ ভট্টাচার্যের সঙ্গে রয়েছেন একদল নতুন অভিনেতা। জড়িয়ে গিয়েছে নতুন পরিচালকদের নামও। এই প্রথম নয়, এর আগে, ‘মন্দার’ সিরিজ় ও ‘অথৈ’ ছবিতেও দেখা গিয়েছিল এই ধারা। প্রধান চরিত্রে অনির্বাণ ছিলেন। তবে একই সঙ্গে কখনও দায়িত্ব নিয়েছেন পরিচালক হিসাবে, কখনও সৃজনশীল পরিচালক হিসাবে। তাঁর হাত ধরেই বার বার থিয়েটারের নতুন অভিনেতা ও পরিচালকদের দেখা গিয়েছে পর্দায়। এ বারও তেমন ভাবেই ধরা দিচ্ছে ‘তালমার রোমিও জুলিয়েট’।
প্রেক্ষাপটে চিরন্তন এক প্রেম গাথা। সাম্প্রদায়িক হানাহানি, হিংসা, প্রেমহীনতা যত বাড়ছে এ দুনিয়ায়, ততই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে চির চেনা সেই কাহিনি। ‘তালমার রোমিও জুলিয়েট’ দেখতে দেখতেও তাই দর্শকের মনে হতে পারে, যেন সমকালীন এক ছবিই দেখছেন। ছবি দেখতে দেখতে বার বার কানে বাজবে একটি শব্দবন্ধ ‘ফুল বডি রিল্যাক্স’। অনির্বাণের সংলাপে বার বার ফিরে আসে ‘ফুল বডি রিল্যাক্স’, যেন মানুষের চেতন আর অচেতন এক রাখার হাতছানি দিয়ে যায়।
পরিচালক হিসাবে অনির্বাণের কাজে বার বার ফিরে আসছেন শেক্সপিয়র। ‘অথৈ’ হোক বা ‘মন্দার’ অথবা, ‘তালমার...’, প্রায় সাড়ে চারশো বছরের পুরনো এক নাট্যকারের কাছেই হাত পাততে হচ্ছে তাঁকে! অনির্বাণ একে ‘নিতান্ত কাকতালীয়’ বলে এড়িয়ে গিয়েছেন। দাবি করেছেন এ সিরিজটি প্রেমের। প্রচারেও উঠে এসেছে সেই কথা। কিন্তু প্রশ্ন তো থেকেই যায়।
রোমিও অর্থাৎ রানা-র চরিত্রে দেবদত্ত রাহা আর জুলিয়েট অর্থাৎ জাহানারা-র ভূমিকায় হিয়া রায়কে দেখলে মনে ভাললাগা তৈরি হয়। জুলিয়েটের বারান্দা থেকে ভেসে আসে নিষেধাজ্ঞা। প্রাণের চেয়ে প্রিয় প্রেমিককে তার কাছে আসতে নিষেধ করে দেয় জুলিয়েট। তেমনই তো হওয়ার কথা। কিন্তু ‘তালমার রোমিও’ রানাকে কেউ আটকাতে পারে না। প্রেমের জন্য সে বাড়ি ছাড়তে পারে, নিতে পারে ছদ্মবেশ, রেললাইনে দিতেও পারে গলা। নিজের দুই সাগরেদকে নিয়ে একের পর এক কাণ্ড করে বেড়ায় রানা গোটা ছবি জুড়ে।
এ দিকে চিত্রনাট্য বয়নেও অনুভব করা যায় একটা টান। উত্তরবঙ্গের জনপদ তালমার মানুষ, বসতি, একটি সেলুন থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের অনুপুঙ্খ বর্ণনা কোথায় যেন নির্মম মনোভাবের ছাপ রেখে যায়। এমনকি, যৌনতার মুহূর্তগুলিও যে ভাবে বুনে দেওয়া হয়েছে নৃশংসতার সঙ্গে তাতে সেই টান অবিচ্ছিন্ন বলে মনে হয়।
কিন্তু, সমস্যা হল, এ ছবি দেখতে গিয়ে বার বার মনে পড়ে যাবে ‘মন্দার’ বা ‘অথৈ’-এর কথা। শুধু শেক্সপিয়রে নয়, তিনটি ছবিতেই মিল রয়েছে কাহিনি বয়নে, দৃশ্যায়নে, এমনকি ভাষায়। অনির্বাণের তিনটি কাজে পর পর উঠে এসেছে ‘ম্যাকবেথ’, ‘ওথেলো’ এবং ‘রোমিও-জুলিয়েট’। তিনটি ছবিতেই ঘুরে ফিরে এসেছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন, তাদের নিজস্ব ভাষা, অপরাধ প্রবণতার চিহ্ন। এমনকি, চিত্রগ্রহণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত চড়া রঙের ব্যবহারও এ ছবিতে একঘেয়ে লাগে। মনে হয়, এই সব চরিত্রদের আগেই দেখা হয়ে গিয়েছে কোথাও। খলনায়ক অনির্বাণকেও যেন চেনা-চেনা লাগে। বিশেষত মনে পড়ে ‘অথৈ’-এর কথা। যদিও এ সিরিজ়ে তিনি যেন আরও পরিণত, ভারসাম্যে ভরপুর। নৃশংসতা কমেনি একটুও।
শেক্সপিয়রের মূল আখ্যানের মতোই এ সিরিজ়েও দুই পরিবারের অহঙ্কারের সংঘাত এই সিরিজ়েরও মূল সুর। দুই পক্ষের দেখা যায় কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় ও জয়দীপ মুখোপাধ্যায়কে। রানা ও তার বন্ধুদের রয়াসনও চমৎকার। তাই তাদের মৃত্যু মুহূর্ত দর্শকের আবেগ ছুঁয়ে যায়। দর্শক জানেন ‘রোমিও-জুলিয়েট’-এর পরিণতি। তাই প্রথম থেকেই কারুণ্য নিয়ে চলতে চলতে মনে হতেই পারে, ভালবাসার দিনেও এত রক্তের কি কোনও প্রয়োজন ছিল? আছে?
উত্তরবঙ্গের পটভূমিতে সাজানো গোটা সিরিজ়টি। ভালই ব্যবহার করা গিয়েছে সেই প্রেক্ষাপট। কিন্তু খুব ভাল করে ভাবলে বোঝা যায়, আজকের উত্তরবঙ্গের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সিরিজ়ের খুব মিল নেই। সারা রাজ্য যখন বিচারের দাবিতে উত্তাল , তখনও এমন একটা প্রেম নির্মম ভাবে হত্যা হলে কি গর্জে উঠবেন না সাধারণ মানুষ? বাস্তবেও এমন প্রেমের মর্মান্তিক পরিণতি দেখেছে বাংলা। এক দশক আগের সেই স্মৃতি এখন অনেকটাই ফিঁকে। আজও বিচার পাননি রিজ়ওয়ানুর রহমান। শিল্পীর প্রতিবাদের ভাষা কেমন হবে তা নিয়ে নিজস্ব মত রয়েছে অনির্বাণের। সে কথা স্পষ্টই জানিয়েছেন তিনি। কিন্তু শিল্প, বিশেষ করে শেক্সপিয়রকে সমকালে দেখতে গেলে প্রশ্ন তো উঠবেই আরও একবার। সে প্রশ্নে রেখেই শেষ হয় ‘তালমার রোমিও জুলিয়েট’
সিরিজ়ের শেষ দৃশ্যে পাহাড়ি রাস্তায় ছুটে চলেছে তালমার রোমিও রানা। জুলিয়েটকে নিয়ে পাহাড়ের কোলে ঘন অরণ্যে হারিয়ে যায় তারপর সে। কিন্তু মোস্তাকের দলবল তাকে তাড়া করে। পাহাড়ের কোলে এই মুহূর্তটি দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনই নৃশংস।
কিন্তু অনির্বাণের কাছে প্রত্যাশা হয়তো বেশি। তাই ভাবা যেতেই পারে আগামীতে শেক্সপিয়রের কাছে হাত পাতলেও চিত্রনাট্য ও কাহিনি বয়নে নতুনত্ব থাকবে।